বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

ইনডেমনিটি সভ্যতার কলঙ্ক

  • ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী   
  • ৯ জুলাই, ২০২১ ১৯:০৯

পরবর্তীকালে বিচারপতি আবদুস সাত্তার, এইচএম এরশাদ এবং ১৯৯১ সালে খালেদা জিয়ার সরকারও ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল বা রহিত না করে খুনিদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে, এমনকি সংসদে সদস্য হিসেবে খুনিকে সংসদে আসার সুযোগ করে দিয়েছে।

৯ জুলাই ১৯৭৯ সাল। আধুনিক বিশ্বে সভ্যসমাজের ইতিহাসে কলঙ্কজনক দিন। ওইদিন ১৯৭৫ সালের ৫০ নং অধ্যাদেশ হিসেবে পরিচিত আইনটি ১৯৭৯ সালে সংসদ কর্তৃক অনুমোদন দেয়া হয় এবং পঞ্চম সংশোধনীর পর সংশোধিত আইনে বাংলাদেশ সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই জঘন্য আইন প্রবর্তন করার পিছনে মূল উদ্দেশ্য ছিল বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার চিরতরে স্তব্ধ করে দেয়া। ১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ৭ম জাতীয় সংসদে আইনটি বাতিল করে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচারের পথকে সুগম ও উন্মুক্ত করা হয়। ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারিতে হাইকোর্ট সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে।

উল্লেখ করার বিষয় হচ্ছে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সদ্য প্রয়াত সভাপতি আইনজীবী ও সাবেক আইনমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরুর গণমাধ্যমে প্রকাশিত নিবন্ধের উদ্বৃতি প্রাসঙ্গিকতায় তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি লিখেছেন- “ন্যায়বিচার প্রাপ্তি মানুষের জন্মগত ও মৌলিক অধিকার। কাউকে হত্যা করলে তার শাস্তি হলো বিচার সাপেক্ষে মৃত্যুদণ্ড; বয়স ও অন্যান্য বিষয় বিবেচনায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডও হতে পারে। কিন্তু কোনো নিরাপরাধ-নিরস্ত্র নারী-পুরুষ-শিশুকে হত্যা করে কোনো সভ্যতায় কোনো আইনে কেউ পুরস্কৃত হতে পারে না। কিন্তু বাংলাদেশের জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা করার পর খুনিদের বিচার না করে বরং নানাভাবে তাদের পুনর্বাসন ও পুরস্কৃত করা হয়। শুধু পুরস্কৃত করাই হয়নি বরং খুনিদের যাতে বিচার না হয় সেজন্য জারি করা হয় অবৈধ ও অসাংবিধানিক ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ।”

উল্লেখ্য, নিবন্ধে তিনি আরও বলেছেন, “বিশ্বে অনেক মহাপুরুষ নিহত হয়েছেন অজ্ঞাত আততায়ীর হাতে। কিন্তু কোথাও একই পরিবারের সব সদস্যকে একসঙ্গে হত্যার নজির নেই। যেকো হত্যাকাণ্ডের বিচারের দায়িত্ব রাষ্ট্র নিয়ে থাকে। খুনিরা অজ্ঞাত হলেও খুঁজে বের করে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর খুনিরা ছিল আত্মস্বীকৃত। হত্যাকাণ্ডের পর তারা প্রকাশ্যে বলেছিল ‘আমরা শেখ মুজিবকে হত্যা করেছি।’

১৯৭৫ সালের সেপ্টম্বর-অক্টোবর মাসে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে তাদের এই স্বীকারোক্তির খবর প্রকাশ পেয়েছিল। এরপরও তাদের গ্রেফতার করা হয়নি; বরং ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স জারি করে জাতির পিতার হত্যার বিচার আটকে দেওয়া হয়েছিল। এ থেকে প্রমাণিত হয় এ হত্যাকাণ্ডে খন্দকার মোশতাক ও জিয়ার শুধু মৌন সম্মতিই ছিল না, বরং তারাই ছিল হত্যাকাণ্ডের মাস্টারমাইন্ড বা কুশীলব।” (পুনর্মুদ্রণ, সমকাল, জুন)।

বঙ্গবন্ধুর অপরিমেয় সাফল্যগাঁথায় অপ্রতিরোধ্য অগ্রগতিতে বাংলাদেশ যখন নতুন অভিযাত্রায় পদার্পণ করেছিল, প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধপরায়ণতার হিংস্র কৌশলে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রে সংঘটিত হয় সভ্যসমাজের ইতিহাসে সর্বনিকৃষ্ট, নৃশংস ও বর্বরতম হত্যাযজ্ঞ। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গমাতা, শিশু শেখ রাসেলসহ বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে দেড় মাসের মাথায় খন্দকার মোশতাক ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব এমএইচ রহমান স্বাক্ষরিত ‘দি বাংলাদেশ গেজেট, পাবলিশড বাই অথরিটি’ শিরোনামে ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর ‘দায়মুক্তি (ইনডেমনিটি) অধ্যাদেশ’ জারি করা হয়। অধ্যাদেশটির প্রথম অংশে উল্লেখ করা হয়, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে বলবৎ আইনের পরিপন্থী যাই কিছু ঘটুক না কেন, এ ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টসহ কোনো আদালতে মামলা, অভিযোগ দায়ের বা কোন আইনী প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাইবে না। আর দ্বিতীয় অংশে বলা হয়, রাষ্ট্রপতি উল্লেখিত ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে যাদের প্রত্যয়ন করবেন তাদের দায়মুক্তি দেওয়া হইলো।

১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ২য় সংসদ নির্বাচনে জয়ী জিয়াউর রহমানের সরকার ৯ এপ্রিল জাতীয় সংসদে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী আইন ১৯৭৯ পাসের মাধ্যমে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট হতে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল পর্যন্ত দায়মুক্তি অধ্যাদেশসহ চার বছরের সামরিক আইনের আওতায় সব অধ্যাদেশ, ঘোষণার বৈধতা দেয়া হয়। ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল সামরিক আইন প্রত্যাহার করায় খন্দকার মোশতাকের জারি করা ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ মূলত অকার্যকর হয়ে পড়েছিল। ফলে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়ায় কোনো বাধা ছিল না। বিশ্লেষকদের মতে, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচারের পথ রুদ্ধ করে ভবিষ্যতেও যাতে কেউ ১৫ আগস্টের খুনিদের বিরুদ্ধে বিচারিক ব্যবস্থা না নিতে পারে সেজন্য সংবিধান (পঞ্চম সংশোধনী) আইন, ১৯৭৯তে পাস করা হয়।

পরবর্তীকালে বিচারপতি আবদুস সাত্তার, এইচএম এরশাদ এবং ১৯৯১ সালে খালেদা জিয়ার সরকারও ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল বা রহিত না করে খুনিদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে, এমনকি সংসদে সদস্য হিসেবে খুনিকে সংসদে আসার সুযোগ করে দিয়েছে।

দীর্ঘ ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র ক্ষমতায় এসে সংবিধান বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে ইমডেমনিটি অধ্যাদেশ রহিতকরণ বিল সংসদে উত্থাপন করে। ১৪ নভেম্বর রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরের পর এটি পরিপূর্ণভাবে আইনে পরিণত হয়। ফলে মোশতাকের জারি করা এবং জিয়ার সময় বৈধতা পাওয়া ইনডেমনিটি অধ্যাদেশটি বিলুপ্ত বলে গণ্য হয়।

নৃশংস-বর্বরতম এই ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বিলুপ্তকরণ প্রসঙ্গে ২০১৯ সালের আগস্টে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যটি অত্যন্ত প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, ‘১৯৯৬ সালে যখন ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করি তখন সমালোচনা করা হয়েছিল, অনেকেই বলেছিল আমি প্রতিশোধ নিচ্ছি। বিএনপি সেদিন খুনিদের রক্ষা করতে হরতাল ডেকেছিল। বিচারপতির পরিবারের ওপর হামলা হয়েছিল।

একজন সাধারণ মানুষের হত্যার বিচার যেভাবে হয়, জাতির পিতার হত্যার বিচারও সেভাবেই হয়েছে।’ বাংলাদেশসহ বিশ্ববাসী আগ্রহের সঙ্গে এই হত্যাকাণ্ডের বিচার কার্যাবলী শুধু পর্যবেক্ষণ করেনি; এই ধরনের সভ্যতা-মানবতাবিরোধী কর্মযজ্ঞের সুবিচার নিশ্চিতকল্পে সরকারের গৃহীত প্রতিটি আইনি পদক্ষেপকে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে স্বচ্ছ ও জবাবদিহির অপূর্ব দৃষ্টান্ত হিসেবেও গ্রহণ করেছেন। মোদ্দাকথা, জাতি দীর্ঘ দিনের ভারাক্রান্ত হৃদয়ের গভীর দীর্ঘশ্বাসের পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে কলঙ্ক থেকে মুক্তির নতুন পরিশিষ্ট নির্মাণে সর্বাত্মক সফলতায় গৌরবদীপ্ত হয়েছে। বাঙালি জাতি কখনও ন্যায় প্রতিষ্ঠায় কোনো অশুভ শক্তির কাছে মাথা নত করেনি এবং ভবিষ্যতেও পরাভূত না হয়ে শুভ ও আলোকিত শক্তির বিজয় পতাকা উড্ডীন রাখবে।

লেখক: শিক্ষাবিদ, সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

এ বিভাগের আরো খবর