বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

এখনও যৌতুক!

  • লাভা মাহমুদা   
  • ৭ জুলাই, ২০২১ ১২:৪৪

সুস্থ মানসিকতা, বলিষ্ঠ জীবনবোধ এবং সমাজ কল্যাণমূলক, গঠনশীল দৃষ্টিভঙ্গিই পারে যৌতুকপ্রথা নির্মূলে সহায়তা করতে। এ ক্ষেত্রে তরুণদের ভূমিকা অগ্রগণ্য। তারাই পারে স্বশিক্ষিত ও বাস্তব জ্ঞানসম্পন্ন হয়ে যৌতুকপ্রথার বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলতে । এ ক্ষেত্রে শিক্ষাব্যবস্থা ও গণমাধ্যমকে অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করতে হবে। পুরুষদের অর্থলোভ ত্যাগ করে নারীর গুণ ও গৌরবের তাৎপর্য উপলব্ধি করে সমাজে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

সম্প্রতি মায়ের রাঁধুনি মেয়েটি বলছিল, 'আপা, বড় মেয়েটি ফর্সা ছিল, দেড় লাখ টাকায় বিয়ে দিতে পেরেছি, ছোট মেয়েটি শ্যামলা তাই তিন লাখের কমে কেউ রাজি হয় না।' উত্তরবঙ্গের একেবারে সীমান্তবর্তী এলাকায় ওদের বাড়ি।আবার এলাকার নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের শফিয়ারের (ছদ্মনাম) সঙ্গে আলাপ প্রসঙ্গে জানলাম, ধারদেনা করে মেয়ের বিয়েতে দুই লাখ টাকা ডিমান্ড ( যৌতুক) দিতে হয়েছে। এখন ছেলের বিয়েতে ডিমান্ড নিয়ে ধার শোধ করতে হবে।উত্তরবঙ্গেরই একটি নামকরা কলেজে অনার্স পড়ুয়া সুন্দরী মেয়েকে বেশ মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে বিয়ে দেয় তার অভিভাবকেরা, ভালো উপড়ি আছে; ছেলে এমন একটি সরকারি সংস্থায় চাকরি করে বলে।শুধু রাঁধুনি মেয়েটি নয়, শুধু শফিয়ার নয়, অনার্স পড়ুয়া সুন্দরী মেয়েটিও নয়; নিচতলা থেকে শুরু করে একেবারে ওপর তলার অবস্থাটা এখন এমনই। এটা একটা চেইন সিস্টেমে পরিণত হয়েছে। এই সিস্টেমের বাইরে কেউ যেতে পারছে না। এই সিস্টেমে কেউ অসহায় বোধ করছে, কেউ তৃপ্ত হচ্ছে। কিন্তু এ কেমন সিস্টেম? এ কেমন সমাজ ব্যবস্থা, যে ব্যবস্থায় একটি ঘৃণ্য অপরাধ সামাজিক-সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে, যে ব্যবস্থায় মানুষের মনুষ্যত্ববোধ বলে কিছু নেই।দেশে যৌতুকবিরোধী আইন আছে, প্রচারও আছে। কিন্তু আইনের ফাঁক গলিয়ে ঘৃণ্য প্রথাটি ঢুকে পড়েছে অন্দরমহলে। যৌতুক নেয়ার বা দেয়ার চিত্রটিও একরকম নয়। অর্থনৈতিক এবং সামাজিক অবস্থানের বাঁক বদলের সঙ্গে সঙ্গে যৌতুকের চাহিদারও তারতম্য ঘটে গেছে।

আবার উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণিত ‘যৌতুক’ শব্দটি উচ্চারণই হয় না। সেখানে যৌতুককে কদর দিয়ে ‘উপহার’ বলে ডাকা হয়। অনেক সামর্থ্যবান মেয়ের পরিবার উপযাচক হয়ে এই অপকর্মটি করে সামর্থ্যহীন পরিবারগুলোকে ফাঁসিয়ে দেয়। আর নিম্নবিত্ত পরিবারগুলোতে সরাসরি অর্থের লেনদেন হয়, কোনোরূপ রাখঢাক না করেই।এটা একুশ শতকের বাংলাদেশ, মধ্যযুগ নয়। যৌতুকের মতো নির্লজ্জ ও অমানবিকপ্রথা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিলীন হওয়ার কথা। কিন্তু অশিক্ষা, কুশিক্ষা, স্বার্থপরতা, অপরিসীম লোভ আর হৃদয়হীনতা আজও টিকিয়ে রেখেছে এই ঘৃণ্য প্রথাকে। সভ্যতার বিকাশ ঘটেছে কিন্তু সমাজে এর গুণগত কোনো ছাপ পড়েনি, উন্নতি ঘটেনি সামাজিক এবং মানসিক অবস্থার, পরিবর্তন ঘটেনি অবস্থানেরও। পণপ্রথার শেকড়কে সমূলে উচ্ছেদ করার জন্য সামাজিকভাবে যতটা আন্দোলন ও সচেতনতার প্রসার ঘটানোর প্রয়োজন ছিল, তা হয়নি। যৌতুক আছে, খুব প্রবলভাবেই আছে, ভিন্ন ভিন্ন ফর্মেটে, ভিন্ন ভিন্ন বাস্তবতায়। এর বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত গোটা সমাজ।বিয়ের জন্য হাতপাতা লজ্জাজনক ও অসম্মানের ব্যাপার, যৌতুক নেয়ার অর্থ যে ভিক্ষার ঝুলি হাতে নেয়া এবং এটা করলে পাত্রপক্ষকে ঘৃণার চোখে দেখা হবে- এই বিষয়গুলোকে আমরা প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি বরং খুব যত্নে লালন করার সুযোগ দিয়েছি।

বাংলাদেশের শহরে-নগরে, গ্রামে ঘরে ঘরে নারীরা যৌতুকের কারণে মুখ বুজে সহ্য করে যাচ্ছে নির্যাতন। লোকলজ্জা এবং পারিবারিক অসম্মানের ভয়ে অনেকেই গোপনে মুখ লুকিয়ে কাঁদে। অথচ যে অসম্মান হওয়ার কথা ছিল পুরুষের, তা ভীষণভাবে চেপে বসেছে নারীর কাঁধে। এ প্রথা পুরুষকে অনন্য উচ্চতা দিয়ে নারীকে সামাজিকভাবে হেয় ও পণ্যে পরিণত করেছে। শুধু নারী ও পুরুষের মধ্যে অসমতাই সৃষ্টি নয় বরং সামাজিক কাঠামো ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করে, সমগ্র দেশের উন্নয়নের গতিকে মন্থর করেছে।

পুরুষশাসিত সমাজে, পুরুষের অহংবোধের কারণে নারী উপযুক্ত মর্যাদা না পেয়ে অবমূল্যায়িত হয়। এর ফলে সৃষ্ট অর্থনৈতিক এবং সামাজিক পরনির্ভরশীলতা নারীকে অসহায় করে তোলে। এটাই যৌতুকপ্রথা সৃষ্টির প্রধানতম কারণ। এছাড়া অধিকারহীনতা, অশিক্ষা, কুশিক্ষা, সামাজিক প্রতিপত্তি ও প্রতিষ্ঠা লাভের মোহ, উচ্চাভিলাষী জীবনযাপনের বাসনা ইত্যাদি যৌতুকপ্রথাকে বিকশিত হতে উদ্বুদ্ধ করেছে।টিভি, ফ্রিজ, এসি, ওয়াশিং মেশিন, মোটর সাইকেল, সোনার গহনা, ফার্নিচার, ফ্ল্যাট, গাড়ি, বাড়ি, টাকাপয়সা কোনোকিছুই বাদ নেই যৌতুক বা উপহারের নামে পণের তালিকায়।

পারিবারিক মর্যাদা অনুযায়ী তালিকার কিছুটা রকমফের হয় মাত্র। মেয়েকে শ্বশুরবাড়ি পাঠানোর সঙ্গে সঙ্গে এসব পণ্যও পাঠাতে হয় ছেলেপক্ষের দাবি অনুযায়ী অথবা স্ট্যাটাস ঠিক রাখার জন্য। এই মাইন্ড সেট থেকে ছেলে এবং মেয়ে উভয়পক্ষই যদি বের হতে না পারে, তাহলে এই প্রবল সমস্যা সহসাই হালকা হওয়ার সুযোগ নেই। যৌতুকের ভয়ংকর থাবায় নারীর সামাজিক ও মানবিক মর্যাদা লাঞ্ছিত হচ্ছে। প্রতিনিয়ত স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির আবদার মেটাতে গিয়ে অনেক মেয়ের পরিবার নিঃস্ব থেকে নিঃস্বতর হয়েছে। যৌতুকের কারণে অত্যাচার ও নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে কেউ স্বামীগৃহ ত্যাগ করছে কেউবা আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছে। তালাকের মতো ঘটনা ঘটছে অহরহ। তাইতো এখনও দেশের অধিকাংশ পিতামাতাই কন্যা সন্তানের জন্মকে সানন্দে গ্রহণ করে না। এত ধরনের শিক্ষা, এনজিওদের প্রচার-প্রচারণা, আইন ও শাস্তি সত্ত্বেও সমাজে যৌতুক টিকে আছে শক্তভাবেই।নারীনেত্রী এবং মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, যৌতুকপ্রথা বন্ধ করতে সমাজে নারীর ক্ষমতায়ন প্রয়োজন৷ একটি মেয়েকে লেখাপড়া শিখিয়ে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করে তুললে সমাজ আর তাকে বোঝা ভাবতে পারবে না এবং ধীরে ধীরে কমে আসবে যৌতুক ও নারী নির্যাতন৷ঢাকার আদালতের বিচারিক নিবন্ধন খাতার হিসাব অনুযায়ী, গত ১৭ বছরে ঢাকায় ৩৭৪ নারীকে যৌতুকের জন্য হত্যা করা হয়েছে। প্রতিবছর ঢাকায় যৌতুকের জন্য গড়ে ২২ নারীকে হত্যা করা হয় এ হিসাবে। ঢাকা মহানগর এলাকায় গত এক বছরে যৌতুকের জন্য ১৪ নারী হত্যার শিকার হন।বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্যমতে, যৌতুককে কেন্দ্র করে ২০১৬ সালে ১৭৩ নারী খুন হয়েছেন। নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ৩৬২টি। আর গত ৫ বছরে এ সংখ্যা ২ হাজারের বেশি। হত্যার শিকার হয়েছেন ১ হাজার ১৫১ নারী। ১৪টি দৈনিক সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরের ভিত্তিতে এ হিসাব রাখে সংগঠনটি।বাংলাদেশে ১৯৮০ সাল থেকে আইন দিয়ে যৌতুক নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এরপর কয়েক দফায় সংশোধন করে ‘যৌতুক নিরোধ আইন, ২০১৮’ নামে নতুন আইন পাস হয়। এর ফলে নারী নির্যাতনবিরোধী আইনে যৌতুকের বিরুদ্ধে শাস্তির বিধান নিশ্চিত করা হয়েছে। এই আইনে বলা হয়েছে যৌতুকের কারণে কোনো নারীর মৃত্যু হলে এর শাস্তি হবে মৃত্যুদণ্ড। মৃত্যু ঘটানোর চেষ্টা করা হলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হবে। যৌতুকের কারণে আহত করা হলে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হবে। আহত করার চেষ্টা করা হলে অনধিক ১৪ বছর এবং সর্বনিম্ন ৫ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করা হবে এবং সকল ক্ষেত্রে আর্থিক দণ্ডের বিধান করা হয়েছে।‘কাজীর গরু কেতাবে আছে, গোয়ালে নেই’-এর মতো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আইনের শক্ত প্রয়োগ নেই৷ মামলা হলেও শক্ত এভিডেন্সের অভাবে অথবা যেকোনো কারণেই হোক, বেশিরভাগ মামলার বিচারই পাওয়া যায় না৷যৌতুকপ্রথার মূল উৎপাটনের জন্য আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করে যৌতুক দেয়া ও নেয়াকে ঘৃণ্য অপরাধ হিসেবে সামাজিক স্বীকৃতি দিতে হবে।সুস্থ মানসিকতা, বলিষ্ঠ জীবনবোধ এবং সমাজ কল্যাণমূলক, গঠনশীল দৃষ্টিভঙ্গিই পারে যৌতুকপ্রথা নির্মূলে সহায়তা করতে। এ ক্ষেত্রে তরুণদের ভূমিকা অগ্রগণ্য। তারাই পারে স্বশিক্ষিত ও বাস্তব জ্ঞানসম্পন্ন হয়ে যৌতুকপ্রথার বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলতে ।

এ ক্ষেত্রে শিক্ষাব্যবস্থা ও গণমাধ্যমকে অগ্রগণ্য পালন ভূমিকা করতে হবে। পুরুষদের অর্থলোভ ত্যাগ করে নারীর গুণ ও গৌরবের তাৎপর্য উপলব্ধি করে সমাজে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সর্বোপরি নারীকে অর্থনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠা লাভের মধ্য দিয়ে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে হবে। অপরিহার্য করে গড়ে তুলতে হবে নিজেকে। তাহলেই উপড়ে পড়বে যৌতুক নামক বিষবৃক্ষের শেকড়, নারীরা মুক্ত বায়ুতে শ্বাস নিতে পারবে হৃদয় পূর্ণ করে।

এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না, এটি অন্যায় এবং ভারি অন্যায়। দেশের মাটিতে চলমান সমাজে এমন অন্যায় আর একটিও হতে দেয়া যায় না। যদিও এটাই দেশের সামাজিক বাস্তবতা। তাই শুধু চিৎকারে কাজ হবে না। সিস্টেমকে সমূলে উৎপাটন করতে প্রতিটি মানুষকে যে করেই হোক যৌতুকের বিরুদ্ধে সংগঠিত করতে হবে, একই প্ল্যাটফর্মে সংযুক্ত করতে হবে। কাজটা দুরূহ কিন্তু অসাধ্য নয়, নইলে এই অভিশপ্ত ব্যবস্থা থেকে কোনোক্রমেই বের হওয়া যাবে না।

লেখক: প্রাবন্ধিক-শিক্ষক, কলাম লেখক।

এ বিভাগের আরো খবর