সম্প্রতি রাজধানীর পুরান ঢাকার কলতাবাজারে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী চলতি পথে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন। রাত সাড়ে ৯টার দিকে বাসায় ফেরার পথে এক ব্যক্তি ওই শিক্ষার্থীকে শারীরিকভাবে হেনস্তা ও যৌন হয়রানি করেন। মেয়েটি চিৎকার করলে হেনস্তাকারী ব্যক্তিটি পালিয়ে যান। তবে ওই শিক্ষার্থী অভিযোগ করেছেন, আশপাশে অনেক লোকজন ছিল কিন্তু কেউ তাকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসেনি। এমন ঘটনা একজন নারীর জন্য অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের এবং কষ্টের।
বেশির ভাগ নারী সরল বিশ্বাসে একজন পুরুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে বা তার সান্নিধ্য পেতে ভালোবাসে। তবে অনেকেই তার পছন্দের পুরুষ উপযুক্ত কি না, সে বিচারের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। এমন নির্বুদ্ধিতার কারণে তাকে ঠকতে হয়। শুধু হেনস্তা বা শারীরিক নির্যাতন নয়, হতে হয় ধর্ষণের শিকার। এমনকি কখনও কখনও জীবন নিয়েও তারা শঙ্কিত হয়ে পড়েন। এরই মধ্যে খবরে প্রকাশ পেয়েছে ফতুল্লায় প্রেমিকের সঙ্গে ঘুরতে বের হয়ে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন এক গার্মেন্টস কর্মী। ধর্ষণের শিকার গার্মেন্টস কর্মীর সঙ্গে চার মাস আগে এক যুবকের সঙ্গে পরিচয় হয়। সেই পরিচয়ের সূত্র ধরে গত এক মাস তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তারা প্রায় সময় বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে বের হতেন।
অন্য দিনের মতো সেদিনও ঘুরতে গিয়ে একপর্যায়ে গভীর রাতে বুড়িগঙ্গা নদীর পাড়ে চলাচলের রাস্তার পাশে তরুণীকে ধর্ষণ করে। এ ধরনের অনেক ঘটনা ঘটছে। তবে রাস্তাঘাট বা যানবাহনে হেনস্তা বা যৌন হয়রানির শিকার হলে তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিবাদের উদাহরণ নেই বললেই চলে।
বছর দশ কি বারো আগে একবার ছিনতাইয়ের ঘটনায় এখনও বিব্রতবোধ করি। রাজধানীর ফার্মগেটে বাসের জানালা দিয়ে গলার চেইন ছিনিয়ে নিল। তার নখের আঁচড়ে গলা থেকে সামান্য রক্ত বের হলো। সঙ্গে আমার শিশুকন্যা। ভয়ে চিৎকার করে উঠল। বাস ড্রাইভার-হেলপার বা যাত্রী কেউ কোনো শব্দও করেনি। নির্বাক দৃষ্টিতে আমাদের অসহায় মা-মেয়ের দিকে তাকিয়ে দেখল। শুধু আতঙ্কিত মেয়েটা অনেক দিন ঘুমের মধ্যে আমাকে জড়িয়ে ধরত।
শুধু ছিনতাই নয়, বাংলাদেশের সড়ক, ফুটপাত কিংবা জনসমাগম স্থানগুলোতে দৈনন্দিন প্রয়োজনে চলাফেরার সময় কতজন নারী যৌন হেনস্তার শিকার হন তার হিসাব নেই। যানবাহন কিংবা রাস্তাঘাটে চলাফেরার সময় এ ধরনের অপ্রীতিকর অভিজ্ঞতার খবর প্রায়ই শোনা যায়।
আশির দশকে মফস্বলের একটা ঘটনাকে কেন্দ্র করে এখনও শিউরে উঠি। তখন কলেজে পড়ি। তখন সেকেন্ড ইয়ারের শিক্ষার্থী। দুপুরে ক্লাস শেষ করে বাসায় ফেরার পথে আমার এক বান্ধবীকে পথরোধ করে অন্য এলাকার কিছু বখাটে ছেলে। জোর করে রিকশা থেকে নামিয়ে তাদের গাড়িতে নিয়ে যাবে। সে রিকশার হুড শক্ত করে ধরে চিৎকার করতে থাকে। পাড়ার পুরুষ-মহিলারা হুড়মুড় করে বেরিয়ে এলে বখাটেরা পালিয়ে যায়। আকস্মিক অনাকাঙ্ক্ষিত সে ঘটনায় আমার বান্ধবী ট্রমায় ভোগে দীর্ঘদিন।
নারীদের এমন অসহায় মুহূর্তে এগিয়ে আসা মানুষের কথা কমই শোনা যায়। পৃথিবীর অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও এখনও অনেকে মনে করে নারী-বিষয়ক যেকোনো আলোচনা অশ্লীল, বিতর্কিত।
চলতি বছরের শুরুর দিকে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক পরিচালিত ‘নারীর জন্য যৌন হয়রানি ও দুর্ঘটনামুক্ত সড়ক’ শীর্ষক এক গবেষণায় দেখা যায়, গণপরিবহনে যাতায়াতের সময় ৯৪ শতাংশ নারী কোনো না-কোনোভাবে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন। আর হেনস্তাকারীদের অধিকাংশই মধ্যবয়সী বা বয়স্ক পুরুষ।
আবার আরেক বেসরকারি সংস্থা অ্যাকশন এইডের এক জরিপ বলছে, তাদের জরিপে অংশ নেয়া নারীদের ৮৪ শতাংশ জানিয়েছেন, তারা জনসমাগমস্থলে অশালীন মন্তব্য শুনেছেন এবং পুরুষেরা যৌন হয়রানি করার সুযোগ খুঁজেছিলেন। অর্ধেকের বেশি নারী গণপরিবহনে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন।
এ ছাড়াও কয়েক বছর আগে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায় যে, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ৭৬ শতাংশ ছাত্রীই কোনো না-কোনোভাবে যৌন হয়রানির শিকার হন। এর মধ্যে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এ হার সবচেয়ে বেশি: ৮৭ শতাংশ।
চলন্ত বাসে নারী লাঞ্ছনা বা ধর্ষণের ঘটনাও কম ঘটেনি। ধর্ষণের পর কিছু নারীকে হত্যাও করা হয়েছে। চলন্ত বাসে ধর্ষণে শিক্ষার্থী থেকে গার্মেন্টস কর্মীও বাদ পড়েনি।
মহামারি করোনায় সারা বিশ্বের মানুষ যখন শুধু বেঁচে থাকা নিয়ে আতঙ্কিত, এই পরিস্থিতিতেও চলছে নারীর ওপর নির্যাতন। সারা বিশ্বে পারিবারিক সহিংসতা অনেক বেড়ে গেছে এবং চরম অনিরাপত্তায় ভুগছে নারীরা।
মানুষ ঘরবন্দি হয়েছে, অনেকে বেকার হয়ে পড়েছে, উদ্যোক্তাদের বাজার মন্দ আর এসব কারণে পুরুষের যেমন মেজাজ খিটখিটে হয়েছে নারীরাও নানা ঝক্কি পোহাতে বিরক্তবোধ করছেন। এ পরিস্থিতিতে ঘরে ঘরে নানা অশান্তির খবর পাওয়া যাচ্ছে।
করোনা পরিস্থিতি নারীর জীবনকে ভিন্নমাত্রায় প্রভাবিত করছে। বাড়িভাড়া পরিশোধ নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া, দীর্ঘ সময় ঘরে থাকায় পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়েন, বিবাহবিচ্ছেদ, আত্মহত্যা, নারী সেবিকাকে দমন করার জন্য সাত দিন পরিত্যক্ত পুকুরে থাকতে বাধ্য করা, এসব অমানবিক অনেক খবর শোনা যাচ্ছে।
মহামারির এই দুঃসময়ে বাসগৃহ একজন নারী বা শিশুর কাছে সবচেয়ে নিরাপদ হওয়ার কথা। কিন্তু এই সময়ে সামাজিক দূরত্বকে পুঁজি করে নারীর ওপর অত্যাচারের হার বাড়িয়ে দিয়েছে কিছু পুরুষ। মানবিক বিপর্যয়-শিশু-বৃদ্ধ, কিশোর-কিশোরীসহ যেকোনো মানুষের স্বাভাবিক জীবনকে বিপর্যস্ত করেছে। মহামারিকালেও অসংখ্য পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবে কোনো পরিবর্তন আসেনি। আর কবে এই দেশের নির্যাতনকারী পুরুষরা সত্যিকারের মানবিক মানুষ হয়ে উঠবে?
স্বাভাবিক সময়ে বাংলাদেশে প্রায় ৮০ শতাংশ নারী কোনো না কোনো ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়। আর ৯০ শতাংশ নারী যৌন নিপীড়নের শিকার হয়। নারী-পুরুষ সম্পর্ক ও সমতার ক্ষেত্রে কোভিড-১৯-এর প্রভাব সম্প্রতি ব্র্যাকের একটি জরিপে (এপ্রিল ২০২০) উঠে আসে- করোনা পরিস্থিতিতে শিশুসহ পরিবারের সকল সদস্যই বেশিরভাগ সময় বাসায় থাকে। এই সময়ে আগের তুলনায় গৃহস্থালি কাজের চাপ এবং কর্মঘণ্টা বেড়েছে বলে অভিমত দেন ৯০ শতাংশ নারী। কর্মজীবী নারীদের অবস্থা আরও শোচনীয়। করোনা সংক্রমণ থেকে বাঁচতে কাজের মানুষের সাহায্য নিতে পারছে না। একদিকে অফিসের কাজ আবার ঘরে ফিরে সংসার সামলাতে তাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে।
জরিপে আরও উঠে আসে, বাংলাদেশের নারীদের জীবনে নির্যাতনের কথা। এর হার স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে করোনাকালে বেড়েছে ৩২ শতাংশ।
বিশ্বব্যাপী কোভিড-১৯ বদলে দিচ্ছে মানুষের জীবনাচরণ। বেশ কিছু পরিবর্তন এসেছে খাদ্যাভ্যাসে বা স্বাস্থ্য সচেতনতায়। করোনা সমস্যা মানব জাতিকে আজ মানবিক মূল্যবোধের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে। যে কাঠগড়ায় ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণি-জাতি সব একাকার। মানবিক হওয়ার সময় এসেছে, আর উপলব্ধি করতে হবে অর্থবিত্ত নয়, সুস্বাস্থ্যই সম্পদ।
লেখক : সাংবাদিক