নদীর দেশ বাংলাদেশ। হাজারও নদ-নদীবেষ্টিত এই বাংলার জনপদ। অসংখ্য স্কুল, কলেজ, হাট-বাজার, বন্দর এসব নদীকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে। কালের বিবর্তনে অযন্ত, অবহেলায়, দখল-দূষণে আমরা হারাতে বসেছি নদীমাতৃক বাংলাদেশের ঐতিহ্য আর পরিচিতি। একসময় বলা হতো হাজার-বারো শ নদী আছে এই বাংলায়। বিলীন হতে হতে এখন তা পাঁচ-ছয় শতে নেমে এসেছে।
খবরের কাগজে নিত্য দেখতে পাই নদ-নদীগুলোর দুঃখ-দুর্দশার করুণ চিত্র। নদীতীরের মানুষগুলোর অসচেতনতা ও সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের দায়িত্বহীনতার কারণে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এর বিপরীতে নদী-দখল দূষণের প্রতিবাদে মিছিল, মানববন্ধন, সমাবেশ চালিয়ে যাচ্ছে দায়িত্বশীল নাগরিক ও পরিবেশ-অন্তঃপ্রাণ মানুষেরা। কিন্তু তাতে পরিস্থিতি বদলাচ্ছে কই? বরং এমন সব সংবাদ আমাদের শুনতে হচ্ছে, দেখতে হচ্ছে, যাতে চূড়ান্তভাবে স্তব্ধ হওয়া ছাড়া উপায় কী!
নেত্রকোণা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার ‘বেতাই নদী’ কেন্দুয়া তথা দেশের মানুষের কাছে, বেতাই একটি নদী হিসেবেই পরিচিত। অন্তত সরকারি নথিপত্র তাই বলে। এই অঞ্চলের মানুষের জীবন-যাপনের সঙ্গে সুদীর্ঘকাল ধরে জড়িয়ে আছে যে নদী, সেটিকে খাল হিসেব রূপান্তর করার উদ্যোগ নেয় একটি অসাধু মহল। স্বার্থান্বেষী মহল বেতাইকে নদীর পরিবর্তে খাল দেখিয়ে ১১ কিলোমিটার এলাকা সরকারি প্রকল্পের মাধ্যমে খননকাজও শুরু করে দেয়। এর মধ্যে অনেক দূর এগিয়ে যায় তারা। বিষয়টি এলাকাবাসীর নজরে এলে তারা এর প্রতিবাদ করে। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় স্থানীয় পরিবেশবাদী সংগঠন। তারা যোগাযোগ করে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন, ময়মনসিংহ বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের দপ্তরে।
আশার কথা হলো, অবশেষে তাদের আন্দোলন সফল হতে যাচ্ছে। কীভাবে এমনটি হলো, তা জানতে বিষয়টি নিয়ে তদন্ত চলছে বলে জানা গিয়েছে। নেত্রকোণার জেলা প্রশাসক কাজী মো. আবদুর রহমান সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের নির্দেশনা অনুযায়ী ‘বেতাই খাল’কে প্রকৃত ভূমি রেকর্ড অনুযায়ী ‘বেতাই নদী’ হিসেবে পুনঃস্থাপনে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে।
বেতাই নদী কীভাবে খালে পরিণত হলো রেকর্ড যাচাই করা হচ্ছে এবং জেলা প্রশাসনের অনুমতি ছাড়া কীভাবে নদীকে খাল বানানো হয়েছে, তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। নতুনভাবে এই প্রজেক্টের নামও সংজ্ঞায়িত করা হবে।
আমরা নেত্রকোণার জেলা প্রশাসকের বক্তব্য শুনে আশ্বস্ত হতে চাই। একই সঙ্গে আশা করি এবার নিশ্চয়ই বেতাই নদীকে খাল বানানোর অপচেষ্টা চূড়ান্তভাবে রুখে দেয়া যাবে। সেইসাথে এই অপকর্মের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের বিচারের আওতায় আনা হবে।
এই যে নদীর নাম পরিবর্তন করে খাল খননের প্রকল্প এনে নামকাওয়াস্তে মাটি কেটে প্রকল্পের টাকা আত্মসাতের পরিকল্পনা এখন দেশের নানা জায়গাতেই চলছে। এই ধরনের অন্যায় কাজ আর কোথাও সংগঠিত হতে দেয়া যাবে না। এর জন্য নদীতীরের মানুষকেই সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। রুখে দিতে হবে পরিকল্পিতভাবে নদীহত্যার সমস্ত ষড়যন্ত্র।
বেতাই নদী নিয়ে যখন খোঁজখবর নেয়া হচ্ছিল, তখনই জানা গেল, কয়েক মাস আগে এমনই একটি ঘটনা ঘটেছে হবিগঞ্জের নবীগঞ্জে। সেখানকার এরাবরাক নদীকে ও খাল দেখিয়ে খননকাজ চালিয়েছে একটি অসাধু চক্র। এরাবরাক খাল পুনঃখনন প্রকল্পের নামে আস্ত একটা নদীকেই খাল তৈরির অপচেষ্টা চলছিল। নেত্রকোণার মতো নবীগঞ্জবাসীও এমন অন্যায় প্রতিরোধে মাঠে নামে।
এরাবরাক নদী কোনো মৃত নদী নয়। শুকনো মৌসুমে পানি কম থাকলেও বর্ষায় ফিরে পায় পূর্ণ যৌবন। নদীটি হবিগঞ্জের আউশকান্দি ও মৌলভীবাজারের খলিলপুরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত। অবাক করার মতো বিষয় হলো, স্থানীয়দের দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি এরাবরাক নদীর ওপর ৭ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি ৯৬ মিটার দীর্ঘ সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সে নদীকেই খাল দেখিয়ে ১০০ ফুট প্রস্থে প্রায় ৬ কিলোমিটার পুনঃখনন প্রকল্প হাতে নিয়েছিল সরকারি কর্তৃপক্ষ। প্রকল্প বাস্তবায়নে কাজ করছে এলজিএস কমিটি এরাবরাক খাল পানি ব্যবস্থাপনা সমবায় সমিতি লিমিটেড।
নদীকে অবৈধভাবে খালে রূপান্তরের নেত্রকোণা-হবিগঞ্জের এই দুটো প্রকল্পই জাইকার অর্থায়নে বাস্তবায়ন করছে এলজিইডি। বিষয়টি যখন প্রকাশিত হয়, তখন বিদেশি দাতা সংস্থার কাছে আমাদের দেশ সম্পর্কে নিশ্চয়ই কোনো ইতিবাচক বার্তা যায় না। বিষয়টি খেয়াল রাখা দরকার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকেই। জানি না, কীভাবে এসব হয়, হচ্ছে। আমরা জানি না, খতিয়ে দেখছি, এই দায়িত্ব আমাদের নয় ইত্যাদি বলে পার পাওয়ার সুযোগ নেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের।
নদীর প্রাণ আছে। নদী একটি জীবন্ত সত্তা। নদীর অধিকার আছে আমাদের মতো বেঁচে থাকার। নদী সুরক্ষায় হাইকোর্টের যুগান্তকারী রায় একটি বড় শক্তি হিসেবে কাজ করছে। আইন অনুয়ায়ী জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন দেশের সব নদীর অভিভাবক। এই সময়ে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে আরও দায়িত্বশীল হতে হবে।
জেলা-উপজেলায় নদী সুরক্ষার জন্য যে সমস্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে, সেগুলোকে সচল করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এই কমিটিগুলো সচল হলে, একই সঙ্গে জবাবদিহি তৈরি হলে অন্ততপক্ষে নদীকেন্দ্রিক সরকারি প্রকল্পগুলোতে অনেকটাই স্বচ্ছতা ফিরে আসবে বলে আশা করা যায়। আমরা চাই নদী নিয়ে আরও ব্যাপকভাবে আলাপ-আলোচনা হোক। সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ বাড়ুক।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বিশ্বব্যাপী পরিবেশে প্রভাব পড়ছে। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। ইতোমধ্যে নদীর পানিতে লবণাক্ততা বাড়ছে, পানীয় জলের সংকট, নদীভাঙনের মধ্যদিয়ে আমরা এর তীব্র শিকার। সংগত কারণেই এসবের শিকার সবচেয়ে বেশি হচ্ছে নদীতীরের মানুষই। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ঘটানো সহজ নয়। তবে, আমারা যদি আমাদের পরিবেশটাকে ভালো রাখি আমাদের ও ভালো থাকার সম্ভাবনা বাড়বে। তাই পরিবেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ নদ-নদীকে ভালো রাখার দায়িত্ব আমাদেরই নিতে হবে। এর বিকল্প আছে কি?
লেখক: গবেষক, কলাম লেখক।