বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

নিষ্ঠুর সমাজব্যবস্থার যূপকাষ্ঠে শ্রমিক বলি কতকাল!

  •    
  • ১০ জুলাই, ২০২১ ১৬:৫৯

ফ্যাক্টরিতে এ ধরনের অগ্নিকাণ্ড আর তার ফলে নিহত-আহত হওয়ার বিষয়টি তো অনেক পুরোনো। বরং আগের ঘটনাগুলোর কোনো নিষ্পত্তি না হওয়াতেই মালিকপক্ষ সাহস পায়, সুযোগ পায়।

যেদিন করোনায় মারা গেলো সর্বোচ্চসংখ্যক ২১২ জন, সেই একই সময়ে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে সেজান জুস তৈরির কারখানায় আগের দিনে ঘটা অগ্নিকাণ্ডে মারা গেলেন ৫২ জন মানুষ।

করোনার প্রকোপ মোকাবিলায় দেশে যখন কঠোর শাটডাউন চলছে, সেই সময়ে চালু ফ্যাক্টরিতে মারা গেলেন করোনায় এক দিনে সারা দেশে সর্বোচ্চ রেকর্ডসংখ্যক মৃত্যুর প্রায় এক চতুর্থাংশ মানুষ।

কী বলবেন একে? এই যে আমরা বিস্ময় প্রকাশ করি কেন মানুষ ঘরে থাকে না, কেন মানুষ রাস্তায় বের হয়, মানুষ কেন তার শৈশব কৈশোরে বড় হয়ে ওঠা প্রিয় এলাকা ছেড়ে অনেকটা নিরুপায় হয়ে দলে দলে শিল্পঘন শহরে ভিড় করে? তার কি কোনো উত্তর পাই আমরা এই অসহায় শ্রমিকের বেঁচে থাকার লড়াই কিংবা আগুনে পুড়ে অঙ্গার হয়ে বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে জীবনাবসানে!

আহারে বাঁচার জন্য এই নিষ্ঠুর সমাজব্যবস্থার যূপকাষ্ঠে মানব জীবনের কী নির্মম বলি!

এই ঘটনায় সমাজ-সভ্যতা-কৃষ্টি-সংস্কৃতি সব বুঝি ভেঙে ভেঙে পড়ে না?

নাকি একেকটি মৃত মানুষ কেবল একটি সংখ্যাই হয়ে দাঁড়ায় সময়ের ব্যবধানে। শুধু যার যায় সে-ই কেবল মনে রাখে আর বাকি জগত সংসার তার চিরাচরিত নিয়মে চলতে থাকে।

ফ্যাক্টরিতে এ ধরনের অগ্নিকাণ্ড আর তার ফলে নিহত-আহত হওয়ার বিষয়টি তো অনেক পুরোনো। বরং আগের ঘটনাগুলোর কোনো নিষ্পত্তি না হওয়াতেই মালিকপক্ষ সাহস পায়, সুযোগ পায়।

এই অগ্নিকাণ্ডের কারণ হিসেবে সজীব গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবুল হাসেম তার স্বীকারোক্তিতে বলেছেন, ‘ফ্যাক্টরির নিচের তলায় কার্টন এবং বিভিন্ন ধরনের দাহ্য পদার্থ ছিল। নিচের তলার কার্টন থেকে আগুন ছড়িয়ে পড়তে পারে। ওপরের তলাগুলোতে বিভিন্ন মেশিন ও যন্ত্রপাতি ছিল। যেহেতু খাবারের আইটেম তৈরি হয়, তাই বহু ধরনের দাহ্য পদার্থ ছিল। সেটা হয়তো আগুনের ব্যাপকতা বাড়িয়েছে। তাই হয়তো আগুনের এই ভয়াবহতা।’

এ কথা বলার পরেও তিনি দম্ভোক্তি করতে পারেন, এর দায় কি তার? কে তাকে যোগায় এই শক্তি?

এই অগ্নিকাণ্ডকে নিছক দুর্ঘটনা তখনই বলা যেত, যদি ফ্যাক্টরির গেট আগুনের সময় বন্ধ রাখা না হতো! ফায়ার এক্সিট খোলা থাকত (যদি তা প্রকৃতই থেকে থাকে)! হজিরা খাতায় শ্রমিকের প্রকৃত সংখ্যা পাওয়া যেত! ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনায় সব শ্রমিকের ইনস্যুর‌্যন্স করা থাকত! এইসব শ্রমিক তাদের কাজ অনুযায়ী ন্যায্য মজুরি পেতেন! সেখানে কোনো শিশু শ্রমিক নিয়োগ না দেয়া হতো।

কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখি, চরম অব্যবস্থাপনার মধ্যে গড়ে ওঠা একেকটি ফ্যাক্টরির শ্রমিকের রক্ত নিংড়ানো শ্রমে মালিকের লাভ ফুলে ফেঁপে ওঠে আর তৈরি হয় আরও আরও প্রতিষ্ঠানে এই ধরনের লুটেরা বিনিয়োগে পুঁজির লগ্নি। আবার এই লুটেরা পুঁজির ভাগ নাকি পাকিস্তানেও পৌঁছে যায়! কেননা সেজান জুস ও কুলসন সেমাইসহ আরো কিছু পণ্যের স্বত্ব নাকি পাকিস্তানের, ফলে প্যাকেট প্রতি একটা অংশ তারাও নাকি পায়! এসবই হয়তোবা আমাদের জিডিপিও বাড়ায়।

২০২১ সাল জাতিসংঘ ঘোষিত আন্তর্জাতিক শিশু শ্রম নিরসন বর্ষ। অথচ আমরা দেখলাম হাসেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজে অধিকাংশ শিশু শ্রমিক দিয়ে তাদের কারখানার উৎপাদন চালাতো। আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে স্বাধীন দেশে শ্রম মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ হয়ে কারখানা পরিদর্শক পর্যন্ত কত ধরনের কমিটি রয়েছে, কী তাদের কাজ? যে ব্যক্তিদের দায়িত্ব ছিল ফ্যাক্টরি যথাযথ নিয়ম মেনে চলছে কিনা তদারকি করা, কারখানা মালিকের সঙ্গে তারাও সমান দায়ী এতগুলো কোমল প্রাণ অকালে ঝরে যাওয়ার পেছনে। কেননা জনগণের ট্যাক্সের টাকায় প্রতিপালিত দায়িত্বে অবহেলাকারী, দুর্বৃত্তায়িত এই অসৎ লোকগুলোর সহায়তায় মালিকরা এতটা বেপোরোয়া হয়েছে।

এই সময়ে রাষ্ট্রের জরুরি কর্তব্য হচ্ছে, দ্রুত নিহতদের শনাক্ত করে তাদের স্বজনের কাছে ফিরিয়ে দেয়া, আন্তর্জাতিক শ্রম আইন অনুযায়ী তাদের এক জীবনের আয়ের সমান ক্ষতিপূরণ প্রদান করা, আহতদের যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থা ও তাদের ক্ষতিপূরণ প্রাপ্তি নিশ্চিত করার যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করা।

পাশাপাশি শুধু তদন্তের খাতিরে তদন্ত নয় বরং ঘটনার প্রকৃত কারণ খুঁজে বের করা দরকার। প্রকৃত দোষীদের খঁজে বের করা এবং তাদের সুষ্ঠু বিচারের আওতায় এনে দ্রুততম সময়ের মধ্যে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি বিধান করা দরকার। যাতে ভবিষ্যতে এই ধরনের ঘটনা আর না ঘটে। কোনো তরুণ তাজা প্রাণ আর যেন অকালে না ঝরে যায়। আমাদের শিল্প বিকাশের জাতীয় স্বার্থেই এটা নিশ্চিত করা দরকার। কেননা শ্রমিককে যদি রক্ষা করা না যায় তবে শিল্প, জিডিপি, উন্নয়ন কোনো কিছুই শেষ বিচারে টিকবে না ।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামনিস্ট।

এ বিভাগের আরো খবর