করোনা না করোনার ভূত কোনটি বেশি শক্তিশালী! এটিই এই মুহূর্তের সবচেয়ে জনগুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। আমরা একদিকে দেখতে পাচ্ছি করোনার বিস্তার। জেলায় জেলায় অক্সিজেন থেকে শুরু করে চিকিৎসা উপকরণের অভাবসহ নানাবিধ সংকট, আর অন্যদিকে সেই বিষয়ে যথাযথ মনোযোগ না দিয়ে জনগণকে ঘরে আটকে রাখতে নানা ধরনের বিধিনিষেধ।
চলছে শাটডাউন। শাটডাউন শুরু হওয়ার আগে আমরা দেখলাম ঢাকা ছাড়ছে মানুষ। আর মিডিয়াতে তার সংবাদ।
আচ্ছা এই যে মানুষ স্বাস্থ্যবিধি না মেনেই দলে দলে শহর ছাড়ে, কেন ছাড়ে? এই ছাড়াছাড়ি কি এমন যে, মানুষ নিরাপদ আশ্রয় হতে অনিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছতে চায় না, বরং এমন যে মানুষ নিরাপদ আশ্রয়েই শেষ বিচারে পৌঁছতে চায়!
কোন আশার টানে কেন মানুষ শহর ছেড়ে গ্রামে আসে আর কেনই বা আবার সেই শহর ছাড়ে! এই বিষয়ক কী কী পরিসংখ্যান আছে আমাদের দেশে? এখন কি দেশে কোনো যুদ্ধ পরিস্থিতি চলছে? তবে দলে দলে মানুষ কেন শহর ছাড়ছে?
এই যে করোনার বিস্তার রোধের একমাত্র সমাধান হচ্ছে ঘরে থাকা, সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা, মাস্ক পড়া আর ঘন ঘন হাত ধোয়া। তবে মানুষ কেন ঘরের বাইরে বের হচ্ছে?
মুষ্টিমেয় মানুষের কাছে ঘরের বাইরে বের হওয়া অ্যাডভেঞ্চার হলেও বেশির ভাগ মানুষই কিন্তু জীবন ও জীবিকার টানেই ঘরের বাইরে বের হয়। তাকে কাজ করে উপার্জন করতে হয়। কয়জন আছে আর সেই সৌভাগ্যবান যারা ঘরে খাবার দাবার মজুদ করে লকডাউন উপভোগ করতে পারে?
আর সেই ঘরই বা কয়জনের আছে যেখানে সামাজিক দূরত্ব তথা শারীরিক দূরত্ব মেনে সবাই নিরাপদে ঘরে থাকতে পারে। বরং কারো কারো কাছে তো ঘরের বাইরে ঘরের উঠান কিংবা শহরাঞ্চল হলে ঘরের সামনে রাস্তা আরো বেশি ফাঁকা বা নিরাপদ মনে হয়।
আর মাস্ক পড়া, প্রতিদিন সেই মাস্ক ধোয়া আর ঘন ঘন হাত ধোয়া- সেই পানীয় জলের ব্যবস্থা কয়জনের আছে? কিংবা স্যানিটাইজার কেনার কথা বাদই দিলাম ঘন ঘন হাত ধোয়ার সাবান কেনার সামর্থ্যই বা কয়জনার আছে?
করোনা কি তবে ধনীক শ্রেণির আর সামর্থ্যবানেরই রোগ! অর্থাৎ করোনা মোকাবিলা করতে পারবে একমাত্র ঘরওয়ালা, বাড়িওয়ালা, বাসায় খাদ্য মজুদ করতে পারা, মাস্ক আর সাবান, স্যানিটাইজার কেনা তথা ধনীক শ্রেণির জনগোষ্ঠীই কেবল করোনা মোকাবিলা করতে পারবে!
করোনা উপসর্গে মারা যাচ্ছে মানুষ। কিন্তু করোনার কারণে আরো যে নানা ধরনের অব্যবস্থাপনার শিকার খাদ্যর অভাবে, চাকরির অভাবে, চিকিৎসার অভাবে, দুঃশ্চিন্তা আর অসহায়ত্বের শিকার হয়ে মারা যাচ্ছে আরও কতজন? তার খবর কি আছে আমাদের কাছে?
আমরা তো আগে মাঝে মধ্যে নেতাদের কাছ শুনতাম, করোনার চেয়ে আমরাই বেশি শক্তিশালী। এখন কোথায় সেইসব ফাঁকাবুলি। আমাদের স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়ে, নানা ধরনের ভাতা চালু হয়। কিন্তু সেসবের উপকারভোগী কারা হয় আর কারা হয় শিকার?
করোনা মোকাবিলায় জেলায় জেলায় আর পাড়ায় পাড়ায় লকডাউন-শাটডাউনের পরিবর্তে একে জাতীয় দুর্যোগ হিসেবে মেনে নিয়ে আমরা কি পারতাম না, দল-মত নির্বিশেষে শ্রেণি-পেশার ঊর্ধ্বে উঠে জাতীয়ভাবে একটি সমন্বিত পরিকল্পনা করতে। এবং জাতীয়ভাবে সেই পরিকল্পনাকে স্থানীয়ভাবে বিস্তৃত করতে?
করোনা সংক্রমণকালীন এই দীর্ঘ সময়ে প্রথম থেকে উদ্যোগ নিলে স্থানীয়ভাবে প্রতি পাড়া-মহল্লায় একটি করে করোনা প্রতিরোধ টিম গঠন করা যেত। যেই টিম সেই এলাকায় বসবাসরত অধিবাসীদের কথা চিন্তা করে স্থানীয়ভাবে করোনা মোকাবিলায় উদ্যোগ নিতে পারত। কার ঘরে খাবার নেই, কার কোথায় চাকরি, কে কোন পেশায় জড়িত, কার জন্য অবশ্য মান্য কী নিয়ম হতে পারে, কার ঘরে বয়স্ক মানুষ আছে, কার ঘরে করোনার উপসর্গযুক্ত রোগী আছে, কার কী ধরনের চিকিৎসা দরকার হতে পারে, কার ঘরে বাইরে থেকে লোক আসছে? স্থানীয়ভাবে গঠিত কমিটির পক্ষেই একমাত্র সম্ভব এসব বিষয় যথাযথভাবে তদারকি করা।
এসব উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, স্থানীয় উপজেলা প্রশাসন আর সামগ্রিকভাবে তদারকি করবে জেলা প্রশাসন। তবেই না সম্ভব ফাঁকা আওয়াজের বদলে করোনা মোকাবিলায় প্রকৃত উদ্যোগ গ্রহণ!
আমরা জানি, আমাদের দেশে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে বার্তা না আসলে কখনওই এরকম উদ্যোগ বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। সময়ের দাবি এখন প্রশাসন, রাজনৈতিক দল আর স্থানীয় জনপ্রতিনিধি মিলে দেশের সমস্ত শক্তিগুলোকে একত্রিত করে কাজ করার। পরিস্থিতি মোকাবিলায় স্থানীয়ভাবে সাংগঠনিক কাঠামো ও প্রশাসনিক কাঠামো তৈরি করা। সামগ্রিক একটি নীতিমালা প্রণয়ন করে অগ্রসর হওয়া।
আর এজন্য দরকার জাতীয়ভাবে একটি আহ্বান। যেমন ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে ঘোষিত হয়েছিল, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’- তেমনি এক উদাত্ত আহ্বান। করোনা মোকাবিলায় সেই রাষ্ট্রনায়কোচিত ঘোষণা আসবে কবে?
লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা ও প্রাবন্ধিক।