বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

ডিজিটাল আইন: সাংবাদিকরাই কি টার্গেট

  •    
  • ১৩ জুলাই, ২০২১ ১১:০৮

অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এটি এখন আর ডিজিটাল নিরাপত্তা নয়, বরং গণমাধ্যমকর্মী নিয়ন্ত্রণ আইনে পরিণত হয়েছে—যার সবশেষ ভিকটিম ঠাকুরগাঁওয়ের সাংবাদিক তানভীর হাসান তানু। শুধু গ্রেপ্তার নয়, হাতকড়া পরা অবস্থায় হাসপাতালের বিছানায় তার শুয়ে থাকার একটি ছবিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে। তার অপরাধ, তিনি হাসপাতালে খাবার সরবরাহের দুর্নীতির রিপোর্ট করেছেন। দুর্নীতির রিপোর্ট করলেও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়—এ এক আজব কাণ্ড!

সম্ভবত দেশের আর কোনো আইন নিয়ে এত সমালোচনা হয়নি, যা হয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে। কিন্তু তারপরও এই আইনে গণমাধ্যমকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলার প্রবণতা বন্ধ হচ্ছে না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এটি এখন আর ডিজিটাল নিরাপত্তা নয়, বরং গণমাধ্যমকর্মী নিয়ন্ত্রণ আইনে পরিণত হয়েছে—যার সবশেষ ভিকটিম ঠাকুরগাঁওয়ের সাংবাদিক তানভীর হাসান তানু। শুধু গ্রেপ্তার নয়, হাতকড়া পরা অবস্থায় হাসপাতালের বিছানায় তার শুয়ে থাকার একটি ছবিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে। তার অপরাধ, তিনি হাসপাতালে খাবার সরবরাহের দুর্নীতির রিপোর্ট করেছেন। দুর্নীতির রিপোর্ট করলেও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়—এ এক আজব কাণ্ড!

এই আইনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, ডিজিটাল নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং ডিজিটাল মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধ শনাক্তকরণ, প্রতিরোধ, দমন, বিচার ও আনুষঙ্গিক বিষয়াদি সম্পর্কে বিধান প্রণয়ন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, একজন সাংবাদিকের রিপোর্ট কী করে ডিজিটাল মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধের মধ্যে পড়ে এবং এই রিপোর্টের বিরুদ্ধে কী করে এই আইনে মামলা হয়? পুলিশ কী করে এই মামলা গ্রহণ করে এবং একজন সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়, সেই প্রশ্নইবা কে কাকে করবে?

২০১৮ সালে যখন এই আইনটি পাস হয়, তখন সরকারের তরফে বার বার বলা হয়েছিল যে, আইনটি সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হবে না। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই আইনটি সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে ফেসবুক পোস্ট এবং সাংবাদিকদের বিরুদ্ধেই।

গত ৩০ জুন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের বরাত দিয়ে একটি অনলাইন নিউজ পোর্টালের খবরে বলা হয়, ২০২০ সাল থেকে চলতি বছরের মে পর্যন্ত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সবচেয়ে বেশি অভিযোগ পড়েছে ফেসবুক পোস্টের কারণে।

গত বছর এ সংখ্যা ছিল ৬৪। আর এ বছর মে পর্যন্ত সেটি দাঁড়িয়েছে ৬০টিতে। পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের বরাতে ওই খবরে বলা হয়, ২০২০ সালে ৭০ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত মামলা হয় ১৬টি। অপরদিকে যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংস্থা আর্টিকেল ১৯-এর বরাতে একটি জাতীয় দৈনিকের সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, ২০২০ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ১৯৮টি মামলায় ৪৫৭ জনকে বিচারের আওতায় আনা ও গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এই ৪৫৭ জনের মধ্যে ৭৫ জন সাংবাদিক। এমনকি করোনাকালেও অনেক সাংবাদিককে এ আইনে মামলা দিয়ে হয়রানি ও গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।

স্মরণ করা যেতে পারে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি প্রণয়নের সময়ই সাংবাদিক সমাজের তরফে এর বেশ কয়েকটি ধারার বিষয়ে তীব্র আপত্তি জানানো হয়। তখন আইনমন্ত্রী ও তথ্যমন্ত্রী বার বার এই আশ্বাস দিয়েছিলেন যে, এ আইন করা হচ্ছে ডিজিটাল দুনিয়ায় নাগরিকের নিরাপত্তার স্বার্থে। কোনোভাবেই এটি গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করার জন্য নয়। অথচ এই আইনে এ পর্যন্ত যতগুলো মামলা হয়েছে, তার একটি বড় অংশেরই আসামি সাংবাদিক এবং তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে সংবাদ প্রকাশ এবং সেই সংবাদ ডিজিটাল প্লাটফর্মে ছড়িয়ে দেয়ার ফলে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির কথিত মানহানির অভিযোগে। অনেক ক্ষেত্রেই মামলা করেছেন তৃতীয়পক্ষ। অর্থাৎ যার মানহানি হয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে, তার পক্ষে অন্য কেউ মামলা করেছেন।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের এটি একটি জাদুকরি শক্তি যে, সংবাদে ক্ষুব্ধ হয়ে সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিকের বিরুদ্ধেও এই আইনে মামলা করা যায়, শুধু অনলাইন প্লাটফর্মে খবরটি ছড়ানোর অভিযোগে। অথচ কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী সংবাদে সংক্ষুব্ধ হলে তার প্রতিকারের প্রথম উপায় হচ্ছে সংশ্লিষ্ট গণমাধ্যমে প্রতিবাদ পাঠানো। এরকম আরও অনেক ধাপ আছে। কিন্তু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন হওয়ার পরে প্রভাবশালীরা এখন আর সেসব প্রক্রিয়া অনুসরণের ধারে কাছে না গিয়ে বরং সরাসরি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করে দিচ্ছেন। কারণ এই আইন অন্য যেকোনো আইনের তুলনায় অনেক বেশি শক্তিশালী এবং এই আইনে মামলা হওয়ার পরে দ্রুততম সময়ের মধ্যে আসামিকে গ্রেপ্তার করে জেলহাজতে পাঠিয়ে দেয়া সম্ভব। সংশ্লিষ্ট পত্রিকা বা টেলিভিশনে প্রতিবাদ পাঠিয়ে এই সুবিধা পাওয়া যায় না।

সবশেষ দৈনিক ইত্তেফাক ও ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধি তানভীর হাসান তানুর বিরুদ্ধে এই আইনে দায়ের করা মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি সদর হাসপাতালে করোনা রোগীদের জন্য সরবরাহ করা খাবারের মান নিয়ে যে খবর পরিবেশন করেছেন, সেটি মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। এই রিপোর্টের কারণে নাকি হাসপাতালের ‘মানহানি’ করা হয়েছে। কী অদ্ভুত অভিযোগ! হাসপাতাল একটি জড় পদার্থ। তারও আবার মান! তারও চেয়ে বড় প্রশ্ন, জনগণের করের পয়সায় পরিচালিত একটি সরকারি হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক কী করে একটি রিপোর্টকে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন দাবি করে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলার সাহস পেলেন?

দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোয় রোগীদের জন্য কী খাবার সরবরাহ করা হয়, তা কি মানুষ জানে না? সেই খাবার যে অধিকাংশ রোগীই খান না, বরং সেটি হাসপাতালের আয়াদের দিয়ে দেন, এটিও নির্মম সত্য। সুতরাং এরকম একটি সর্বজনজ্ঞাত বিষয়ে রিপোর্ট করলে তার বিরুদ্ধে কী করে ডিজিটাল আইনে মামলা হয়? বরং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উচিত ছিল ওই রিপোর্টকে আমলে নিয়ে ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে দেখা যে আসলেই রোগীদের জন্য খাবারের মান খারাপ কি না? সেটি না করে উল্টো সত্য বলার অপরাধে একজন সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করা হলো। তার মানে কি এই যে, কোনো অন্যায় অনিয়মের বিরুদ্ধে গণমাধ্যম কথা বলতে পারবে না?

উল্লেখ্য, যেসব কারণকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রণয়নের উদ্দেশ্য হিসেবে দাবি করা হয়েছিল, তার মধ্যে অন্যতম ডিজিটাল মাধ্যমে পর্নোগ্রাফি প্রতিরোধ। সুতরাং এই আইনে এ পর্যন্ত পর্নোগ্রাফি প্রতিরোধে কতগুলো মামলা হয়েছে আর ফেসবুকে পোস্ট দেয়া এবং অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে খবর প্রকাশ করার কথিত মানহানির অভিযোগে কতগুলো মামলা হয়েছে—তার একটি পরিসংখ্যান পাওয়া গেলে এই আইনের উদ্দেশ্য পরিষ্কার হবে।

বস্তুত, ইন্টারনেটে ব্যক্তির সম্মানহানি এবং পর্নোগ্রাফি প্রতিরোধের কথা বলে এই আইন করা হলেও যখন এর দ্বারা যে নাগরিক ও গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করা হয়, তখন এর উদ্দেশ্য প্রশ্নবিদ্ধ হয়। তাছাড়া ক্ষমতাবান ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সম্পর্কে কোনো ধরনের সমালোচনা এমনকি রসিকতাও যে রাষ্ট্র সহ্য করবে না, এই আইন সেই বার্তাটিও সুস্পষ্টভাবে দিয়েছে। অর্থাৎ উদ্দেশ্য হিসেবে যা-ই লেখা হোক না কেন, এরকম আইন মূলত রাষ্ট্রের ক্ষমতাকাঠামোকেই শক্তিশালী করে। নাগরিকরা যাতে খোলামেলাভাবে কিছু লিখতে না পারে, ক্ষমতাবানদের সমালোচনা করতে না পারে, সেরকম একটি কুসুমাস্তীর্ণ পথ তৈরি করাই হয়তো এই আইনের অলিখিত উদ্দেশ্য।

আমাদের সমাজে ক্রসফায়ার বা বিনাবিচারে হত্যার পক্ষেও জনমত আছে। কারণ হিসেবে বলা হয়, বড় অপরাধীদের বিরুদ্ধে সাক্ষী পাওয়া যায় না, বিচারিক প্রক্রিয়া ধীর বা দুর্বল ইত্যাদি। এসব বলে মূলত বিনাবিচারে হত্যাকে জায়েজ করা হয়। অথচ কেন সাক্ষী পাওয়া যায় না; কেন সাক্ষী সুরক্ষা আইন নেই; কেন আইনশৃঙ্খলাবাহিনী নিরপেক্ষ তদন্ত রিপোর্ট দেয় না বা দিতে পারে না; বিচারিক প্রক্রিয়ার দুর্বলতাগুলো কেন কাটানো হয় না—এসব প্রশ্ন তোলা হয় না। বরং নাগরিকরা এসব প্রশ্ন যাতে তুলতে না পারে, সেজন্যই হয়তো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। যে কারণে একজন সাংবাদিকও যখন কোনো অনিয়ম বা দুর্নীতি নিয়ে রিপোর্ট করেন, তখন তার বিরুদ্ধে সরাসরি এই আইনে মামলা দিয়ে তাকে দ্রুততম সময়ে গ্রেপ্তার করা হয়।

এই আইনে এ যাবৎ যতগুলো মামলা হয়েছে, তার অধিকাংশই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কোনো বক্তব্য, মতামত অথবা সংবাদমাধ্যমে কোনো খবর প্রকাশের ফলে কোনো না কোনো ক্ষমতাবান ব্যক্তির কথিত মানহানির অভিযোগে। অথচ মানহানির প্রতিকার পাওয়ার জন্য দেশের প্রচলিত দণ্ডবিধিতেই (৪৯৯ ধারা) বিধান রয়েছে। তাহলে কারো মানহানি হলে তিনি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করছেন কেন? এই আইনটি বেশি শক্তিশালী এবং অধিকতর ভীতিসঞ্চারী বলে? দণ্ডবিধির ৪৯৯ ধারায় মানহানি মামলা করলে পুলিশ তৎক্ষণাত কাউকে গ্রেপ্তার করে না বা আদালত সহজে জামিন দিয়ে দেন বলে? আবার যার মানহানি হয়, যদি তিনি জীবিত হন তাহলে মামলা করার কথা তার নিজের।

কোনো মৃত ব্যক্তির মানহানি হলে তার পক্ষে অন্য কেউ মামলা করতে পারেন। অথচ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এ যাবৎ যতগুলো মামলা হয়েছে, অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে, তার বাদী সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি নিজে নন; বরং তার পক্ষে অন্য কেউ মামলা করেছেন? অর্থাৎ এখানে শুধু মামলা করাই নয়; বরং ক্ষমতা দেখানো এবং কে কার পক্ষের, কোন দলের ও কোন নেতার কতটা ডেডিকেটেড কর্মী—সেটি দেখানোরও একটা বিষয় কাজ করে। অস্বীকার করার উপায় নেই, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এ যাবৎ যেসব অভিযোগে মামলা হয়েছে, তার অধিকাংশই দুর্বল; কিন্তু এসব দুর্বল অভিযোগে পুলিশ কেন মামলা নেয় এবং অন্য যেকোনো আইনে দায়েরকৃত মামলার তুলনায় দ্রুততম সময়ে কেন আসামিকে গ্রেপ্তার করে, তাও খতিয়ে দেখা দরকার।

লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।

এ বিভাগের আরো খবর