বিশ্বের উন্নত শহরগুলোয় নাগরিক-সেবা খুবই সহজ। বলা চলে একেবারেই হাতের নাগালে। সব নাগরিকই রাষ্ট্রের বিভিন্ন সেবা প্রক্রিয়ার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত থাকায়, এটিকে যত সহজ করা যায় ততই ভালো। মূলত, জনদুর্ভোগ কমানোর চিন্তা থেকেই নাগরিক সেবা সহজ করা হয়। এর মধ্যে ওয়ান স্টপ সার্ভিসের মাধ্যমে বেশিরভাগ সমস্যার সমাধান করা হয়। প্রশ্ন হলো আমাদের দেশে নাগরিক-সেবা আসলে কেমন। যারা সেবা নিতে যান তারাই মূলত বলতে পারবেন সেবা গ্রহণের ভোগান্তির মাত্রা কতটুকু।
একটি ঘটনার কথা যদি বলি। রাজধানীর দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পাঁচ নম্বর ওয়ার্ডের এক বাসিন্দা নাগরিক-সেবা নিতে যাওয়ার পর সেই ভোগান্তির কথা জানিয়েছেন। যা সত্যিই কষ্টদায়ক। তেমনি পুরো ঘটনা শুনলে যে কারো মনে হওয়া স্বাভাবিক সামান্য সেবা দিতে এক ঝক্কি কেন? যারা এরকম বাস্তবতার মুখোমুখি কখনই হননি তাদের কাছে বিষয়টি একেবারেই অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে। কেউ কেউ যে একেবারেই হতবাক হবেন না তাও কিন্তু নয়।
ভদ্রলোক বললেন, মেয়ের জন্মনিবন্ধন সার্টিফিকেটে বাবা ও মেয়ের নামে মাত্র একটি অক্ষর বেশি। আর বিপত্তি এখানেই। নামের টাইটেলের একটি অক্ষর ফেলে দিলেই সমাধান। মেয়ের পিএসসি পরীক্ষা সামনে রেখে জন্মনিবন্ধন সংশোধনের প্রয়োজন।
শুরু হলো সার্টিফিকেট সংশোধনের মিশন। ভদ্রলোক প্রথমে গেলেন কদমতলা ওয়ার্ড কমিশনারের কার্যালয়ে। সেখানে গিয়ে জানতে পারলেন করোনা শুরুর পর থেকে সিটি করপোরেশনের নির্ধারিত এই কার্যালয়ে কমিশনার বসেন না। একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কমিশনার যুক্ত। সেই প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়ের একটি অংশ অস্থায়ীভাবে কমিশনার কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করা হয়। খবর নিয়ে তিনি সেখানে ছুটে গেলেন।
অস্থায়ী কর্যালয়ে কমিশনার সাহেব ইচ্ছামত আসেন। তাই দেখা হয়নি। অফিস স্টাফদের সমস্যা বললেন। তারা যেসব পরামর্শ দিলেন তাতে সেই ভদ্রলোকের পাথর হওয়ার অবস্থা। পরামর্শ শুনে তিনি বলছিলেন, জন্মনিবন্ধন সার্টিফিকেট আজীবন যেন এমনই থাকে! তাছাড়া অনেক টাকা পয়সা লাগবে শুনেও তিনি হতাশ হয়ে বাসায় ফিরলেন। কিন্তু স্কুলের তাগিদে কমিশনার কার্যালয়ের পরামর্শ মতো ভদ্রলোক গেলেন দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নগর ভবনে। সেখান থেকে পরামর্শ দেয়া হলো সচিবালয়ের পাশে পরিবহন পুল ভবনের নয় তলায় ‘জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন’ মহাপরিচালকের কার্যালয়ে যাওয়ার জন্য।
সেখানে গিয়ে কথা বললেন। একজন ভদ্রলোক সমস্যার কথা শুনে ওয়েবসাইডে গিয়ে সার্চ দিয়ে একটি প্রিন্ট কপি বের করে দিলেন। তা দেখে আরও চোখ কপালে ওঠল ভদ্রলোকের। জন্মনিবন্ধনের নম্বর ধরে প্রিন্ট কপিতে দেখা গেল বাংলা বানান সবই ভুল! যেহেতু সার্টিফিকেট ইংরেজিতে করা তাই বাংলা দেখার আর প্রয়োজন হয়নি। হাতে ফরম পূরণ করার সময় বাংলা, ইংরেজি উভয় অপশনই ছিল। যারা অনলাইনে ফরমটির কাজ সম্পন্ন করেছিলেন তারা এত অবহেলা করে কাজটি করেছিলেন তা আর বলার মতো নয়। তাই এত ভুল হয়েছে।
মহাপরিচালকের কার্যালয় থেকে এবার পরামর্শ এল প্রিন্ট কপি নিয়ে খিলগাঁও এলাকার তিলপাড়ায় সিটি করপোরেশনের আঞ্চলিক কার্যালয়-২ এ যোগাযোগ করার। সেখানে যাওয়ার পর নিচতলার সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে এবার পরামর্শ এল অনলাইনে সংশোধন ফরম পূরণ করতে হবে। অফিসের সামনে কম্পিউটারের দোকানে গেলেই তা করা যায়।
সেখানে গিয়ে জানতে পারলেন ২০০ টাকার বিনিময়ে তারা ফরম পূরণ করেন। তবে ফরম পূরণ করতে হলে অনেক কাগজপত্র অনলাইনে আপলোড করতে হবে। তাই বেশকিছু কাগজপত্র সংগ্রহের পরামর্শ দেয়া হলো। শেষ পর্যন্ত পরিচিত এক ভদ্রলোকের সহযোগিতায় সিটি করপোরেশনের লোকজন ফরমটি পূরণ করে দিলেন। কিন্তু ফরমটি বাবা-মায়ের মৃত্যু সনদের কপি আপলোড না করা পর্যন্ত সেন্ড করা যাচ্ছিল না। এ ঘটনা দেখে হাসাহাসি করছিলেন খোদ প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারাই। বাবা-মা তো জীবিত। তবে এই সমস্যার সমাধান কী? শেষ পর্যন্ত অন্য দু’জনের মৃত্যুসনদ আপলোড করার পর, ফরম পূরণ সম্পন্ন হয়! এটাই সত্যি। নাগরিক সেবার বাস্তব চিত্র।
এরমধ্যে বাবা-মায়ের জাতীয় পরিচয়পত্রের কপি চান করপোরেশনের কর্মকর্তারা। সেখানে দেখা গেছে, জন্মনিবন্ধন ফরমে দেয়া বর্তমান ও স্থায়ী ঠিকানার সঙ্গে জাতীয় পরিচয়পত্রের ঠিকানা মিলছে না। বাবা জবাব দিলেন, জাতীয় পরিচয়পত্রে বর্তমান ও স্থায়ী ঠিকানা একসঙ্গে গুলিয়ে ফেলে লেখা হয়েছে। এটি সংশোধন করতে নির্বাচন কমিশনের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে ঘুরে ভদ্রলোক তিনবছর ঘুরে রীতিমতো এখন ক্লান্ত।
যাহোক আঞ্চলিক কার্যালয় থেকে শেষ পর্যন্ত জন্মনিবন্ধনের সংশোধন ফরম ঢাকা জেলা প্রশাসক বরাবর একটি ফরওয়ার্ডিংসহ হাতে পেলেন সেই ভদ্রলোক। পরামর্শ এল এই কপি নিয়ে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে জমা দিতে হবে। পরদিন জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে যাওয়ার পর তিনতলায় পাঠানো হলো। সেখানে প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র দেখে বলা হলো, স্কুল থেকে শিক্ষার্থীর দেয়া প্রত্যয়ন নাম সংশোধনের জন্য যথেষ্ট নয়! এজন্য ইংরেজিতে আরেকটি প্রত্যয়ন লাগবে।
বাবা-মায়ের জাতীয় পরিচয়পত্র, জন্মসনদসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দেয়ার পর জেলা প্রশাসক কার্যালয় থেকে, বিদ্যুৎ বিলের কপিসহ আরও কয়েকটি কাগজ চাওয়া হয়। সবকিছু ঠিকঠাক করে দেয়ার পর তা জেলা প্রশাসক অনুমোদন দেবেন। সেখান থেকে ফাইল অনলাইনে সিটি করপোরেশনের আঞ্চলিক কার্যালয়-২ এ যাবে। এতে সময় লাগবে কমপক্ষে একমাস। আঞ্চলিক কার্যালয়ে অনুমোদন যাওয়ার পর সেখানে সংশোধিত সার্টিফিকেট তৈরি শেষে গ্রাহক মোবাইল ফোনে এসএমএস পাবেন। তারপর সেখানে গিয়ে সার্টিফিকেট সংগ্রহ করা যাবে।
ভদ্রলোক বলছিলেন, জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে সিটি করপোরেশন থেকে যা যা চাওয়া হয়েছিল তা যুক্ত করে ফরম জমা দিয়ে এসেছি। বিড়ম্বনা পোহাতে পোহাতে রীতিমতো বিরক্ত হয়ে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে আরও নতুন যেসব কাগজপত্র চাওয়া হয়েছিল তা আর দিতে পারিনি। তাই মেয়ের জন্ম নিবন্ধন ফরমটি আদৌ সংশোধন হবে কি না জানা নেই। তবুও আশায় বুক বেঁধে আছেন তিনি। জমা দেয়া কাগজপত্র দেখে জেলা প্রশাসক যদি সদয় হয়ে ফাইলটি অনুমোদন দেন, তবেই হয়ত কাজটি হতে পারে। কথা হলো বাবা মায়ের জন্মসনদ, এনআইডি কপি, স্কুলের প্রত্যয়ন, শিক্ষার্থীর ছবি দেয়ার পর আর কি বাকি থাকতে পারে এই ছোট্ট কাজটি শেষ করতে?
গল্পের ছলে সেই ভদ্রলোক আরও বলেছেন, সিটি করপোরেশনের আঞ্চলিক কার্যালয়ে গিয়ে সেবা নিতে আসা মানুষের অনেক নাগরিক যন্ত্রণা দেখেছেন তিনি। এক ভদ্রলোকের বয়স হবে ৫০-এর বেশি। তিনি জন্মনিবন্ধন করাতে এসেছেন। জন্মনিবন্ধন করাতে ব্যক্তির বাবা-মায়েরও জন্ম নিবন্ধন সনদ লাগে। এক্ষেত্রে অনলাইন জন্ম নিবন্ধন ছাড়া সাধারণ নিবন্ধনসনদ গ্রহণযোগ্য নয়। পাশাপাশি যিনি জন্মনিবন্ধন করাতে এসেছেন তার বাবা তো অনেক আগেই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। তবে এই ভদ্রলোকের কি জন্মনিবন্ধন হবে না? এই প্রশ্নের উত্তর দিনভর আঞ্চলিক কার্যালয়ে ঘুরেও কারো কাছ থেকে পাননি। শেষ পর্যন্ত বিষণ্ন মন নিয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন তিনি।
জন্মনিবন্ধন, জাতীয় পরিচয়পত্র, টিকা কার্ড, ট্রেড লাইসেন্স, বিদেশ যাত্রায় ফরম পূরণ, বোর্ড সার্টিফিকেটের ক্ষেত্রে ভুল ভ্রান্তি বেশি থাকে। বিশেষ করে জাতীয় পরিচয়পত্র আর জন্মনিবন্ধন সার্টিফিকেট একবারে যিনি নির্ভুল পেয়েছেন তিনি হয়ত দেশের সবচেয়ে ভাগ্যবান মানুষ। যাদের ক্ষেত্রে ভুল হয়েছে তাদের বিড়ম্বনার শেষ নেই। অনেকেই মাসের পর মাস দপ্তরে দপ্তরে ঘুরতে ঘুরতে এসব সংশোধন করার ইচ্ছা শিকেয় তুলে রেখেছেন।
কথা হলো একটি ওয়ান স্টপ সার্ভিসেই কেন ছোটখাট এসব সমস্যা সমাধান করা যাবে না। এজন্য দিনের পর দিন কেন দপ্তরে দপ্তরে ঘুরতে হবে। শিকার হতে হবে হয়রানির। কমিশনার কার্যালয়েই তো ওয়ান স্টপ সার্ভিসের মাধ্যমে জন্মনিবন্ধন-সংক্রান্ত সব কাজ সম্পন্ন করা যেতে পারে। সংশ্লিষ্ট বিভাগের মন্ত্রী, সচিব থেকে শুরু করে যারা এসব কাজে নীতিনির্ধারক পর্যায়ে আছেন তারা যদি বিষয়টি অনুভব করেন তবেই এ ধরনের সেবা সহজেই নিশ্চিত করা সম্ভব।
লেখক: সাংবাদিক