মুক্তিযুদ্ধ বিজয়ী বাংলাদেশ যখন স্বাধীনতার ৫০ বছর বা সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করছে, তখন নিঃসন্দেহে বাহান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে আমাদের একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের বিজয় অর্জনসহ অতীত গৌরবের অনেক স্মৃতিই আমাদের মানসপটে ভেসে ওঠে। কিন্তু এত সাফল্যের পরও আমাদের বিভক্ত সমাজে আজ এই অগ্রযাত্রার বিরুদ্ধেও মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থানকারী একাত্তরের চিরচেনা শত্রু এবং তাদের সহযোগীরা প্রবল প্রতিকূলতা সৃষ্টির অপপ্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশকেও আজ মৌলবাদ, সশস্ত্র জঙ্গিবাদ এবং দেশি-বিদেশি নানা ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে নিরন্তর লড়াই করতে হচ্ছে।
এই ষড়যন্ত্র আর অপশক্তির মুখোমুখি হয়েছি আমরা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকেই। স্বাধীনতার স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার মধ্যদিয়ে যে কালো অধ্যায়ের সূচনা- এত উন্নতি সত্ত্বেও সেই অন্ধকার আমরা দূর করতে পারিনি।
আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসে গর্ব করার মতো উজ্জ্বল কিছু দিন সূর্যের মতো দেদীপ্যমান। যেমন একুশে ফেব্রুয়ারি, ১৭ মার্চ, ২৬ মার্চ, ১৬ ডিসেম্বর ইত্যাদি। এ দেশের সংগ্রামী জনগণ যে গৌরবগাথা রচনা করেছে, এর বিপরীতে অমোচনীয় ক্ষতের মতো কলঙ্কের একটি দিন ১৫ আগস্ট! সপরিবারে স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে নৃশংসভাবে হত্যার কালো দিন। আরও আছে ৩ নভেম্বর, জেলে জাতীয় ৪ নেতাকে হত্যার কলঙ্কিত দিন, ৯ জুলাই, বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার রহিত করার জন্য ১৯৭৯ সালের জাতীয় সংসদে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ সংবিধানে লিপিবদ্ধ করার কালো দিন, ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগপ্রধান শেখ হাসিনাসহ কেন্দ্রীয় নেতাদের গ্রেনেড হামলা চালিয়ে হত্যা চেষ্টার কালো দিনসহ কয়েকটি ভয়ংকর দিন।
দেশি-বিদেশি চক্রান্ত স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছিল যে আত্মস্বীকৃত খুনিরা, তাদের যাতে কোনোদিন বিচারের মুখোমুখি হতে না হয়, সেই অশুভ উদ্দেশ্যেই রাষ্ট্রীয় প্রশাসনযন্ত্র যখন ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে, তখন তা কেবল কোনো ব্যক্তি বা প্রশাসনযন্ত্রের জন্যেই নিন্দনীয় নয়, গোটা জাতির জন্যই তা চরম নিন্দনীয় ঘটনা। সেই চরম কলঙ্কিত দিন ৯ জুলাই ১৯৭৯। ১৯৭৫ সালের১৫ আগস্ট পূর্বপরিকল্পনা অনুসারে ঘাতকচক্রের গড়া পুতুল সরকারের রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক পঁচাত্তরের ২৬ সেপ্টেম্বর জারি করেছিল সেই অধ্যাদেশ, যার শিরোনাম ছিল রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ নম্বর ৫০।
সেই অধ্যাদেশের আইনগত বৈধতা দেয় বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রধান বেনিফিশিয়ারি জেনারেল জিয়াউর রহমান। ১৯৭৯ সালের ৯ জুলাই জাতীয় সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় বিএনপি এই কলঙ্কিত অধ্যাদেশকে বিল হিসেবে পাস করিয়ে নেয়। সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর পর সেদিন সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত করা হয় এই কালো আইনটি। এই আইনে সপরিবার বঙ্গবন্ধু-হত্যা তো বটেই ১৯৭৫-এর ৩ নভেম্বরে জেলে ঢুকে যারা হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে, তারা পর্যন্ত বিচার থেকে দায়মুক্তি পেয়ে যায়!
একথা তো আজ সবারই জানা, ঘাতকচক্রকে দায়মুক্তির কোনোদিন বিচার করা না যায়, সে ব্যবস্থা নিশ্চিত করার পাশাপাশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বাংলাদেশ দূতাবাসে চাকরি দিয়েও পুরস্কৃত করা হয়। সেনাপ্রধান হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন জেনারেল জিয়াউর রহমান। মেজর জেনারেল হয়ে যান লেফটেন্যান্ট জেনারেল। সামরিক শাসন জারি থাকা অবস্থায়ই প্রেসিডেন্ট পদে থাকার বৈধতা নিয়েছিলেন হাঁ-না ভোটের প্রহসন করে।
সামরিক পোশাকেই জেনারেল জিয়ার রাজনৈতিক দল বিএনপি গঠন এবং ১৯৭৯ সালে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার বিজয় নিয়ে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী আনার পূর্বাপর সব ঘটনাই আজ ইতিহাসের অংশ। সেই সংসদেই সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী এনে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ জুলাই পর্যন্ত জিয়া-মোশতাক গংদের কৃত সমস্ত কার্যক্রমকেই বৈধতা দেয়া হয়। মোশতাকের জারি করা ইনডেমনিটি অধ্যাদেশও আইন হয়ে সংবিধানভুক্ত হয় পঞ্চম সংশোধনীতেই।
অনাগত কাল ধরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি কালোদিন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে ৯ জুলাই। এই কলঙ্ক বিএনপির এবং এর দোসরদের ললাটেও অমোচনীয় হয়ে থাকবে চিরতরে। ইতিহাসের শিক্ষাই হচ্ছে এই যে, কেউ ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয় না। যদি নিত তাহলে খন্দকার মোশতাক বাংলার ইতিহাসের আরেক মীরজাফর হিসেবে ধিকৃত হয়ে বিদায় নেবার পরও ১৫ আগস্টের হত্যাকারীদের পক্ষে কারো দাঁড়াবার কথা ছিল না। মোশতাক তো মাত্র কয়েক দিনের রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন খুনিদের ক্রীড়নক হিসেবে। তার পতনের পর বিচারপতি সায়েমকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল জিয়া নামমাত্র রাষ্ট্রপতি বানিয়ে নিজের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে রাজনীতিতে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন মাত্র। প্রশ্ন তোলা যেতেই পারে, খন্দকার মোশতাকের মতো গণধিকৃত, সেই একই বেঈমানি জিয়াও কি করেননি?
এই উপমহাদেশে সেনাপ্রধানের পাশাপাশি একজন উপ-সেনাপ্রধানের পদ কোনো দেশে আছে কি না জানি না। বঙ্গবন্ধু সেনাপ্রধান শফিউল্লাহ ক্ষুণ্ন হবেন জেনেও জিয়াউর রহমানকে পদোন্নতি দিয়ে উপ সেনাপ্রধান পদ সৃষ্টি করেছিলেন। জিয়ার প্রতি অশেষ স্নেহের কারণেই সেটা করেছিলেন। কিন্তু অবিশ্বস্ত জিয়াকে বিশ্বাস করে তার চরম মূল্য দিতে হলো উদারপ্রাণ বঙ্গবন্ধুকে।
জিয়াউর রহমান যে চরম ক্ষমতালিপ্সু, সেটা শুরু থেকেই টের পাওয়া যাচ্ছিল। কালুরঘাটে স্থাপিত বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠের জন্য ২৭ মার্চ জিয়াউর রহমানকে নিয়ে যাওয়ার পরে তিনি যে অবিশ্বাস্য কাণ্ড করেছিলেন, তা-ও ইতিহাসেরই অংশ। চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা এমএ হান্নান ঘোষণা দেয়ার পরও সবাই ভাবলেন যে, একজন বাঙালি সেনা কর্মকর্তাকে দিয়ে ঘোষণাটি দেয়ানো হলে সশস্ত্র বাহিনীতে কর্মরত বাঙালি সেনারা মুক্তিযুদ্ধে যেতে উদ্বুদ্ধ হবেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর পক্ষে ঘোষণা না করে সরাসরি নিজেকে রাষ্ট্রপতি বলে সে ঘোষণা পাঠ করেছিলেন জিয়া! সঙ্গে সঙ্গে বিরূপ প্রতিক্রিয়া! আবার পাঠ করলেন তিনি এবং এবার বললেন, ‘‘অন বিহাফ অব আওয়ার ন্যাশনাল লিডার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান...!
সুতরাং সেই জিয়ার স্বরূপ উন্মোচন যে একদিন হবে সে তো ছিল অনিবার্য সত্য এবং সময়ের ব্যাপার মাত্র। বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথে জিয়া কেন যাবেন? তার অন্তরে যে পাকিস্তান! বঙ্গবন্ধু হত্যার পর জিয়াউর রহমানের গভীর পাকিস্তানপ্রীতি প্রকটভাবে দৃশ্যমান হয়ে উঠেছিল!
পঞ্চম সংশোধনীতে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশের মতো জঘন্য কালাকানুন শুধু সংবিধানে অন্তর্ভুক্তই করেননি রাষ্ট্রপতি জিয়া, বঙ্গবন্ধু-হত্যার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িতদের বিচারের পথ চিরতরে রুদ্ধ করার পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের মূল প্রেরণা বাঙালি জাতির জাগরণের মূলশক্তি ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ই সংবিধান থেকে মুছে দিলেন! যে জয়বাংলা রণধ্বনি দিয়ে বাংলার মানুষ মুক্তিযুদ্ধ করেছে, সেই জয়বাংলা মুছে দিয়ে মৃত পাকিস্তানের জিন্দাবাদ ফিরিয়ে আনলেন সংশোধনীতে। বাংলাদেশ বেতারের নাম বদলে রেডিও পাকিস্তানের স্টাইলে করলেন রেডিও বাংলাদেশ!
বঙ্গবন্ধু যে শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য গণতন্ত্র রেখেও নতুন এক সাম্যবাদী ব্যবস্থার স্বপ্নে সংবিধানে সমাজতন্ত্র কথাটা রেখেছিলেন, সংবিধান থেকে জিয়া তাও মুছে দিয়েছিলেন! যাকে বঙ্গবন্ধু অনেক বিশ্বাস করেছিলেন সেই জিয়ার জ্ঞাতসারেই ১৫ আগস্ট ভোরে নিহত হলেন তিনি সপরিবারে!
জ্ঞাতসারে বলতে হবে এই কারণে, কর্নেল ফারুক-রশিদ, ডালিমদের ১৫ আগস্টের পরিকল্পনা জিয়াউর রহমান জেনেছিলেন বঙ্গবন্ধু হত্যার ৪ মাস ১৯ দিন আগে! ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে কর্নেল ফারুক ও রশিদগং প্রথমে ঢাকা থেকে ব্যাংককে চলে গিয়েছিলেন। সেনাপ্রধান জিয়া তাদেরকে দ্রুত বিশেষ ব্যবস্থায় দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেন। সেখানেই সাংবাদিক ম্যাসকারাহ্যান্সকে টেলিভিশনের জন্য যে সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন- রশিদ, ফারুকরা তাতে উল্লেখ করেছিলেন জেনারেল জিয়াউর রহমানের ভূমিকার কথা। দুজনই বলেছেন ২০ মার্চ সন্ধ্যায় আমরা জিয়ার সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পাই। আমাদের পরিকল্পনা শুনে তিনি বললেন সিনিয়র অফিসার হিসেবে আমি তোমাদের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত থাকতে পারি না। তোমরা ইয়াং অফিসাররা করতে চাইলে এগিয়ে যাও। শেষ বাক্যটা ছিল, গো এহেড।
ফারুক ও রশিদের সেই সাক্ষাৎকার আগ্রহী পাঠক ইচ্ছে করলে ইউটিউবে সার্চ দিয়ে এখনও শুনতে পারেন।
যা-ই হোক, পৃথিবীর ইতিহাসের এই কলঙ্কিত আইন, বিচারহীনতার এই বিধানটি বঙ্গবন্ধু হত্যার ২১ বছর পর তার সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে সংবিধানে সংশোধনী এনে সংবিধানকে কলঙ্কমুক্ত করেন কালো আইনটি বাতিলের মাধ্যমে।
দুঃখের বিষয় এই একুশটি বছর দেশ যারা পরিচালনা করেছেন তাদের কারও বিবেক দংশিত হয়নি এই কালো আইনটি দেখে! বিচারপতি আব্দুস সাত্তার, জেনারেল এরশাদ এবং বেগম খালেদা জিয়ার সরকার এই একুশ বছর দায়িত্ব পালন করেছে। একটি রাষ্ট্রের স্বাধীনতার স্থপতি, জাতির পিতাকে হত্যা করা হলো, তার হত্যাকারীদের বিচারের কোনো ব্যবস্থাই নেয়া যাবে না! এমন কালো আইন সংবিধানে লিপিবদ্ধ থাকলে তা জাতি হিসেবে তাদেরকে কোন আদিম বর্বর যুগে ঠেলে দেয়? এ প্রশ্ন কি তাদের কারো মনে জাগেনি?
বোধকরি জাগেনি। কারণ, যারা ক্ষমতায় ছিলেন তারা সকলেই পাকিস্তানি সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দর্শনের অনুসারী। তারা পোশাকে আধুনিক কিন্তু মন মানসিকতায় ধর্মান্ধ। সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প পাকিস্তান আমলে যেভাবে ছড়ানো হয়েছে এই সমাজে, সেভাবেই ছড়িয়েছেন মুক্তিযুদ্ধজয়ী লাখো শহিদের রক্তস্নাত বাংলাদেশেও। বিচারের পথ রুদ্ধ করে রাখা হলেও বাংলাদেশের গণমাধ্যম, সাংবাদিকসমাজ, লেখক-বুদ্ধিজীবী সমাজ সোচ্চার থেকেছেন এই হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে, বার বার বিচারের দাবি তুলেছেন।
বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে বাংলার কবি-সাহিত্যিকরা শুধু নন, বিশ্বের বহু দেশের কবি-সাহিত্যিক, লেখকরা সোচ্চার হয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর দেশপ্রেম, সাহস আর নেতৃত্বে অভিভূত হয়েছে তাদের চেতনা। লেখায় সেই মুগ্ধতা তারা প্রকাশ করেছেন সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলালের সম্পাদনায় অন্তত ৩০ বছর আগে এরকম একটি সংকলন ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয়েছিল, যেখানে ইউরোপ-আমেরিকা, ভারত-পাকিস্তানসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রগতিশীল কবিদের বন্ধুকে নিয়ে লেখা কবিতা ছাপা হয়েছিল।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর সংবিধান থেকে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশের কালো আইন বিলুপ্ত হলে বঙ্গবন্ধুর আবাসিক পিএ মোহিতুল ইসলাম ওই বছরই ২ অক্টোবর ধানমন্ডি থানায় মামলা দায়ের করেন, আদালতে যার বিচার সম্পন্ন হয়েছিল ১৯৯৮ সালের 8 নভেম্বর। কর্নেল ফারুক, রশিদ, ডালিম, হুদাসহ ১৫ আগস্টের নৃশংস হত্যাকাণ্ডে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ। আসামিরা হাইকোর্টে আপিল করলে ১২ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকে। ৩ জন খালাস পান।
কিন্তু ২০০১ সালের অক্টোবরে বিএনপি-জামায়াতসহ চারদলীয় জোট ক্ষমতায় এলে এ মামলার পরবর্তী কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ে।
দীর্ঘ ৭বছর পর নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয়ী আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালে এই মামলার পরবর্তী কার্যক্রম আবার শুরু হয়। সর্বোচ্চ আদালতও হাইকোর্টের রায় বহাল রাখে। ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারির মধ্যে ৫ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয় এবং ২০২০ সালে আরেক খুনি ধরা পড়লে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। একজন বিদেশে মারা যান। বাকিরা বিভিন্ন দেশে পলাতক। তাদের ফিরিয়ে আনার চেষ্টা এখনও অব্যাহত।
বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের পথ যারা রুদ্ধ করে রেখেছিলেন তারা দেশের যে সর্বনাশ করে গেছেন, তা কোনোদিন মোচন হবার নয়। ১৫ আগস্ট কোনো সরকার প্রধানকেই হত্যা করা হয়নি, হত্যা করা হয়েছিল একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন আর আকাঙ্ক্ষাকেও। বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন একটি ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক মানবিক রাষ্ট্র, যেখানে থাকবে না কোনো অর্থনৈতিক বৈষম্য আর ধর্মীয় সহিংসতা।
বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের রাষ্ট্রে থাকবে না ধর্মের নামে রাজনীতি আর শোষণ-বঞ্চনার মতো পাকিস্তানি অভিশাপ। মানুষের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হবে। সেই কাঙ্ক্ষিত শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই বঙ্গবন্ধু সমাজের সর্বস্তরের প্রতিনিধিত্ব নিয়ে বাকশাল গঠন করেছিলেন। শোষণহীন সাম্যনীতির, অর্থব্যবস্থার প্রচলন করতেই তিনি সবুজ বিপ্লবের ডাক দিয়েছিলেন নতুন ব্যবস্থায়। সামাজিক ও অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠাই ছিল তার স্বপ্ন।
আন্তর্জাতিক পরাশক্তি এবং আঞ্চলিক রাজনীতির চক্রান্তে বঙ্গবন্ধু সরকার যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে মনোযোগও ধরে রাখতে পারছিলেন না। সমাজতন্ত্রের নামে বাম, অতিবাম এবং গণবাহিনী, গলাকাটা বাহিনী, সর্বহারা এবং ‘হক কথা’র নামে বেহক কথার অপপ্রচারের ফুলঝুরি দেশটাকে অস্থির করে তুলেছিল। যার ফলে এত বড় বিশ্বনেতা বঙ্গবন্ধুকে চিলির আলেন্দের মতো করুণ হত্যাযজ্ঞের শিকার হতে হলো স্বাধীনতা অর্জনের সাড়ে তিন বছরের মধ্যে!
বহুদলীয় গণতন্ত্রের নামে জিয়াউর রহমান দেশে ফিরিয়ে আনলেন স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত-শিবির মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলামসহ পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলোকে। সরকারের প্রধানমন্ত্রী বানালেন শাহ আজিজের মতো কট্টর স্বাধীনতাবিরোধীকে। মন্ত্রিসভায় ঠাঁই দিলেন উত্তরবঙ্গের আব্দুল আলিমের মধ্যে ঘৃণ্য রাজাকার নেতাকে আর বেগম জিয়া জামায়াতকে ক্ষমতার শরিক করে পবিত্র জাতীয় পতাকা তুলে দিলেন যুদ্ধাপরাধী রাজাকার নেতাদের গাড়িতে জিয়ার পরে জেনারেল এরশাদ একই পথ ধরেছিলেন অর্থাৎ ধর্মান্ধতার রাজনীতি করেছেন আধুনিক পোশাকে একাত্তরে বঙ্গবন্ধু প্রগতিশীলতার পথে যেতে এই বাংলাদেশকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন আর জিয়াউর রহমান, এরশাদ-খালেদা সরকার সেই জাতীয় ঐক্য বিনাশ করেছেন ধর্মান্ধতার রাজনীতি ছড়িয়ে দিয়ে।
তাই সমৃদ্ধির পথে দুর্বার গতিতে দেশ এগিয়ে যাওয়া সত্তেও বাংলাদেশে আজ বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে ধর্মান্ধতার রাজনীতির বিরুদ্ধে লড়তে হচ্ছে, অনৈক্যের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হচ্ছে। তার প্রতিপক্ষ হিসেবে আজ দাঁড়িয়েছে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র আর মৌলবাদ, সশস্ত্র জঙ্গিবাদ। সেই চির পুরাতন শত্রু পাকিস্তানি আইএসআই তো আছেই। আছে তাদের এদেশীয় রাজনৈতিক এজেন্টরাও। বাংলাদেশকে ২০১০ সাল থেকে যেভাবে টার্গেট করে দেশি-বিদেশি চক্রান্তকারীরা ছোবল দেয়ার চেষ্টা করছে, তাতে বঙ্গবন্ধুর মতোই তার সুযোগ্য কন্যা দেশরত্ন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও তাদেরই টার্গেট। কেননা শেখ হাসিনাই গণরায়ে সরকার গঠন করে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচারের মুখোমুখি করে ফাঁসির রজ্জুতে ঝোলাতে পেরেছেন, একাত্তরের মানবতাবিরোধী ঘাতক অপরাধী হিসেবে আদালতের রায়ে দণ্ডপ্রাপ্ত রাজাকার-আলবদর-নেতাদের কাঠগড়ায় তুলতে পেরেছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাই। এই বিচার ঠেকাতে কত ষড়যন্ত্রই না হয়েছে! দেশে-বিদেশে সর্বত্র!
হেফাজতের উত্থান ঘটেছিল তো এই বিচার ঠেকানোর জন্যই। এই বিচার ঠেকানোর জন্য বিদেশি নাগরিকদের হত্যা, হিন্দু-খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের নাগরিক এবং ধর্মযাজকদের হত্যা করে ভারত-সরকারকে ক্ষিপ্ত করানোর অপচেষ্টা, ইতালি, জাপানসহ বিদেশি নাগরিকদের হত্যা করে পশ্চিমা বিশ্বকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলার মতো কত ষড়যন্ত্রই না দেশি-বিদেশি নীল নকশায় বাস্তবায়নের অপচেষ্টা হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। হলি আর্টিজান বেকারিতে ১৭ বিদেশি নাগরিকসহ জনকে হত্যা করা হয়েছিল।
হত্যাকারীরা নিজেদের আল কায়েদার সদস্য বলে দাবি করেছিল। সারা দেশে সশস্ত্র জঙ্গী তৎপরতা বাংলাদেশকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছিল। সেই ষড়যন্ত্রে ছকেই বাংলাদেশে বিদেশি পরাশক্তির হস্তক্ষেপ করানোর নানা অপচেষ্টা হয়েছে। বাংলাদেশে আল-কায়েদা এসে গেছে এমন জুজুরভয় ছড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। মিয়ানমারকে দিয়ে যুদ্ধের উস্কানি পর্যন্ত দেয়া হয়েছে। কিন্তু দূরদর্শী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বুদ্ধিমত্তায় এড়ানো গেছে সেসব আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র।
সুতরাং এই যে ষড়যন্ত্র আর মুক্তিযুদ্ধের আদর্শবিরোধী শত্রুতা, এর মূলে রয়েছে একাত্তরের শত্রুরা, পঁচাত্তরের সেই চিরচেনা শত্রুরা --যারা ইনডেমনিটি অধ্যাদেশের মতো জঘন্য কালাকানুন পবিত্র সংবিধানে লিপিবদ্ধ করে সংবিধানকেই কলুষিত করেছিল। আমরা যেন ৯ জুলাইয়ের কালো স্মৃতি ভুলে না যাই। জাতীয় গৌরবময় বহু ঘটনার পাশাপাশি এইসব কলঙ্কিত দিনের ইতিহাসও ভাবি প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে হবে, তাহলেই তারা মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের প্রকৃত ঠিকানা খুঁজে পাবে।
লেখক: কবি ও সিনিয়র সাংবাদিক, সাবেক পরিচালক (বার্তা), বিটিভি।