পাকিস্তান আমলে দুই দফা সামরিক শাসন জারি হয়েছিল- ১৯৫৮ এবং ১৯৬৯ সাল। বাংলাদেশ আমলে দুই দফা সামরিক শাসন জারি হতে দেখেছি- ১৯৭৫ এবং ১৯৮২। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা হয়। তখন বলা হতো- সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। অর্থাৎ এই আমলেও সামরিক শাসনামলের মতো সশস্ত্র বাহিনীর কথাই চূড়ান্ত।
আইয়ুব খান ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর সামরিক শাসন জারি করেন। সে দিনই প্রধান সামরিক শাসকের পদ গ্রহণ করেন। প্রেসিডেন্ট পদ গ্রহণ করেন ২০ দিন পর- ২৭ অক্টোবর। তিনি ক্ষমতা গ্রহণ করে ১৯৫৬ সালের ২৩ মার্চ থেকে বলবৎ হওয়া সংবিধান এবং কেন্দ্রীয় পার্লামেন্ট ও সরকার এবং পাঁচটি প্রদেশের পার্লামেন্ট ও সরকার বাতিল করেছিলেন।
সামরিক বিধিবলে একের পর আইন প্রণয়ন করেন। তার বিরোধী রাজনীতিবিদদের অনেককে গ্রেপ্তার করেন। অনেকের জন্য রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়। নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না- এমন তালিকায় দেখা যায় শত শত নাম। ১৯৬২ সালে তিনি প্রধান সামরিক শাসকের একক ক্ষমতায় সংবিধান প্রণয়ন করেন। এ সংবিধানে পার্লামেন্টারি ব্যবস্থার পরিবর্তে প্রেসিডেন্ট পদ্ধতি চালু হয়। জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নিয়ে প্রেসিডেন্ট ও পার্লামেন্ট সদস্য নির্বাচনের ভার অর্পণ করা হয় বিডি মেম্বারদের (বর্তমানের ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য) ওপর। তিনি নিজে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন সহজেই।
১৯৬২ সালের ৮ জুন কেন্দ্রীয় পার্লামেন্ট বা জাতীয় পরিষদ সভায় সামরিক শাসন প্রত্যাহারের আগে তিনি গুরুত্বপূর্ণ একটি কার্য সম্পাদন করেন- সামরিক শাসন জারির পর যত অধ্যাদেশ, বিধিবিধান ও নির্দেশ জারি করেছেন- সবকিছু সংবিধান ও আইনসম্মত হিসেবে অনুমোদন করিয়ে নেন। আইয়ুব খানের শাসনামলে পূর্ব পাকিস্তানের বঞ্চনা-শোষণ বেড়ে যায়। পশ্চিম পাকিস্তানকেন্দ্রিক একটি গোষ্ঠীই ক্ষমতা ধরে রাখবে- সেটাও নিশ্চিত করা হয়।
লেফটেন্যান্ট জেনারেল জিয়াউর রহমান আইয়ুব খানের মতোই একটি কাজ করেছেন ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল। সে দিন জাতীয় পরিষদে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বিল অনুমোদিত হয়। আমাদের জানা আছে, জিয়াউর রহমানকে ১৯৭৫ সালের ২৪ আগস্ট সেনাবাহিনী পদে নিয়োগদান করেন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের খুনি খোন্দকার মোশতাক আহমদ। জিয়াউর রহমান ছিলেন সেনাবাহিনীর উপপ্রধান। বঙ্গবন্ধুকে স্ত্রী, তিন পুত্র, দুই পুত্রবধূসহ নিষ্ঠুরভাবে বাসভবনে হত্যা করা হয়। তার দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বাংলাদেশের বাইরে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান।
একইদিনে আবদুর রব সেরনিয়াবাত ও শেখ ফজলুল হক মণিসহ আরও কয়েকজনকে ঘাতকরা হত্যা করে। এ সব খুনে অংশ নেয়া ব্যক্তিরা দম্ভ করে বলছিল- তারাই ‘শেখ মুজিবকে সবংশে হত্যা করেছে।’ খুনিরা এটাও বলত- জিয়াউর রহমান বরাবর তাদের সঙ্গেই ছিলেন, মুজিবহত্যার চক্রান্তে।
জিয়াউর রহমান ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর রাষ্ট্র ক্ষমতার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেন। যদিও কাগজে-কলমে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ছিলেন বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম, কিন্তু ক্ষমতার দণ্ড ছিল জিয়াউর রহমানের হাতে। ‘বঙ্গভবনের শেষ দিনগুলি’ গ্রন্থে সায়েম লিখেছেন- ‘১৯৭৬ সালের ২৯ নভেম্বর তিনি জিয়াউর রহমানের হাতে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পদ ছেড়ে দেন। রাষ্ট্রপতির পদ ছেড়ে দেন কয়েক মাস পর ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল।’ [পৃষ্ঠা ৩৫]
তিনি লিখেছেন, জিয়াউর রহমান যে সেনাপ্রধান থাকা অবস্থাতেই এবং সামরিক আইনের অধীনে প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পদে বহাল থেকে প্রেসিডেন্ট পদের নির্বাচনে অংশ নেবেন, সে ধারণা তিনি করতে পারেননি। [পৃষ্ঠা ৩৬]
কুটিল পথে সেনাবাহিনীপ্রধান চলেছেন, এটা বুঝতে পারেননি প্রধান বিচারপতি পদে থাকা আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম, এটা ভাবা যায়!
ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করার পথে জিয়াউর রহমান একের পর এক পদক্ষেপ নিতে থাকেন। ১৯৭৮ সালের ৩ জুন অনুষ্ঠিত হয় রাষ্ট্রপতি নির্বাচন। সামরিক আইন বলবৎ ছিল তখন। আওয়ামী লীগের শত শত নেতা জেলে। জয় বাংলা উচ্চারণ করলেই জেল। বঙ্গবন্ধুর নাম এমনকি আভাসে-ইঙ্গিতেও বলা যাবে না। সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ করা হয়েছিল ১৫ আগস্ট থেকেই। সরকারবিরোধী মিছিল-সমাবেশ করার অধিকার ছিল না। এমন পরিবেশেই জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি পদে বিপুলভোটে নির্বাচিত হয়ে যান।
এর আগে তিনি আরেকটি কাজ করেন- সংবিধান সংশোধন। ত্রিশ লাখ নারী-পুরুষ-শিশুর আত্মদানে অর্জিত বাংলাদেশের পবিত্র সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ যায়। সমাজতন্ত্র বর্জন করা হয়। একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা-ধর্ষণ-লুটপাটের প্রত্যক্ষ সহযোগী রাজাকার-আলবদর ও তাদের দল জামায়াতে ইসলামী ও মুসলিম লীগকে রাজনীতি করার অধিকার দেয়া হয়। বাংলাদেশকে ফের ‘পাকিস্তান বানানোর’ ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে তারা হয়ে ওঠে জিয়াউর রহমানের প্রত্যক্ষ সহযোগী।
১৯৭৯ সালের ৬ এপ্রিল জাতীয় সংসদে ‘সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী’ বিল ওঠে। এতে বলা হয়, ‘১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট হতে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল পর্যন্ত প্রণীত সকল ফরমান, ফরমান আদেশ, সামরিক আইন প্রবিধান, সামরিক আইন আদেশ, ও অন্যান্য আইন এবং উক্ত মেয়াদের মধ্যে অনুরূপ কোনো ফরমান দ্বারা এই সংবিধানে যে সকল সংশোধন, সংযোজন, পরিবর্তন, প্রতিস্থাপন ও বিলোপসাধন করা হইয়াছে তাহা এবং অনুরূপ কোনো ফরমান, সামরিক আইন প্রবিধান, সামরিক আইন আদেশ বা অন্য কোনো আইন হইতে আহরিত বা আহরিত বলিয়া বিবেচিত ক্ষমতাবলে অথবা অনুরূপ কোন ক্ষমতা প্রয়োগ করিতে গিয়া বা অনুরূপ বিবেচনায় কোন আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রণীত কোন আদেশ কিংবা প্রদত্ত কোন দণ্ডাদেশ কার্যকর বা পালন করিবার জন্য উক্ত মেয়াদের মধ্যে কোন ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রণীত আদেশ, কাজকর্ম, গৃহীত ব্যবস্থা বা কার্যধারাসমূহ এতদ্বারা অনুমোদিত ও সমর্থিত হইল এবং ঐ সকল আদেশ, কাজকর্ম, ব্যবস্থা, বা কার্যধারাসমূহ বৈধভাবে প্রণীত, কৃত বা গৃহীত হইয়াছে বলিয়া ঘোষিত হইল, এবং তৎসম্পর্কে কোন আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা কর্তৃপক্ষের নিকট কোন কারণেই কোন প্রশ্ন উত্থাপন করা যাইবে না।’
১৫ আগস্টের নৃশংস হত্যাকাণ্ড, ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড, খুনিদের বিচার না করার কুখ্যাত বিধান- ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ, খুনিদের বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি প্রদান, জিয়াউর রহমানের একক সিদ্ধান্তে সংবিধান সংশোধন, গণভোটের প্রহসন- সব বৈধতা পায়।
বঙ্গবন্ধুসহ নারী-শিশুদের খুনিদের বিচার করা যাবে না- ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর এ বিধান জারি করেছিলেন খোন্দকার মোশতাক আহমদ। তখন জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনীপ্রধান। ক্ষমতা হাতের নাগালে, রাষ্ট্রপতির পদটি কখন হাতে আসবে- এমন ছক কষছিলেন। ১৯৭৮ সালের ৩ জুনে রাষ্ট্রপতি ও ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারির পার্লামেন্ট নির্বাচনের পর সব অপরাধ হালাল করা হয়ে গেছে ‘সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর’ মাধ্যমে। তবে ১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বরের প্রত্যক্ষ ঘাতকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের আরও কিছু দায় ছিল জিয়াউর রহমানের। কারণ এটা তো তারই লোক। তার হয়েই কাজ করে দিয়েছে।
খুনিদের কেউ যেন কখনও বিচার করতে না পারে, সে জন্য ১৯৭৯ সালের ৯ জুলাই জাতীয় সংসদে ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বরের কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশটির আরেক দফার অনুমোদন প্রদান করা হয়। পরে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের দাবি যতবার এসেছে- জিয়াউর রহমান, এইচ এম এরশাদ এবং বেগম খালেদা জিয়া একই কথা বলে গেছেন- সংবিধান সংশোধন করতে হবে, দুই-তৃতীয়াংশ ভোট লাগবে। কিন্তু ১৯৯৬ সালের নভেম্বরে এই কুখ্যাত আইন জাতীয় সংসদে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতাতেই পাস হয়। সে সময় সংসদে বিএনপির সদস্যরা ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিলের প্রস্তাবে সায় দেননি। কেনইবা দেবেন? খুনিতে খুনিতে যে মিতালি!
জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় থাকার সময় প্রহসনের বিচারে সশস্ত্র বাহিনীর শত শত সদস্যদের কার্যত হত্যা করা হয়েছে। যে জাসদ নেতা কর্নেল তাহের তাকে ক্ষমতায় আনতে সহায়তা করেছেন, তাকেও এভাবে হত্যা করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের বীরসেনানী খালেদ মোশাররফ ও মেজর হায়দারের রক্তেও তার হাত রঞ্জিত। ইতিহাস এসব অপরাধের দায়ও একদিন মেটাবে।
২০১০ সালে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচারের দণ্ড কার্যকর হওয়া শুরু হয়। খুনিদের দর্প চূর্ণ হয়েছে। তবে ফাঁসির দণ্ড পাওয়া কয়েকজন এখনও পলাতক। এদের ফিরিয়ে আনার দাবি জিয়াউর রহমানের দল বিএনপি সমর্থন করে না। ১৯৯৬ সালের ২৩ জুন শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের কাজ যখন হাতে নেন- স্পষ্ট বলেছিলেন- প্রচলিত ফৌজদারি আইনেই বিচারকাজ চলবে।
সামরিক শাসনের আমলের মতো ধর-মার-কাট নীতিতে তিনি বিশ্বাসী ছিলেন না। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার প্রতি তিনি অঙ্গীকারবদ্ধ ছিলেন। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর এ দেশীয় সহযোগী আলবদর-রাজাকারদের বিচারের সময়েও তিনি ঘৃণ্য অপরাধীদের আইনি সহায়তার পক্ষে ছিলেন। এ সুবিধা তারা নিয়েছে এবং দেখা গেছে জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়ার বিশ্বস্ত আইনজীবীরাই লড়েছে গণহত্যা-ধর্ষণ-লুটপাটে জড়িত গোলাম আযম, মতিউর রহমান নিজামী ও সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীদের পক্ষে।
কিন্তু ইতিহাস ন্যায়বিচার করেই! একাত্তর ও পঁচাত্তরের খুনিদের কোনোভাবেই বিএনপি রক্ষা করতে পারেনি।
লেখক: মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিকতায় একুশে পদকপ্রাপ্ত।