কথায় আছে ‘টাকার মুখ বাঁকা’ অর্থাৎ টাকা ধার দিলে সম্পর্ক নষ্ট হয়– কারণ ধার দেয়া বা ঋণের টাকা সময়মতো ফেরত পাওয়া নিয়ে সম্পর্কের অবনতি হয়। এমনকি এ বিষয় নিয়ে অনেক সময় আদালত পর্যন্ত গড়ায়। প্রচলিত আছে, টাকা উদ্ধারের জন্য নাকি দেনাদারের বাড়ি আর আদালত পাড়ায় ঘুরতে ঘুরতে কয়েক জোড়া জুতার তলা ক্ষয় হয়। অনেক ক্ষেত্রেই আমরা দৈনন্দিন জীবনে নানা কারণে একে অপরকে টাকা ধার দেই, ঋণ দেই পরে ফেরত পাই না বা ফেরত পেতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয় বা মিত্থ্যা আশ্বাসে টাকা দিয়ে প্রতারিতও হই।
টাকা ফেরত না পেলে দেওয়ানি এবং ফৌজদারি উভয় আইনেই প্রতিকারের বিধান আছে। টাকা উদ্ধারের মোকদ্দমা মূলত দেওয়ানি প্রকৃতির। দেওয়ানি কার্যবিধি ১৯০৮-এর ধারা ৯-এর ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে দেওয়ানি প্রকৃতির মোকদ্দমা হলো– যে মোকদ্দমায় কোনো সম্পত্তির অধিকার অথবা কোনো পদে অধিষ্ঠিত থাকা বা হওয়ার অধিকার নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা।
টাকার মোকদ্দমা বিষয়ে দেওয়ানি কার্যবিধিতে উল্লেখ আছে আদেশ ৭-এর বিধি ২-এ উল্লেখ আছে, বাদী যখন অর্থ উদ্ধারের আবেদন করেন, তখন আরজিতে দাবি করা অর্থের সথাযথ বা নির্দিষ্ট পরিমাণ উল্লেখ করতে হবে। কিন্তু যেক্ষেত্রে বাদী ওয়াশিলাতের উদ্দেশ্যে অথবা বিবাদী এবং তার মধ্যে অমীমাংসিত হিসাব গ্রহণ ও সম্ভাব্য পাওনা টাকা উদ্ধারের জন্য মোকদ্দমা দায়ের করেন, সেক্ষেত্রে আনুমানিক পরিমাণ উল্লেখ করতে হবে।
উক্ত আদেশের বিধি ১(ছ) বলা হয়েছে, যেক্ষেত্রে বাদী তার আংশিক দাবি পারস্পরিকভাবে পরিশোধ সম্মত হয়েছে বা বর্জন করেছে সেক্ষেত্রে দাবির যে অংশ অনুরূপভাবে পরিশোধ বা বর্জন করা হয়েছে সেটাও উল্লেখ করতে হবে। একই নিয়ম বিবাদীর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য যা আদেশ ৮-এর বিধি ৬-এ উল্লেখ করা হয়েছে।
একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টা বোঝা সহজ হবে– ক একটি বিল অব এক্সচেঞ্জ বাবদ ৫ লাখ টাকার জন্য খ-এর বিরুদ্ধে মোকদ্দমা করে। খ ক-এর বিরুদ্ধে তার আগে ১ লাখ টাকার ডিক্রি লাভ করেছিল। দুইটি দাবি সুনির্দিষ্ট আর্থিক দাবি বিধায় পারস্পরিক পরিশোধযোগ্য।
আদেশ ২১ বিধি ১১ অনুযায়ী অর্থে পরিশোধের মোকদ্দমায় ডিক্রি জারির জন্য মৌখিক আবেদন করা যায়। অন্য সব ক্ষেত্রে ডিক্রি জারির আবেদন লিখিত হতে হয়। দেওয়ানি আদালতের আদেশে ডিক্রি জারির জন্য দেনাদারকে যেকোনো সময় কিংবা যেকোনো দিন গ্রেপ্তার করা যায় এবং দেওয়ানি কারাগারে আটক করা যায়। তবে ধারা ৫৫ অনুযায়ী দেনাদারকে আটকের উদ্দেশ্যে কোনো বাসগৃহে সূর্যাস্তের পর থেকে সূর্যোদয়ের আগে প্রবেশ করা নিষেধ। ধারা ৫৬ অনুযায়ী টাকা পরিশোধের ডিক্রি জারির ক্ষেত্রে কোনো মহিলাকে গ্রেপ্তার অথবা দেওয়ানি কারাগারে আটক করা যায় না। ধারা ৫৮ক অনুযায়ী পঞ্চাশ টাকা বেশি পরিশোধের ডিক্রির ক্ষেত্রে আদালত ৬ মাসের জন্য এবং পঞ্চাশ টাকার কম পরিশোধের ক্ষেত্রে ৬ সপ্তাহে জন্য দেওয়ানি আদালতে আটক রাখার আদেশ দিতে পারে।
আবার বিশ্বাস ভঙ্গ বা প্রতারণার উপাদান বিদ্যমান থাকলে দণ্ডবিধি ১৮৬০-এর ৪০৬ এবং ৪২০ ধারা অনুযায়ী ফৌজদারি মামলা দায়ের করা যাবে। অপরাধমূলক বিশ্বাস ভঙ্গের উপাদানসমূহ ৪০৫ ধারায় উল্লেখ আছে। ৪০৫ ধারা অনুযায়ী যদি কোনো ব্যক্তি অসৎভাবে কোনো সম্পত্তি তার নিজের মনে করে বা হস্তান্তর করে কিংবা আইনানুগ কোনো চুক্তির খেলাফ করে কোনো সম্পত্তি ব্যবহার করে ওই রকম কাজগুলোও অপরাধমূলক বিশ্বাস ভঙ্গ বলে গণ্য হবে। ৪০৬ ধারায় চার্জ গঠনের সময় প্রথমে দেখা হয় আসামির ওপর কোনো সম্পত্তি ন্যস্ত করা হয়েছিল কি না, তারপর দেখতে হবে আসামি ওই সম্পত্তি আসাধুভাবে আত্মসাৎ করেছে কি না বা নিজের ব্যবহার করেছে কি না। এই দুটি উপাদান বর্তমান থাকলে ৪০৬ ধারায় চার্জ গঠন করা যাবে।
৪২০ ধারা প্রতারণা-সংক্রান্ত। প্রতারণা কী এবং কী ধরনের কাজ প্রতারণা হিসেবে গণ্য হবে তা ৪১৫ ধারায় উল্লেখ আছে। ৪২০ ধারায় মামলায় অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় যে লেনদেনের একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে কোনো প্রতারণা ছিল না। প্রাথমিক পর্যায়ে কোনো প্রতারণা ছিল কি না সে বিষয়ে সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে এবং সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে সিদ্ধান্ত দিতে হবে। এমনকি আসামির পরবর্তীকালের আচরণ হতেও তা বোঝা যেতে পারে। সাধারণত কোনো ধূর্ত ব্যক্তি ঋণ নেয়ার সময় তার অসৎ উদ্দেশ্য গোপন রাখার চেষ্টা করে কিন্তু পরবর্তী সময়ে তার আচরণে তা প্রকাশ পেয়ে যেতে পারে। যেমন, পাওনাদার যখন দেনাদারের কাছে টাকা ফেরত চায়, তখন দেনাদার টাকা দিতে অস্বীকার করে এবং তাকে হত্যার হুমকি দেয়– তার এ আচরণ হতে প্রতীয়মান হয় যে, প্রথম থেকেই তার উদ্দেশ্য ছিল প্রতারণা করা।
অনেক সময় ৪০৬ এবং ৪২০ ধারায় একই আসামির বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করা যেতে পারে– তবে দুটি অপরাধের উপাদান থাকতে হবে।
চেকের মাধ্যমে লেনদেন হয়ে থাকলে চেক যদি ডিজ অনার হয় তাহলে হস্তান্তরযোগ্য দলিল আইন ১৮৮১-এর ধারা ১৩৮ অনুযায়ী চেক ডিজ অনার মামলা করা যাবে। তবে সম্প্রতি আপিল বিভাগ সিদ্ধান্ত দিয়েছেন যে, বাদীকে অবশ্যই প্রতিদান প্রমাণ করতে হবে। অর্থাৎ, কী দায় পরিশোধ করার জন্য চেকটি দেয়া হয়েছিল সেটি চেক গ্রহীতাকে প্রমাণ করতে হবে। অন্যথায় শুধু চেক ডিজ অনার হলেই ১৩৮ ধারা অনুযায়ী শাস্তি দেয়া যাবে না।
সাধারণত অপ্রতুল তহবিলের করণে চেক ডিজ অনার হয়। এছাড়া চেক প্রদানকারীর স্বাক্ষর যদি না মেলে বা হিসাব বন্ধ পাওয়া যায় বা চেকে উল্লিখিত টাকার অঙ্ক ও কথায় লিখিত পরিমাণ গড়মিল হয় বা চেকের অর্থ পরিশোধ না করতে নির্দেশনা থাকে তাহলেও চেক ডিজ অনার হতে পারে।
চেক ডিজ অনার হওয়ার জন্য শর্ত হলো চেক ইস্যু করার তারিখ থেকে ৬ মাসের মধ্যে বা চেকের বৈধতা বা কার্যকারিতা বিদ্যমান থাকার সময়ের মধ্যে আগে ঘটে, সেই সময়ের মধ্যে চেক নগদায়নের জন্য ব্যাংকে জমা দিতে হবে। উক্ত সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পর ১৩৮ ধারা অনুযায়ী আর টাকা দাবি করা যায় না। চেকটি অপরিশোধিত হয়ে ব্যাংক থেকে ফেরত আসার ৩০ দিনের মধ্যে চেকদাতাকে নোটিশ দিতে হয় এবং নোটিশপ্রাপ্তির ৩০ দিনের মধ্যে চেকদাতা উল্লিখিত টাকা পরিশোধ করতে ব্যর্থ হলে পরবর্তী ৩০ দিনের মধ্যে চেক গ্রহীতা মামলা দায়ের করতে পারবে।
একই বিষয়ে দেওয়ানি মোকদ্দমা অথবা দণ্ডবিধির ৪০৬ ও ৪২০ ধারার অধীন ফৌজদারি মামলা বিচারাধীন থাকাবস্থায়ও ১৩৮ ধারা অনুযায়ী মামলা করতে কোনো বাধা নেই। কারণ দেওয়ানি এবং ফৌজদারি মামলার প্রতিকার ও শাস্তি ১৩৮ ধারায় উল্লিখিত প্রতিকার ও শাস্তি হতে সম্পুর্ণ ভিন্ন।
ঋণের টাকা ফেরত দিতে অস্বীকার করলে ফৌজদারি মামলায় প্রতিকার পাওয়া যাবে না। কারণ ঋণের টাকা ঋণ গ্রহণের পর ঋণ গ্রহীতার হয়ে যায় এবং সে টাকা ফেরত দিতে না চাইলে বা না দিলে তা দেওয়ানি দায় হবে। এটা এখন প্রতিষ্ঠিত নীতি যে ঋণ গ্রহণের সময় যদি কোনো প্রতারণামূলক কাজ না করে ঋণ নেয়া হয় এবং ফেরত দেয়ার সুনির্দিষ্ট কোনো তারিখ উল্লেখ করা না হয় তখন যদি ঋণগ্রহীতা ফেরত না দেয় তাহলে ৪০৬ বা ৪২০ ধারার অধীন অপরাধ (অপরাধমূলক বিশ্বাস ভঙ্গ বা প্রতারণা) হবে না – দেওয়ানি দায় হবে।
ঋণের বিষয়টি দেওয়ানি দায় হিসেবে গণ্য হবে যদি না অভিযোগ করা হয় যে, ঋণ গ্রহণের সময় গ্রহীতা কোনো রকম প্রলোভন বা প্ররোচনা দিয়েছিল। তবে ঋণের টাকা ফেরত না দিলে ৪০৬ ধারার অপরাধ হবে না– কারণ ঋণ গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে ওই টাকা গ্রহীতার হয়ে যায়।
কোনো ব্যক্তিকে ভুলবশত বেশি টাকা দেয়া হয় এবং পরে সেই অতিরিক্ত টাকা ফেরত দিতে না চায় তাহলে ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে আত্মসাতের অভিযোগ দায়ের করা যাবে। দণ্ডবিধির ৪০৩ ধারার উদাহরণ- (ক) অনুযায়ী এটা আত্মসাৎ। ব্যবসায়িক লেনদেনের ক্ষেত্রে হিসাব করার পড় যদি কোনো টাকা পাওনা হয় সেক্ষেত্রেও দেওয়ায়নি দায় তৈরি হবে; ফৌজদারি দায় হবে না।
আবার কেউ টাকা নেয়ার পর যদি অস্বীকার করে সেক্ষেত্রে ফৌজদারি দায় তৈরি করবে। তবে পক্ষদের মধ্যে ব্যবসায়িক লেনদেন ফৌজদারি দায় নাকি দেওয়ানি দায় হবে তা নির্ভর করবে কী ধরনের অভিযোগ করা হয়েছে তার উপর। চার্জ গঠনের সময় যদি অভিযোগ থেকে সুস্পষ্টভাবে বোঝা না যায় যে, পক্ষদের মধ্যে ব্যবসায়িক লেনদেন ছিল কি না, তাহলে আদালত চার্জ গঠন করবে এবং বিচারের সময় সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত দেবে।
তবে, কোনো ক্ষেত্রে কোনো আইনে প্রতিকার পাওয়া যাবে বা কোনো ক্ষেত্রে কোনো প্রতিকারই পাওয়া যায় না। সে বিষয়ে টাকা দেয়ার আগে আমাদের মতো আমজনতা কমই ভাবেন। আর ভাবলেইবা কী! সবাই তো আইন জানবে না। এ বিষয়ে খবর রাখা দরকার, আদালতে মোকদ্দমা দায়ের করে প্রতিকারের বিধান আছে। সব রকমের আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে সচেতন হওয়া উচিত এবং লেনদেন করার সময় অন্তত দুজন সাক্ষীর উপস্থিতিতে লিখিত চুক্তি সম্পাদন করে রাখা উচিত।
লেখক: আইনজীবী, কলাম লেখক