জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক জীবনের বাঁকে বাঁকে জড়িয়ে আছে চট্টগ্রাম। বীরপ্রসবিনী এবং বারো আউলিয়ার পুণ্যভূমিজুড়ে আছে তার স্মৃতি। এখনও জাতির পিতার তেজোদীপ্ত ভাষণের স্মৃতি ধারণ করে আছে লালদিঘি ময়দান, জে. এম. সেন হলের মাঠ, পলোগ্রাউন্ড ময়দান কিংবা এমএ আজিজ স্টেডিয়াম (সাবেক নিয়াজ স্টেডিয়াম)।
সদরঘাটের হোটেল শাহজাহান, স্টেশন রোডের হোটেল মিসকা, রেস্টহাউস (এখন মোটেল সৈকত), পুরাতন সার্কিট হাউস, ইস্পাহানী রেস্টহাউস, বাংলাবাজারে আমির হোসেন দোভাষের বাড়ি, ফিরিঙ্গিবাজারে জানে আলম দোভাষের বাড়ি, হালিশহরে এমএ আজিজের বাড়ি, দামপাড়ার জহুর আহমেদ চৌধুরীর বাড়িসহ এই শহরে আছে জাতির পিতার অনেক স্মৃতি।
দীর্ঘদিন ধরে চট্টগ্রামে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি নিয়ে লিখব বলে ভাবছিলাম। তথ্যানুসন্ধানে দ্বারস্থ হই ষাটের দশকের আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ নেতা ও তাদের পরিবারের সদস্যদের। খোঁজ নিতে শুরু করি সম্ভাব্য উৎসগুলোর। একদিন যাই বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু, সাবেক মন্ত্রী প্রয়াত জহুর আহমেদ চৌধুরীর বাসভবনে। উদ্দেশ্য তাঁর পুত্র মহানগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী। তার স্মৃতিতে কতটুকু আছেন বঙ্গবন্ধু। প্রশ্ন শেষ না হতেই এককথায় বললেন, কিছুই নেই। যুদ্ধের সময় সব নষ্ট হয়ে গেছে। পাশে ছিলেন মাহতাব চৌধুরীর এক প্রবাসী বন্ধু। তিনি জানতে চাইলেন, কী কারণে আমি এসব খুঁজছি। একটু খুলে বলার পর তিনি ভাবলেন একটু। ডুব দিলেন স্মৃতির গভীরে। বললেন, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে যাদের ভাবসখ্য তাদের বেশির ভাগই বেঁচে নেই। তবে এখনও দুজন বেঁচে আছেন, যারা জাতির পিতার কাছে যেতে পারতেন। তাদের আছে অনেক স্মৃতি। তারা হলেন- নূর মোহাম্মদ চৌধুরী ও শাহ বদিউল আলম।
তিনি জানালেন, অনেক বড় বড় নেতা বঙ্গবন্ধুর কাছে ঘেঁষতে পারতেন না। চট্টগ্রাম, ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর কাছে ওনারা খুব সহজে যেতে পারতেন। বঙ্গবন্ধুও নূর মোহাম্মদ, শাহ বদিকে পছন্দ করতেন। একই কথা জানালেন মাহতাব চৌধুরীর আরেক বন্ধু চিরঞ্জিত চক্রবর্তী। তিনিও একসময় ছাত্রলীগ করতেন। তারপর তাদের সঙ্গে যোগাযোগের উপায়ও বাতলে দেন। সেল নম্বরের পাশাপাশি ঠিকানাও দেন।
নূর মোহাম্মদ চৌধুরী এবং শাহ বদিউল আলম সম্পর্কে জানার পর আমার কৌতূহল বেড়ে যায়। অন্যদিকে বিভিন্ন মাধ্যমে এমন আর কে আছেন, চলতে থাকে সে অনুসন্ধানও। সন্ধান পাই অনেকেরই, কিন্তু এ দুজনের মতো ঘনিষ্ঠ কেউ এখন আর নেই। চট্টগ্রামে জাতির পিতার ঘনিষ্ঠ ছিলেন আমির হোসেন দোভাষ, জানে আলম দোভাষ, এমএ আজিজ, জহুর আহমেদ চৌধুরী, শেখ মোজাফফর আহমদ, এমএ ওহাব, এমএ মান্নান, সিরাজুল হক মিয়া, ইসহাক মিয়া, সুলতান কন্ট্রাক্টর, নুরুল আলম চৌধুরী প্রমুখ। তাদের কেউই আজ বেঁচে নেই।
সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান নূর মোহাম্মদ চৌধুরী। কথাবার্তায়ও বনেদি ভাব। বাসায় ঢুকতেই ব্যস্ত হয়ে পড়েন চা-নাশতা নিয়ে। কিছুপর খুলে দেন স্মৃতির ঝাঁপি। বললেন, ‘আমি এবং আমার বন্ধু শাহ বদি দুজনই ছিলাম বঙ্গবন্ধুর কাছের লোক। চলুন, শাহ বদির কাছে যাই। ও আর আমি একসঙ্গে আড্ডাচ্ছলে আপনাকে সব শোনাব।’
বয়সের ঘর আশি ছুঁই ছুঁই নূর মোহাম্মদ চৌধুরী আমাকে নিয়ে ছুটলেন শাহ বদির বাসার উদ্দেশে। বাসায় গিয়ে পেয়ে যাই আওয়ামী লীগের রাজনীতির দীর্ঘকালের সাক্ষী এবং জাতির পিতার ঘনিষ্ঠ সহচর শাহ বদিউল আলমকে। তিনিও আমার আগ্রহের কথা শুনে আশ্চর্য! একপ্রকার আক্ষেপ নিয়েই বললেন, ‘আমাদের খোঁজ এখন আর কেউ নেয় না। যিনি নিতেন, তাকে তো বেইমানের বাচ্চারা শেষ করে দিয়েছে। এখন আমাদের খোঁজ নিয়ে কী লাভ। কী হবে শুনে আমাদের কথা!’ এসব বলতে বলতে চোখ ছলছল করছিল। শুরু করলেন স্মৃতিচারণ। একজনের কিছু একটা ছুটে গেলে আরেকজন মনে করিয়ে দেন। এভাবে টানা চার ঘণ্টার আড্ডা চলে ইতিহাসের দুই কর্মীর সঙ্গে।
নূর মোহাম্মদ চৌধুরী বঙ্গবন্ধুকে প্রথম দেখেন ১৯৫৪ সালে। তখন যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের প্রচারণায় মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সঙ্গে নির্বাচনি প্রচারণায় চট্টগ্রাম আসেন শেখ মুজিব। লালদিঘি ময়দানের বিশাল জনসভায় বক্তব্য দেন তারা। সেখানে শেখ মুজিবের ভাষণ শুনে ভক্ত হয়ে যান মুসলিম হাই স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র নূর মোহাম্মদ।
১৯৫৮ সালে আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের শুরু থেকে রাজনীতিতে সক্রিয় হন নূর মোহাম্মদ। রাজনীতি পাঠের শুরুতেই অভিষিক্ত হন শহর আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক পদে।
১৯৬৪ সালে ফাতিমা জিন্নাহর সমর্থনে অনুষ্ঠিত ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (এনডিএফ) আরেক জনসভায় লালদিঘি ময়দানে আসেন শেখ মুজিব। তখনও দর্শকসারির প্রথম কাতারে থেকে শোনেন প্রিয় নেতার বক্তব্য। একই দিন নিয়াজ স্টেডিয়ামে আয়োজিত এক পরিচিতি সভায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে পরিচিত হন। ‘তুই নূর মোহাম্মদ না? আমি তোকে চিনি,’ বলে তাকে জড়িয়ে ধরেন শেখ মুজিব। এতেই তখন মহাখুশি তরুণ নূর মোহাম্মদ।
উল্লেখ্য, ওই পরিচিতি সভায় আইয়ুব খান বক্তব্য দেয়ার সময় স্থানীয় ছাত্রলীগ-আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ‘আইয়ুব খান মুর্দাবাদ’ স্লোগান ওঠায় মাঝপথে তিনি বক্তব্য বন্ধ করতে বাধ্য হন। হট্টগোলের একপর্যায়ে সেখানে লাঞ্ছিত হন তখনকার এমপিএ আলীম উল্লাহ চৌধুরী। এই ঘটনায় আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগের ২৭ জনকে আসামি করে আলীম উল্লাহ হত্যাচেষ্টার মামলা হয়। মামলায় আসামিদের পক্ষে দাঁড়িয়ে জামিনের ব্যবস্থা করেন বর্ষীয়ান আইনজীবী আবুল কাশেম সাবজজ ও ফটিকছড়ির আইনজীবী আবদুল হালিম।
সেদিনের আরেকটি ঘটনার বর্ণনা দেন শাহ বদিউল। জানালেন, ‘আলীম উল্লাহ চৌধুরীর ওপর আক্রমণের পর পুলিশ ধরপাকড় শুরু করে। একপর্যায়ে পুলিশ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আবদুর রহমান খানকে (যুক্তফ্রন্ট সরকারের পাটমন্ত্রী) আটক করে চট্টগ্রামের তৎকালীন এডিসি (জেনারেল) ইনাম আহমেদ চৌধুরীর জিম্মায় দেন। বঙ্গবন্ধু তখন সার্কিট হাউসপ্রান্তে জিপে বসা ছিলেন।
আবদুর রহমানকে ছাড়িয়ে নিতে আমাকে এবং ইদরিস আলমকে এডিসির কাছে পাঠান বঙ্গবন্ধু। এডিসিকে গিয়ে নেতার নির্দেশের কথা জানালাম। বলি, ‘উনি যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রী ছিলেন, ওনাকে ছেড়ে দিন।’ তিনি আমাদের কথায় কর্ণপাত না করে আবদুর রহমান খানকে পুলিশের গাড়িতে তুলে দেন। ঘটনাটি লক্ষ করলেন বঙ্গবন্ধুও। লিডার তখন শুধু এটুকু বলেছিলেন, ‘শুনবে! সময় আসলে সব কথাই শুনবে!’
নূর মোহাম্মদ ১৯৫৭ সালে মেট্রিক পাসের পর ভর্তি হন সিটি কলেজে (তৎকালীন নাইট কলেজ)। তত দিনে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে তিনি পরিচিত মুখ। স্থানীয়ভাবে জননেতা জহুর আহমেদ চৌধুরীর অনুসারী। থাকতেন চৌধুরীর সঙ্গে। এরই মধ্যে আওয়ামী লীগে অপরিহার্য হয়ে ওঠেন তারা দুই বন্ধু। পরবর্তী সময়ে সব রাজনৈতিক কর্মসূচিতে নিজেদের যুক্ত রাখতেন তারা। রাজনৈতিক কর্মসূচিতে নিয়মিত হয়ে ওঠায় ইতিমধ্যে বঙ্গবন্ধুর আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন তারা।
১৯৬৬’র ছয় দফা আন্দোলন নূর মোহাম্মদ ও শাহ বদির রাজনৈতিক জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। ২৫ ফেব্রুয়ারি ছয় দফার সমর্থনে অনুষ্ঠিত লালদিঘি ময়দানের জনসভায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন তারা। এতে ছয় দফা তুলে ধরে ঐতিহাসিক বক্তব্য দেন শেখ মুজিব। সভায় সভাপতিত্ব করেন জহুর আহমেদ চৌধুরী। সভা শুরুর আগে গান গেয়ে জমিয়ে তোলেন মোহাম্মদ শাহ বাঙালি (শফি উল্লাহ) ও বদন আহমদ দিদারি। বঙ্গবন্ধু ছয় দফাকে বাঙালির মুক্তিসনদ বলে উল্লেখ করেন। এটি ছিল লালদিঘি ময়দানে তখনকার সময়ের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক জনসভা।
নূর মোহাম্মদ চৌধুরী জানান, লালদিঘির জনসভা শেষ করে লিডার (বঙ্গবন্ধু) ওঠেন হোটেল শাহজাহানে। সেখানে লিডারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। পরদিন ভোরে তিনি সিরাজুল হক মিয়ার জিপে চড়ে চলে যান নোয়াখালী। টাকার ওপর স্লোগান লিখেও আমরা ছয় দফার পক্ষে প্রচারণা চালিয়েছি। পাশাপাশি কুপনের মাধ্যমে মুজিব ফান্ডের অর্থ সংগ্রহও করেছি।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধু তখন জেলে। চট্টগ্রাম রাইফেল ক্লাবে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ও ড. ওয়াজেদ মিয়ার বিবাহোত্তর অনুষ্ঠানের আয়োজনে যুক্ত ছিলেন নূর মোহাম্মদ চৌধুরী, শাহ বদি, প্রয়াত নুরুল ইসলামসহ অন্যরা।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধু আটক অবস্থায় ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে ১৯৬৮ সালের ১১ আগস্ট নূর মোহাম্মদ চৌধুরীর কাছে চিঠি লেখেন। এ প্রসঙ্গে চৌধুরী জানান, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা পরিচালনা কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন ঢাকার কমলাপুর ইউনিয়নের তৎকালীন চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট ময়েজউদ্দিন আহমেদ। মামলার খরচের জন্য গঠিত তহবিলের কুপন আনতাম তার কাছ থেকে। তহবিলের টাকা তুলে তাকে দিয়ে আসতাম। বিষয়টি জানতেন বঙ্গবন্ধু। তখন জেল থেকে বঙ্গবন্ধুর চিঠিপত্র আদানপ্রদান করতেন ময়েজউদ্দিন। একদিন তিনি আমাকে ক্যান্টনমেন্ট থেকে লেখা বঙ্গবন্ধুর একটি চিঠি এনে দেন। চিঠিটি পেয়ে যেন আমি আকাশের চাঁদ পাই। আমার এমন খুশি লেগেছিল, যা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না।
১৯৬৯ সালে নূর মোহাম্মদ চৌধুরী শহর আওয়ামী লীগের কার্যকরী সদস্য হন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ডবলমুরিং, পাঁচলাইশ, ফটিকছড়ি, বাঁশখালী ও চকরিয়ায় নির্বাচনি প্রচারণায় অংশ নেন। ১৯৭১ সালের ১১ জানুয়ারি এমএ আজিজের জানাজায় বঙ্গবন্ধু উপস্থিত হলে তখনও সঙ্গে ছিলেন নূর মোহাম্মদ ও শাহ বদি। জানাজায় ফজলুল কাদের চৌধুরী ‘অ-মুজিব’ বলে বঙ্গবন্ধুকে জড়িয়ে ধরতে গেলে বাধা দেন শাহ বদি।
নূর মোহাম্মদ চৌধুরী বলেন, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার আর বদির এমন সম্পর্ক হয়ে যায় যে, চট্টগ্রাম এলেই তিনি আমাদের খুঁজতেন। তার সঙ্গে দেখা করতে আমাদের কোনো বাধা ছিল না। স্বাধীনতার পর যখন তিনি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার শীর্ষে, তখনও বঙ্গবন্ধুর কাছে যেতে আমাদের কোনো প্রটোকল ডিঙাতে হতো না।
দিন-তারিখ মনে নেই। আমি আর বদি একদিন গণভবনে যাই। তখন গণভবনের কঠোর নিরাপত্তা-বেষ্টনী পার হতে আমাদের বেগ পেতে হয়। বিষয়টি লিডারকে জানানোর পর তিনি গেটের সিকিউরিটির লোকজনকে ডেকে আমাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন, যাতে পরবর্তী সময়ে সরাসরি প্রবেশ করতে আমাদের কোনো অসুবিধে না হয়। এরপর যতদিন গণভবনে গিয়েছি, আর কেউ আমাদের আটকাতে পারেনি। আরেকবার ৩২ নম্বর বাড়ির নিরাপত্তাকর্মীরা আমাদের ভেতরে যেতে না দিয়ে জেরা করতে থাকেন। এ সময় তিনতলায় দাঁড়িয়ে কবুতরের মুখে খাবার তুলে দিচ্ছিলেন লিডার। আচমকা নিচে আমাদের উপস্থিতি খেয়াল করেই উপর থেকে ডাক দেন। এরপর আমরা সোজা ভেতরে ঢুকে যাই- বলেন নূর মোহাম্মদ চৌধুরী। ১৯৭৪ সালের ১ জুলাই জহুর আহমেদ চৌধুরীর মৃত্যুর খবর শুনে চট্টগ্রামে ছুটে আসেন শোকার্ত বঙ্গবন্ধু। জানাজা শেষে প্রিয় বন্ধুর দাফনের তদারকি করে তারপর ঢাকায় ফিরে যান। এ সময়ও তার কাছে ছিলাম আমরা।
১৯৭৪ সালের দিকে বঙ্গবন্ধু আমাকে আর বদিকে একটি বিশেষ দায়িত্ব দেন। দলের অভ্যন্তরে গোয়েন্দাগিরি ছিল আমাদের কাজ। এ জন্য মাস শেষে নিজ হাতে আমাদের বকশিস দিতেন। এ জন্য আওয়ামী লীগের কেউ কেউ আমাদের প্রতি ক্ষুব্ধ ছিলেন। ’৭৪ সালে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সম্মেলনে আমাদের কাউন্সিলর করা হয়নি। আমরা কারও কাছে প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে সোজা লিডারের কাছে নালিশ করি। লিডারকে বলি, আমরা চলে যাব? নাকি থাকব? তিনি বললেন, ‘কী হয়েছে! তোরা যাবি কেন?’ বললাম, ‘আমাদের কাউন্সিলর করা হয়নি।’ তখন তিনি সঙ্গে সঙ্গে ডেকে নেন তাজউদ্দীন আহমদ এবং তোফায়েল আহমেদকে। তাদের বলেন, ‘ওদের দুজনের নাম যেন প্রথম অধিবেশনে কো-অপশনের তালিকায় থাকে।’ সপরিবারে নিহত হওয়ার কিছুদিন আগে কোরবানির ঈদের সময় আমি আর বদি দেখা করতে গেলে আমাদের তিন হাজার টাকা দেন কোরবানির গরু কেনার জন্য। সর্বশেষ চট্টগ্রাম সফরে এলে লিডারের সঙ্গে আমরাও যাই বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র উদ্বোধন অনুষ্ঠানে। সেখান থেকে যাই কাপ্তাইয়ে। হেলিকপ্টারে যান বঙ্গবন্ধু।
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে শেষ দেখার বর্ণনা দিয়ে নূর মোহাম্মদ চৌধুরী বলেন, প্রায় ৮০ বছরের জীবনে আমার জন্য সবচেয়ে বড় আঘাত জাতির পিতার মৃত্যুসংবাদ। নূর মোহাম্মদ চৌধুরী রাজনীতিতে সক্রিয় না থাকলেও সপ্তাহান্তে ঘুরে আসেন দামপাড়ায় জহুর আহমেদ চৌধুরীর বাড়ি। সেখানে নেতার পুত্র মাহতাব উদ্দিন চৌধুরীর সঙ্গে আড্ডা দিয়ে আসেন। অতীত স্মৃতি রোমন্থন করেন। যতদিন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বামী ড. ওয়াজেদ মিয়া বেঁচেছিলেন, তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। তিনি চিনতেন নূর মোহাম্মদ ও শাহ বদিকে। শেখ হাসিনা ও ড. ওয়াজেদ মিয়ার বিয়ে-পরবর্তী চট্টগ্রামের সংবর্ধনা অনুষ্ঠান আয়োজনেও তারা জড়িত ছিলেন।
লালদিঘি ময়দানে নিয়মিত ফুটবল খেলতেন মুসলিম হাইস্কুলের ছাত্র শাহ বদিউল আলম। ১৯৫৫ সালে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময় খেলতে গিয়ে লালদিঘি মাঠে দেখেন হাজার মানুষের জটলা। কোনো একটি মিটিং হচ্ছে, আর তাই খেলা হচ্ছে না। কিশোর বদিউল বসে যান মিটিংয়ের সামনে দর্শকসারিতে। মঞ্চে ছিলেন মওলানা আবদুল হামিদ ভাসানী, জহুর আহমেদ চৌধুরী ও এমএ আজিজ।
শাহ বদিউল বলেন, গোঁফওয়ালা তরুণ বয়সী একজন বক্তব্য দিতে ওঠেন। মাইকের ঘোষণায় জানতে পারি তার নাম শেখ মুজিব। তার বক্তব্যের স্টাইল আর ব্যক্তিত্ব আমাকে মোহিত করে। এমন বক্তব্য অতীতে শুনিনি। তারপর থেকে শেখ মুজিব আসার খবর পেলে তার বক্তব্য শোনার জন্য প্রতিটি মিটিংয়ে ছুটে যেতাম। ১৯৫৬ সালে নেতাদের বিশাল বহর নিয়ে চট্টগ্রামে আসেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী।
লালদিঘি ময়দানে অনুষ্ঠিত সেই সমাবেশে নেতাদের বহরে ছিলেন মানকির শরীফের পির, জাকারিয়া শরীফের পির, অল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি গোলাম মো. খান লুন্ধখোর, সিন্ধু প্রদেশের জিএম সাইয়েদ (যিনি পরিচিত ছিলেন ‘সিন্ধুর গান্ধী’ হিসেবে) প্রমুখ। আমার খেয়াল নেই সেদিকে। আমি তখনও শুনতে যাই শেখ মুজিবের ভাষণ। ভাষণ শুনে মুগ্ধতা সঙ্গী করে বাসায় ফিরি। একই বছর সরকারের শিল্প, বাণিজ্য ও দুর্নীতি দমন বিভাগের মন্ত্রী হিসেবে আবার লালদিঘি ময়দানে আসেন শেখ মুজিব। ওই সময়ের বক্তব্য এখনও কানে বাজে। তিনি বলেছিলেন- ‘“কে, কোথায়, কীভাবে দুর্নীতি করে তা তিন পয়সা খরচ করে পোস্ট কার্ডে লিখে আমাকে জানালে আমি দুর্নীতিবাজকে বের করে আনবো।’”
তারপর থেকে বাদ যায়নি চট্টগ্রামে বঙ্গবন্ধুর কোনো সভা, সমাবেশ। এরই মধ্যে নজর কাড়েন জননেতা জহুর আহমেদ চৌধুরীর। কাছে টেনে নেন তিনি। ১৯৬১ সালে মেট্রিক পাসের পর ১৯৬২ সালে নিয়মিত হন আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে। এরই মধ্যে বন্ধুত্বের গাঁটছড়া বাঁধেন নূর মোহাম্মদ চৌধুরীর সঙ্গে। তারপর থেকে দু’জনের যূথবদ্ধ চলা। এসময় তিনি শহর আওয়ামী লীগের সদস্য নির্বাচিত হন। দৃষ্টি কাড়তে সক্ষম হন তাঁর রাজনীতির আইডল শেখ মুজিবের।
শাহ বদিউল জানান, সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর ১৯৬৪ সালে আওয়ামী লীগ পুনর্গঠিত হয়। এরপর ঢাকার কাঁঠাল বাগানে বিচারপতি ইব্রাহিমের বাসায় আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন হয়। তখন আমি ঢাকায় বেড়াতে যাই। আমাদের নেতা জহুর আহমেদ চৌধুরীর সঙ্গে নবাবপুরের সেন্ট্রাল হোটেলে দেখা করতে গেলে তিনি আমাকে কাউন্সিলে নিয়ে যান। সেখানে দেখা হয় শেখ মুজিব, আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ ও তাজউদ্দিনের সঙ্গে। ১৯৬৩ সালে মৃত্যুর আগে শেষবারের মতো চট্টগ্রাম আসেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। সঙ্গে ছিলেন শেখ মুজিব। লালদিঘি ময়দানের জনসভায় আইয়ুববিরোধী জ্বালাময়ী বক্তব্য দেন তারা। এ জনসভায়ও আমি উপস্থিত ছিলাম।
১৯৬৬ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি লালদিঘি ময়দানে ছয় দফার জনসভা আয়োজন ও প্রচারণায় ভূমিকা রাখেন শাহ বদি ও নূর মোহাম্মদ। নেতাদের সঙ্গে মঞ্চেই ছিলেন তারা। শাহ বদিউল জানান, তিনি ১৯৬৮ সালে শহর আওয়ামী লীগের সমাজকল্যাণ সম্পাদক ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় ছিলেন স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর উপপ্রধান। বাহিনীর প্রধান ছিলেন নূর মোহাম্মদ চৌধুরী। ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ লালদিঘি মাঠে এ বাহিনীর সদস্যদের কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হয়।
স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী সকল আন্দোলন-সংগ্রামে তারা সক্রিয় ছিলেন। শহরের স্থানীয় বাসিন্দা হওয়ায় মিটিং, মিছিল আর হরতালে তাদের ডাক পড়ত। আছদগঞ্জের স্থানীয় তরুণ বলে কথা, তাই সাহসও কম দেখাতেন না নূর মোহাম্মদ চৌধুরী। মারপিটেও ছিলেন শক্তপোক্ত। এ কারণে কেউ কেউ তাকে ‘লোহা চৌধুরী’ নামেও ডাকতেন। তার এ অভিধা একসময় বঙ্গবন্ধুর কানেও পৌঁছে যায়। দল অন্তঃপ্রাণ, কর্মীবান্ধব এই মহান নেতাও কখনও নূর মোহাম্মদ চৌধুরীকে ‘লোহা চৌধুরী’ সম্বোধন করে উপস্থিত মহলে হাস্যরস ছড়িয়ে দিতেন।
শাহ বদি জানালেন ভয়াল ২৫ মার্চ রাতের কথা। ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণের খবর চট্টগ্রামে আসেনি তখনও। রাতে জহুর আহমেদ চৌধুরীর বাসায় গিয়ে বঙ্গবন্ধুর ফোনের সূত্র ধরে সেই খবর পান তারা। তখনই বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণার কথা জানান। সে প্রসঙ্গে শাহ বদি বলেন, নেতার নির্দেশ ছিল স্বাধীনতার ঘোষণা দ্রুত প্রচার করার।
জহুর আহমেদ চৌধুরীর নির্দেশ পেয়ে রাতে বেরিয়ে পড়ি স্বাধীনতার ঘোষণার বিষয়টি শহরে ছড়িয়ে দিতে। চৌধুরী সাহেবের বাসা থেকে বেরিয়ে কিছু দূর আসতে পেয়ে যাই চট্টগ্রাম ওয়াসার একটি জিপ। ড্রাইভারকে বললাম বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার কথাটি। বললাম, তার গাড়িতে সুযোগ দিলে বিষয়টি দ্রুত প্রচার করা সম্ভব হবে। উৎসাহী ড্রাইভার ছিল স্বাধীনতার পক্ষের। আমাদের প্রস্তাবে সে তৎক্ষণাৎ রাজি হয়ে গেল। তাকে নিয়ে চলে যাই মুসাফিরখানা মসজিদ-সংলগ্ন তমিজ মার্কেটে। ভোলার দোকান থেকে জিপের ছাদে মাইক লাগিয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার খবর শহরে প্রচার করি।
মুক্তিযুদ্ধের পর জাতির পিতা যখনই চট্টগ্রামে আসতেন, ডাক পড়ত নূর মোহাম্মদ-শাহ বদি জুটির। ঢাকায় গণভবন এবং ধানমন্ডি ৩২ নম্বরেও ছিল তাদের অবাধ যাতায়াত। বঙ্গবন্ধু কীভাবে যেন জানলেন, শাহ বদি তাঁর মায়ের যত্মআত্তি করার সময় পান না। সেই যাত্রায় বঙ্গবন্ধু চট্টগ্রাম এসে হোটেল শাহজাহানের বিশ্রামের ফাঁকে অমনই পেয়ে বসলেন শাহ বদিকে- এই তুই নাকি মায়ের খবর রাখিস না! ঠিক নাকি? খবরদার, মায়ের অযত্ন, অবহেলা যেন না শুনি। বঙ্গবন্ধুর এ অনুশাসনের গল্প শুনিয়ে শাহ বদি বলেন, ‘আহা নেতা! মানুষের ঘরের খবর, মায়ের খবর সবই রাখতেন তিনি।’
চুয়াত্তর সালের দিকে আমাদেরকে গোয়েন্দাগিরির দায়িত্ব দেয়ার পর বঙ্গবন্ধুকে কর্নেল ফারুকের নেতিবাচক কথার বিষয়ে অবহিত করি। একদিন মতিঝিল চেম্বার ভবনে গিয়েছিলাম এক কাজে। অনেকের সঙ্গে কথা হয়। একপর্যায়ে দেখলাম কর্নেল ফারুক উল্টাপাল্টা বলতে শুরু করেন। সঙ্গে সঙ্গে ৩২ নম্বরে গিয়ে বিষয়টি অবহিত করি।
রাজকীয় ঢঙে বঙ্গবন্ধুর তামাকের পাইপে টান দেয়া বেশ মুগ্ধ হয়ে খেয়াল করতেন শাহ বদি। নেতা পাইপে আয়েশ করে টান দেন- এ দৃশ্যটা ছিল শাহ বদির কাছে অনন্য, অতুলনীয়। তাই চট্টগ্রাম থেকে যাওয়ার সময় কখনও ৬ টাকা ২৫ পয়সা দামের এরিনমোর ব্র্যান্ডের টোব্যাকো নিয়ে যেতেন প্রিয় নেতার জন্য। স্মৃতির ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করতে একদিন নেতার কাছ থেকে চেয়ে আনেন একখানা পাইপ, যেটি এখনও শ্রেষ্ঠ স্মৃতির বাহক হয়ে আছে শাহ বদির জীবনে।
পঁচাত্তর সালের ১৫ আগস্ট রেডিওতে সপরিবারে জাতির পিতার হত্যাকাণ্ডের সংবাদটি ছিল আমার কাছে এ যাবৎকালের মধ্যে সবচেয়ে বড় দুঃসংবাদ। বিশ্বে এমন নেতা বিরল, যিনি ২০ বছর পরও কোনো কর্মীকে দেখলে নাম ধরে ডাক দিতেন। এমন কর্মীবান্ধব নেতা দুনিয়াতে আর আসবে না।
বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডের চার দিন পর শাহ বদি এবং নূর মোহাম্মদ বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের কুলখানির আয়োজন করেন। শাহ বদির এয়াকুবনগরের বাড়িতে আয়োজিত এই কুলখানিতে ছোবহানিয়া মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা সৈয়দ শামসুল হুদার নেতৃত্বে আলেমরা খতমে কোরআনে অংশ নেন। ১৯৭৬ থেকে বকশিরহাট ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের উদ্যোগে আনসার ক্লাবের পেছনের মাঠে ১৫ আগস্ট শোক দিবসের অনুষ্ঠানের আয়োজনের মূল উদ্যোক্তাও ছিলেন তারা। দিনভর মাইকে চলত ৭ মার্চের ভাষণ। ’৮২ সালে এখানকার আয়োজনে উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য শেখ আবদুল আজিজ ও ‘অগ্নিকন্যা’খ্যাত মতিয়া চৌধুরী। অথচ তখন বঙ্গবন্ধুর নাম নেয়া ছিল অপরাধ। শাসক গোষ্ঠীর শ্যেনদৃষ্টি উপেক্ষা করে দুঃসাহসিক কাজটি করে যেতেন মুজিব আদর্শের অনুসারী এ দুই বন্ধু।
লেখক: সাংবাদিক।