বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

পুলিশ হেফাজতে নারীর নিরাপত্তা প্রশ্নবিদ্ধ কেন

  •    
  • ১১ জুলাই, ২০২১ ১২:১৮

ফৌজদারি কার্যবিধির (সিআরপিসি) ১৬৭ ধারা আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীকে রিমান্ডের সময় নির্যাতনের অনুমোদন দেয়। এ বিধানের বিরুদ্ধে ২০০৩ সালের ৭ এপ্রিল হাইকোর্ট ১৫ দফার একটি নির্দেশনা দেন। তৎকালীন সরকার একই বছরের ২ আগস্ট হাইকোর্টের এ রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করে। দীর্ঘ ১৩ বছর পর, ২০১৬ সালের ২৪ মে, পুলিশ হেফাজতে নিয়ে নির্যাতনের বিষয়ে কিছু নির্দেশিকার মাধ্যমে হাইকোর্টের নির্দেশকে বহাল রেখে রায় দেন সর্বোচ্চ আদালত (দি ডেইলি স্টার)। কিন্তু, বরিশালের ঘটনায় বোঝা যাচ্ছে, পুলিশ প্রতিনিয়তই এসব নির্দেশনা উপেক্ষা করছে।

দিনাজপুরের ইয়াসমিনের কথা মনে আছে আমাদের? ১৯৯৫ সালের ২৪ আগস্ট ইয়াসমিনকে পুলিশি হেফাজতে ধর্ষণ ও হত্যা করা হয়। দেশের ইতিহাসে জঘন্যতম বর্বরোচিত এই ঘটনার পর থেকে এই দিনটি ‘নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। প্রতিবাদ-বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিল দেশের মানুষ। ইয়াসমিন হত্যা মামলায় ২০০৪ সালে ৩ পুলিশ সদস্যকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়।

এরপর অনেক বছর পার হয়ে গেছে, দেশ-সমাজ আধুনিক হয়েছে, দেশে নানারকমের উন্নতি হয়েছে কিন্তু এখনও অভিযুক্ত নারী আসামিকে রিমান্ডে নিয়ে শারীরিক ও যৌন নির্যাতন করা হয়। যেখানে একজন নারী পুলিশি হেফাজতে নিরাপদ থাকতে পারেন না, সেখানে আমরা কীভাবে বলব যে আমরা সভ্য হয়ে উঠেছি। দেশে মডেল থানা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, দেশে আইন আছে যে যৌন নিপীড়ন শাস্তিযোগ্য অপরাধ। অথচ এরপরেও অভিযুক্ত নারী আসামিকে এরমধ্যে দিয়েই যেতে হচ্ছে। সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার সেই ২৫ বছর আগে ইয়াসমিনের ঘটনা নিয়ে আমরা যতটা জেগে উঠেছিলাম, আজ কিন্তু কোথাও কোনো প্রতিবাদও চোখে পড়ছে না।

অবশ্য বরিশালের উজিরপুর উপজেলায় হত্যামামলায় গ্রেপ্তার এক নারীকে (৩০) রিমান্ডে যৌন ও শারীরিক নির্যাতনের অভিযোগ তদন্তে পুলিশের পক্ষ থেকে দুই সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। অভিযুক্ত নারী জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে অভিযোগ করেন, দুই দিনের পুলিশ রিমান্ডে থাকাকালে তিনি যৌন ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।

বিচারক নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন অনুযায়ী তার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে নির্যাতনের চিহ্ন ও নির্যাতনের সম্ভাব্য সময় উল্লেখ করে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে প্রতিবেদন দিতে শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালককে নির্দেশ দিয়েছিলেন। ওই নারী আসামির শরীরের বিভিন্ন স্থানে শক্ত কিছু দিয়ে পেটানো হয়েছে বলে চিকিৎসকেরা রিপোর্টে মন্তব্য করেছেন।

জাতিসংঘের নির্যাতনবিরোধী সনদে স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ এই নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন আইনটি প্রণয়ন করে। এই আইন অনুযায়ী কেউ নির্যাতনের শিকার হলে আদালতে অভিযোগ করতে পারেন। শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতন প্রমাণিত হলে শাস্তি হিসেবে ন্যূনতম ৫ বছরের কারাদণ্ড অথবা ৫০ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। এছাড়া নির্যাতনের ফলে মারা গেলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড অথবা অর্থদণ্ড হতে পারে।

বরিশালে আসামি নারীকে নির্যাতনের এই অভিযোগ গুরুতর। আদালতের নির্দেশনার বিপরীতে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ বা রিমান্ডের সময় নির্যাতন করা হচ্ছে। এই ধারাটি যেন একটি স্বাভাবিক ও অলিখিতভাবে স্বীকৃত বিষয় হয়ে গেছে। ফৌজদারি কার্যবিধির (সিআরপিসি) ১৬৭ ধারা আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীকে রিমান্ডের সময় নির্যাতনের অনুমোদন দেয়। এ বিধানের বিরুদ্ধে ২০০৩ সালের ৭ এপ্রিল হাইকোর্ট ১৫ দফার একটি নির্দেশনা দেন। তৎকালীন সরকার একই বছরের ২ আগস্ট হাইকোর্টের এ রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করে। দীর্ঘ ১৩ বছর পর, ২০১৬ সালের ২৪ মে, পুলিশ হেফাজতে নিয়ে নির্যাতনের বিষয়ে কিছু নির্দেশিকার মাধ্যমে হাইকোর্টের নির্দেশকে বহাল রেখে রায় দেন সর্বোচ্চ আদালত (দি ডেইলি স্টার)। কিন্তু, বরিশালের ঘটনায় বোঝা যাচ্ছে, পুলিশ প্রতিনিয়তই এসব নির্দেশনা উপেক্ষা করছে।

নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন, ২০১৩ মুখবন্ধে মনে করিয়ে দেয়া হয়েছে যে আমাদের সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদে নির্যাতন এবং নিষ্ঠুর, অমানবিক, লাঞ্ছনাকর ব্যবহার ও দণ্ড মৌলিকভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অর্থাৎ বাংলাদেশে কোনো ব্যক্তিকে নির্যাতন, নিষ্ঠুর ও অমানবিক শাস্তি দেয়া যাবেই না, এমনকি সেরকম কোনো আচরণও করা যাবে না।

আইনটির মুখবন্ধে আরও আছে যে বাংলাদেশ জাতিসংঘের ১৯৮৪ সালে গৃহীত নির্যাতন এবং অন্যান্য নিষ্ঠুর, অমানবিক, লাঞ্ছনাকর ব্যবহার বা নির্যাতনবিরোধী সনদের একজন অংশীরাষ্ট্র। অর্থাৎ আমাদের সংবিধান এবং জাতিসংঘের এই সনদের বাস্তবায়নের জন্য নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন, ২০১৩ প্রণয়ন করা হয়েছে (প্রথম আলো)।

বাংলাদেশে পুলিশ হেফাজতে নির্যাতন প্রতিরোধে এই আইনটি ২০১৩ সালে প্রণয়ণ করা হলেও, এর প্রয়োগ তেমন নেই। এই আইনের অধীনে ভুক্তভোগীরা নিরাপত্তা হেফাজতে শারীরিক এমনকি মানসিক নির্যাতনেরও বিচার চাইতে পারেন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এ আইন সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা কম। কারণ এই আইন নিয়ে তেমন কোনো প্রচার-প্রচারণাও নেই। অপরদিকে, এই আইনটির সংস্কার এমনকি বাতিলের দাবি উঠেছিল পুলিশের পক্ষ থেকে।

২০১৮ সালে স্টার উইকেন্ডের একটি প্রতিবেদনে রিমান্ডে নির্যাতনের অনেক প্রমাণ তুলে ধরে বলা হয়েছিল, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিয়মিতই এ চর্চা চালায়। আজকে আমরা যদি পুলিশি হেফাজতে নির্যাতনের সার্বিক চিত্র নিয়ে আলোচনা না-ও করি, কিন্তু বরিশালে আসামি নারীর ওপর নিপীড়নের অভিযোগ প্রমাণ করে যে, নারী অপরাধীদের জন্য রিমান্ড একটি নরক হতে পারে।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার সারা হোসেন গণমাধ্যমে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন ‘দোষী প্রমাণিত হোক বা না হোক, হেফাজতে থাকা যেকোনো ব্যক্তিরই নির্যাতন থেকে রক্ষা পাওয়ার অধিকার আছে। পুলিশকে আদালতের দেয়া নির্দেশনা ও আইন অবশ্যই মেনে চলতে হবে।’

আটকের পর পুলিশি হেফাজতে থাকার সময় নারীদের কীভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় তা নিয়ে এর আগেও অনেকেই নানা প্রশ্ন তুলেছেন। আমরা মনে করি জিজ্ঞাসাবাদ ও পাহারার সময় নারী পুলিশ সদস্য থাকা বাধ্যতামূলক করা উচিত। শোনা যায়, নারী অভিযুক্ত হলে তাকে অনেক ধরনের বাজে মন্তব্য শুনতে হয়। জিজ্ঞাসাবাদের সময় যে হয়রানি করা হয়, সেই অভিযোগও ছিল। বরিশালের এই অভিযোগের মাধ্যমে এর সত্যতা পাওয়া গেল।

সবধরনের অভিযোগের ক্ষেত্রেই নারীদের চরিত্র নিয়ে কথা শুনতে হয়। ধর্ষণ মামলার বাদী হলেও নারীকে রেহাই দেয়া হয় না। মেয়েটি যে ধর্ষণ বা যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন, এর জন্য প্রকারান্তরে তাকেই দায়ী করা হয়, তার প্রতি অশ্লীল ইঙ্গিত করা হয়। এরকম ঘটনার কথা আমরা জানি। সোশ্যাল মিডিয়াতে ভাইরাল হতেও দেখেছি যে নারীকে কীভাবে প্রশ্ন করা হয়।

আসামি হলেও তার মানবাধিকার রক্ষা করতে হবে। নারী অপরাধী হলেও তার সম্মান রক্ষা করতে হবে। নারী অপরাধীকে নিয়ে হাসাহাসি, কটাক্ষ এবং গায়ে হাত তোলা আইনত নিষিদ্ধ। তার কাছ থেকে কথা আদায় করার জন্য মারধর বা যৌন হয়রানি করা ছাড়া কি আর কোনো উপায় নেই?

মানবাধিকার ও নারী সংগঠনের নেত্রীরা অভিযুক্ত নারী আসামির ভালো ব্যবহার পাওয়া প্রসঙ্গে বার বার বলেন যে, একজন নারীকে যখন রিমান্ডে নেয়া হবে তখন সেখানে একজন নারী পুলিশকে থাকতে হবে সবসময়। এ কথা আইনেও বলা আছে। কিন্তু বরিশালের এই নারী অভিযোগ করেছেন যে, তাকে অত্যাচার করার সময় সেখানে নারী পুলিশ উপস্থিত ছিলেন। কাজেই নারী পুলিশ থাকলেও খুব একটা নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু এরপরও নারী আসামির সঙ্গে সার্বক্ষণিক নারী পুলিশ বাধ্যতামূলক করা উচিত।

রিমান্ডে নেয়ার কথা শুনলে কুখ্যাত অপরাধীরা পর্যন্ত ভয় পেয়ে যায়, সেখানে সাধারণ মানুষের অবস্থা কী হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। নারী নেত্রী খুশি কবীর গণমাধ্যমকে বলেছেন ‘একজন নারী যখন রিমান্ডে থাকবেন। আর যে ঘরে তাকে রাখা হবে সেখানে আলাদা টয়লেটের ব্যবস্থা থাকবে। অথচ অনেকের কাছ থেকে আমি শুনতে পাই- এ ব্যবস্থা রাখা হয় না। যারা এ পর্যন্ত রিমান্ডে গেছেন, তারা ফিরে এসে এসব জানিয়েছেন।’

বরিশালের পুলিশ সুপার (এসপি) বলেছেন, অভিযোগ সত্য বলে প্রমাণিত হলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। আমরা আশা করছি নিজেদের ভাবমূর্তি বজায় রাখার জন্য পুলিশ দ্রুত এ ব্যাপারে একটি পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করবে। প্রয়োজনে আইনজীবী, শিক্ষক, জেন্ডার বিশেষজ্ঞ, নারী অধিকারকর্মী ও সিভিল সোসাইটির প্রতিনিধি রেখে একটি কমিটি গঠন করবে। অভিযোগ সত্য প্রমাণিত হলে দোষীদের শাস্তির আওতায় নিয়ে আসতেই হবে।

দেশের সব আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী সংস্থাকে অবশ্যই সাংবিধানিক নির্দেশনা ও আদালতের নির্দেশনা মেনে চলতে হবে এবং হেফাজতে নির্যাতন বন্ধ করতে হবে। যারা থানায় যান বা যাদের যেতে হয় তারা কিন্তু সবাই অপরাধী নন। আর অপরাধী হলেও ভালো আচরণ পাওয়ার অধিকার তার আছে। দেশের মানুষ নানা কারণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার দ্বারস্থ হয়। কিন্তু সেখানে যদি আইনি সুবিচার না পায়, নির্যাতিত হয়, ভয় পায়- তাহলেতো তাদের ভরসার জায়গা নষ্ট হয়ে যায়, দেশে সুশাসন বাধাগ্রস্ত হয়।

লেখক: সিনিয়র কো-অর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন

এ বিভাগের আরো খবর