ঊনবিংশ শতকের প্রথমার্ধ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দামামা বাজিয়ে হিংসায় উন্মত্ত পৃথিবী। বেশিরভাগ দেশই বিধ্বংসী যুদ্ধের ভয়ংকর খেলায় প্রমত্ত। হত্যা আর ধ্বংসের উন্মাদনার ভেতরই ১৯১৮ সালের মার্চ-এপ্রিলে সেনা ছাউনিগুলোতে হঠাৎ বিভীষিকাময় এক রোগের আবির্ভাব হয়। সৈন্যরা শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা, জ্বর, শ্বাসকষ্টসহ তীব্র নিউমোনিয়ার লক্ষণ নিয়ে আক্রান্ত হওয়ার তিনদিনের ভেতরে ফুসফুসে রক্তপাত হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। রোগটি দ্রুতই পৃথিবীর আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়ে।সেইসময় যুদ্ধাবস্থা থাকায় যুদ্ধের গতি প্রকৃতি বাধাগ্রস্ত হতে পারে বিধায় যুদ্ধে লিপ্ত দেশগুলো চায়নি রোগটি ছড়িয়ে পড়ার ভয়ানক খবর প্রচারিত হোক। তাই রোগের তথ্য উপাত্তগুলো প্রায় সব দেশই লুকাতো। সে কারণে প্রথমদিকে ফ্লুয়ের মতো রোগটির খবর গোপনই থেকে গিয়েছিল।যুদ্ধের ডামাডোলের বাইরে থাকায় স্পেনই একমাত্র দেশ, যেখানে স্বাধীন সাংবাদিকতার কারণে স্বাভাবিক ও মুক্ত খবর প্রচার হচ্ছিল। আর সে কারণেই স্পেনের সংবাদ মাধ্যমে রোগটির ভয়ংকর সংক্রমণের খবর দ্রুতই প্রচারিত হতে থাকলো। এমনকি স্পেনের রাজা ত্রয়োদশ আলফান্সো এবং তার মন্ত্রিসভার সদস্যদের আক্রান্ত হওয়ার খবরও প্রচারিত হয়েছিল। স্পেন থেকেই প্রথম এবং অবাধ প্রচারের কারণেই বিশ্ববাসীর কাছে রোগটির নাম হয়ে যায় ‘স্প্যানিশ ফ্লু’।দুই বছর দীর্ঘস্থায়ী রোগটি সংক্রমিত করেছিল পৃথিবীর প্রায় এক তৃতীয়াংশ অর্থাৎ ৫০ কোটি মানুষকে। মৃত্যু হয়েছিল ৫ কোটিরও বেশি মানুষের। সংক্রমণের তীব্রতা আর মৃত্যুর নিরিখে এখনও পর্যন্ত পৃথিবীতে মহামারি হিসেবে ‘স্প্যানিশ ফ্লু’ সবচেয়ে ভয়ংকর বিবেচিত।মহামারিটির উৎপত্তি ঠিক কোথা থেকে হয়েছিল তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। ভিন্ন ভিন্ন সূত্রমতে আমেরিকা, ইউরোপ মতান্তরে চীন থেকেই প্রথম ছড়িয়েছে রোগটি; বিশ্বযুদ্ধের কারণে এক দেশের সৈন্যদের অন্যদেশে ব্যাপক যাতায়াত ছিল বিধায়।তখনও হাত ধোয়া আর মাস্ক পরাই ছিল মহামারি নিয়ন্ত্রণের কার্যকর পন্থা। ছিল মুখোশের আড়ালে অবসাদ আর উদ্বিগ্নতায় পরিশ্রান্ত জীবন, অবরুদ্ধ এলাকা, মানুষে মানুষে বিচ্ছিন্নতা, সামাজিক বা শারীরিক দূরত্ব, আইসোলেশন, কোয়ারেন্টাইন আর লকডাউন।ঠিক যেন করোনাকালের প্রতিচ্ছবি।এটা এমন এক আঘাত যার ফলে জীবনাচরণের সঙ্গে আমূল পরিবর্তন ঘটছে সমাজ-অর্থনীতি, সাহিত্য ও শিল্পের গতিপ্রকৃতিতে। প্রভাব ফেলছে মন মনন আর সংস্কৃতিতে। তখনকার মতো এখনও আর হাতে হাত মেলাই না, মুখোমুখি হই না, সশরীরে কাউকে স্বাগত জানাই না। ঠিক একশ বছর আগে যা যা ঘটেছিল; সেই শব্দগুচ্ছ, সেই দৃশ্যকল্প! কোভিড-১৯ যেন ‘স্প্যানিশ ফ্লু’র দ্বিতীয় আবির্ভাব!তখনও অর্থনীতি অচল হয়ে পড়েছিল। ব্যাংকসমূহে দেখা দিয়েছিল মহাতারল্য সংকট। কোম্পানিগুলো দেউলিয়া ঘোষণা করেছিল। আক্রান্ত দেশগুলোতে শোনা গিয়েছিল নেতৃবৃন্দের ফাঁকা বুলি ও নিরর্থক আশ্বস্ত বাণী, যা ছিল হাসপাতালের রোগী আর মৃতের মিছিলের সঙ্গে সম্পূর্ণ সংগতিহীন।চলমান বিশ্বযুদ্ধের ভেতর স্প্যানিশ ফ্লু হানা দিলেও বোধোদয় হয়নি মহা শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর। বরং বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির ফলে আরও অধিক মারণাস্ত্রে সমৃদ্ধ হয়েছে পৃথিবীর অস্ত্রভাণ্ডারগুলো। এর কিয়দংশ অর্থও যদি শান্তির জন্য, চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত হতো, তাহলে এ পৃথিবী মানুষ, প্রাণ ও প্রকৃতির জন্য অনেক নিরাপদ আশ্রয় হতো। তা হয়নি, বরং দিনে দিনে তা হয়েছে অধিকতর অনিরাপদ আর শ্বাপদসংকুল।করোনা মহামারির ঠিক এ মুহূর্তে প্রতিদিনই পরিবর্তিত নতুন বাস্তবতা আমাদের চিন্তার জগৎকে ক্রমেই পরিবর্তিত করছে। প্রযুক্তির কল্যাণে এবার দ্রুতগতিতে তথ্য প্রবহমান। সেখানে সত্যের সঙ্গে যেমন মিথ্যার যোগ আছে, তেমনি বিশ্বাসের সঙ্গে অবিশ্বাসেরও। যার ধাক্কা লাগছে বৈশ্বিক রাজনীতিতে, ভেঙে পড়া অর্থনীতিতে, উত্তপ্ত সমরনীতিতে, দেশে দেশে সম্পর্কে। প্রতি মুহূর্তে নতুন তথ্যের সন্নিবেশ ঘটছে, আর আমাদের জীবন আরও কঠিন থেকে কঠিনতর বাস্তবতার দিকে এগোচ্ছে। এ যেন অনিশ্চিত পথে অন্তহীন যাত্রা। অদ্ভুতভাবে চিরপরিচিত জগৎকে পাল্টে দেয়ার চ্যালেঞ্জ নিয়ে তীব্রভাবে আঘাত করে যাচ্ছে আমাদের প্রাত্যহিক জীবনপ্রবাহে।কোভিড-১৯ এর ফলে পৃথিবীব্যাপী স্বল্প আয়ের সাধারণ, অতি সাধারণ ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ওপর নেমে এসেছে মহাদুর্যোগ। কর্মহীন, আয়বঞ্চিত ও ক্ষুধাপীড়িত মানুষের জন্য সৃষ্টি হয়েছে মারাত্মক বিপর্যয়। জাতিসংঘের হিসাব বলছে, এই বিপর্যয় প্রলম্বিত হবে। জাতিসংঘের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০১৯ সালের যেখানে কাজ হারিয়েছিলেন ১৮৭ মিলিয়ন মানুষ, সেখানে করোনা এবং অন্যান্য প্রভাবে ২০২২ সালে ২০৫ মিলিয়ন মানুষ কাজ হারাবেন।জাতিসংঘের ধারণা, ২০২৩ সালের আগে বাজার চাঙা হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। অর্থাৎ, ওই সময় পর্যন্ত নতুন চাকরির বাজার তৈরি হবে না। হার কমলেও, চাকরি হারাতেই থাকবেন অসংখ্য মানুষ। বাড়বে বেকারত্ব; এবং একই সঙ্গে বাড়বে দারিদ্র্য।করোনাভাইরাসে এ পর্যন্ত সংক্রমণ ছড়িয়েছে ১৮ কোটির বেশি, মৃতের সংখ্যাও ৪০ লাখ পেরিয়েছে। এখনও প্রতিদিন প্রায় চার লাখের মতো মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। করোনাভাইরাসের ব্যাপ্তি স্প্যানিশ ফ্লু-এর চেয়ে অনেক বেশি হলেও তুলনামূলক মৃত্যুর হার স্প্যানিশ ফ্লু-এর চেয়ে কম। সুস্থও হয়ে উঠেছে ইতোমধ্যে ৯২% মানুষ। ইতিহাসের স্বল্পতম সময়ে ভ্যাকসিন আবিষ্কারের ফলে পৃথিবীব্যাপী মোটামুটি কার্যকর চিকিৎসা ব্যবস্থার কারণে দৃশ্যমান অগ্রগতিতে আশাবাদী পৃথিবীবাসী। যদিও করোনার ভিন্ন ভিন্ন ভেরিয়েন্টকে বাগে আনতে বেগ পেতে হচ্ছে। তবে কোভিড-১৯ চিহ্নিতও হয়েছে দ্রুততম সময়ে, স্প্যানিশ ফ্লু-এর ক্ষেত্রে যার সময় লেগেছিল ১৫ বছর।মহামারি শেষ হলেও রয়ে যাবে এর নির্মমতার দুঃসহ অভিজ্ঞতা। যারা বেঁচে যাবে তাদের বোধে-স্মৃতিতে, শরীর-মনে অসহায় বিপর্যস্ত এক পৃথিবীর ছবি আমৃত্যু তাড়া করবে।গেল দেড় বছর থেকে যে ‘নিউ নর্মাল’ পৃথিবীতে আমরা বাস করছি, সেটি একটি বিকল্প ব্যবস্থা। বিকল্প কখনও স্বাভাবিক স্বতঃস্ফূর্ত হতে পারে না। ভার্চুয়াল ভালোবাসায় প্রাণের চেয়ে ভান বেশি। ভার্চুয়াল কান্না-হাসিতে নিবিড় বেদনার পুলক নেই, আছে নিয়ন্ত্রিত মাপজোকের কৌণিক বিস্তার। আমরা প্রকৃতির কাছে যেতে চাই, প্রিয় মানুষের কাছে যেতে চাই, জড়িয়ে ধরতে চাই, ছুঁয়ে দিয়ে আদর করতে চাই, মুখোমুখি বসে আড্ডা দিতে চাই। ঘুরে বেড়াতে চাই খোলা হাওয়ায়, প্রিয় মানুষের চোখের জল মুছে দিতে চাই গ্লাভস পরা নয়, নিজের রক্ত মাংসের হাত দিয়ে।স্প্যানিশ ফ্লু হঠাৎ এসে দুই বছরের মাথায় যেমন হঠাৎ-ই বিদায় নিয়েছিল, এবারও যেন ঠিক তাই হয়। মহামারির ইতিহাস সেকথাই বলে। হয়তো অনেক প্রাণের বিনিময়ে কোভিডও একদিন সিজনাল ফ্লুতে পরিণত হবে। আবার হয়তো অর্থনীতির পুরাতন ক্ষেতে নতুন শস্য বপন করতে হবে। তবুও নিউ নর্মালের নামে এবনর্মাল নয়, একেবারে হৃষ্টপুষ্ট বিশুদ্ধ আলোকিত পৃথিবী চাই । অপেক্ষায় আছি সেই সূর্যোদয় দেখার। লেখক: প্রাবন্ধিক-শিক্ষক ও কলাম লেখক
বিশুদ্ধ পৃথিবীর অপেক্ষায়
স্প্যানিশ ফ্লু হঠাৎ এসে দুই বছরের মাথায় যেমন হঠাৎ-ই বিদায় নিয়েছিল, এবারও যেন ঠিক তাই হয়। মহামারির ইতিহাস সেকথাই বলে। হয়তো অনেক প্রাণের বিনিময়ে কোভিডও একদিন সিজনাল ফ্লুতে পরিণত হবে। আবার হয়তো অর্থনীতির পুরাতন ক্ষেতে নতুন শস্য বপন করতে হবে।
-
ট্যাগ:
- মতামত
এ বিভাগের আরো খবর/p>