আমলাদের কারণে রাজনীতিকরা ‘ম্লান’ হয়ে যাচ্ছেন বলে উষ্মা প্রকাশ করেছেন আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতা তোফায়েল আহমেদ। গত ২৮ জুন সংসদের বাজেট অধিবেশনে তিনি বলেন, যারা রাজনীতিবিদ, যারা নির্বাচিত প্রতিনিধি, তাদের জন্য নির্ধারিত স্থান যেখানে আছে, সেখানে তাদের থাকা উচিত।… ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স অনুযায়ী সংসদ সদস্যরা সচিবদের ওপরে। এটা খেয়াল রাখতে হবে। … যারা রাজনীতিবিদ, যারা নির্বাচিত প্রতিনিধি, তাদের জন্য নির্ধারিত স্থান যে আছে, সেখানে তাদের থাকা উচিত।
মূলত করোনা সংক্রমণ ও ত্রাণ কার্যক্রম সমন্বয়ে ৬৪ জেলায় একজন করে সচিবকে দায়িত্ব দেয়ার পর থেকেই বিষয়টি নিয়ে রাজনীতিবিদদের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমেদের ক্ষোভেরও মূল কারণ তার জেলায় দায়িত্বপ্রাপ্ত সচিবের ভূমিকা। যা হোক, তোফায়েল আহমেদ একটু রেখেঢেকে বললেও জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ আরও স্পষ্ট করে তার ক্ষোভ ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘প্রতিটি জেলার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে সচিবদের। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ডিসিদের সঙ্গে কথা বলেন। আর এমপি সাহেবরা পাশাপাশি বসে থাকেন, দূরে। এরপর বলে ডিসি সাব, আমি একটু কথা বলব প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে। এই হচ্ছে রাজনীতিবিদদের অবস্থা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ডিসিদের সঙ্গে যখন কথা বলেন, তখন এমপিদের কোনো দাম থাকে না।’
কাজী ফিরোজ আরও বলেন, ‘রাজনীতির মঞ্চগুলো আস্তে আস্তে ব্যবসায়ীরা দখল করছেন। দেশ চালাচ্ছে কারা? দেশ চালাচ্ছেন জগৎ শেঠরা। দেশ চালাচ্ছেন আমলারা। আমরা রাজনীতিবিদরা এখন তৃতীয় লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। এই হচ্ছে আমাদের দুর্ভাগ্য। অথচ এই দেশ স্বাধীন করেছেন রাজনীতিবিদরা।’
কাজী ফিরোজ রশীদ ঠিকই বলেছেন। আমাদের দেশে রাজনীতিবিদরা ক্রমেই গৌণ হয়ে উঠছেন। রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ এখন সামারিক-বেসামরিক আমলা ও বিত্তশালীদের হাতে চলে গেছে। ফলে সাধারণ মানুষের কাছে রাজনীতিবিদদের তেমন কোনো গুরুত্বও নেই৷ তবে রাজনীতিবিদদের এই ‘গৌণ’ হয়ে পড়ার জন্য তারা নিজেরাও কিন্তু কম দায়ী নয়।
আমাদের দেশে এই রাজনীতিবিদরাই বিভিন্ন সময়ে স্বৈরাচার, সামরিক শাসকদের দোসর হিসেবে ভূমিকা পালন করেছেন। এমপি-মন্ত্রী হওয়ার লোভে নিজেদের বিবেককে বিকিয়ে দিয়েছেন। ক্ষমতায় যাওয়া এবং ক্ষমতায় থাকার জন্য এই রাজনীতিবিদরাই নানা ধরনের অনৈতিক কাজ করেছেন। মিথ্যাচার করেছেন। সামারিক-বেসামরিক আমলা ও বিত্তশালীদের তোষণ করেছেন। পদলেহন করেছেন। রাজনীতিবিদদের সম্মিলিত পাপের ঋণ শোধ করতেই দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামো আজ অপসৃত, তারা নিজেরা অবজ্ঞা আর অপমানের শিকার। আমলাদের দয়া-দাক্ষিণ্য নিয়ে তাদের আজ টিকে থাকতে হচ্ছে।এটা অবশ্য একটা দীর্ঘদিনের প্রক্রিয়ার ফল।
আমাদের দেশে বহু বছর ধরে বিরাজনীতিকীকরণের প্রক্রিয়া চলছে। যা শুরু হয়েছিল ১৯৭৫ সালে, বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে, সামরিক শাসকদের হাত ধরে। সামরিক শাসকরা সব সময়ই প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন যে, রাজনীতি খারাপ, রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা আরও বেশি খারাপ। রাজনীতিবিদদের হাতে দেশ নিরাপদ নয়। তারা দুর্নীতিবাজ। অসৎ, মিথ্যাবাদী। কাজেই তাদের হাতে দেশ পরিচালনার ভার দেয়া ঠিক কাজ নয়। দেশ চালাবে দেশের সুশৃঙ্খল বাহিনী। কারণ, তারা দেশপ্রেমিক। তারাই যোগ্য। এর বাইরে ‘কনসালটেন্ট’ হিসেবে কিছু রাজনীতির বাইরের মানুষ থাকতে পারে। কিন্তু রাজনীতিবিদরা কিছুতেই না। সামরিক শাসকরা প্রত্যক্ষভাবে না থাকলেও ‘বিরাজনীতিকীকরণের’ সেই ফাঁদে দেশ এখনও আটকে আছে।
এখন রাজনীতিকরাই বিরাজনীতিকীকরণের দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। একই সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগগুলো আছে, সেগুলোকে যথার্থ প্রমাণে যেন উঠেপড়ে লেগেছে। নেতাদের কাজই যেন এটা প্রমাণ করা, যে তারা কতটা অযোগ্য। এ পরিস্থিতিতে ক্রমেই রাজনীতি ও রাজনৈতিক দলের প্রতি অনাস্থা বাড়ছে, দুর্বল হচ্ছে দাবি জানানোর রাজনৈতিক ভাষা। বিপরীতে সমাজকে ক্রমেই গ্রাস করেছে অনিশ্চয়তা ও হিংসা।
বাংলাদেশের ইতিহাসে বিরাজনীতিকীকরণের ধারা চলছে গত প্রায় চার যুগ ধরে। কীভাবে বিরাজনীতিকীকরণ, কীভাবে ন্যূনতম মূল্যবোধের অবলুপ্তি সে খতিয়ান বিরাট লম্বা। সংক্ষেপে বলা যায়: যে ছাত্রসংগঠনগুলো ঐতিহ্যগতভাবে অন্যায়-অবিচার, স্বৈরশাসন, আগ্রাসন রুখে দিয়েছে সেই ছাত্রসংগঠনগুলো স্থবির। দেড় যুগ ধরে অধিকাংশ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন নেই। সরকারি দলের ছাত্রসংগঠন ছাড়া অন্য কারও তৎপরতা নেই। সেই সুযোগও নেই। সরকার সমর্থিত ছাত্রসংগঠন সরকারের পেটোয়া বাহিনীর ভূমিকায় অবতীর্ণ। বিরোধী ছাত্রসংগঠনগুলো লুপ্তপ্রায়। তাদের কোনো ভূমিকা নেই।
কৃষক-শ্রমিকদের দাবি আদায়ের আন্দোলনও এখন দুর্বল। সবখানে ক্ষমতাসীনদের প্রভাব। দালাল-তাঁবেদারদের ভিড়। তা ছাড়া সুস্থ আন্দোলনকে যেভাবে শক্তি প্রয়োগ করে দমন করা হয়, তাতে আন্দোলনকারীদের স্বাভাবিক সাহসিকতা নষ্ট হয়ে গেছে। যে বাম সংগঠনগুলো নামকাওয়াস্তে তাদের মুক্তির কথা বলছে, তাদের প্রভাব একেবারে তলানিতে।
বিশেষত শ্রমিক রাজনীতিতে টাউট-বাটপারদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সে কারণে শ্রমিক-কৃষকের চিরায়ত সৃজনশীলতাও সুবিধাবাদী রূপ পেয়েছে। শিক্ষা-সংস্কৃতি, শিল্প-সাহিত্য, জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং রাষ্ট্র কাঠামোর সব প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। এমন কোনো একটি প্রতিষ্ঠান নেই, যেখান থেকে সমাজ পরিবর্তনের ডাক আসতে পারে! এমন একটি দল কিংবা জোট নেই, যারা মানুষের অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক মুক্তির সর্বব্যাপী কর্মসূচি দিতে পারে!
শিক্ষা-সংস্কৃতি, শিল্প-সাহিত্য, জ্ঞান-বিজ্ঞান, রাষ্ট্রকাঠামো, রাষ্ট্রের কলকব্জা, রাষ্ট্রের একেবারে শীর্ষ থেকে প্রান্তিক পর্যন্ত বিরাজনীতিকীকরণ এবং রাজনৈতিক ঘৃণা এমনভাবে ছড়ানো হয়েছে যার প্রভাবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম রাজনীতিবিমুখ হয়ে, রাজনীতিকে ঘৃণা করে চলেছে। সুস্থধারার আদর্শিক রাজনীতির প্রাতিষ্ঠানিক ধ্বংসযজ্ঞে এতটাই ‘সাফল্য’ এসেছে যে দেশের বিরাটসংখ্যক মানুষ কোনো একটি বিষয়ে সরকারকে চ্যালেঞ্জ জানালেও সরকার ভীত হয় না!
দেশে এখন বিরোধী দল নেই। সেমি-বিরোধী দলও নেই। কমিউনিস্ট শক্তি নেই। সংঘবদ্ধ কৃষক-শ্রমিকের দল নেই। মধ্যবিত্তের শক্তিশালী সিভিল সোসাইটিও নেই। এই সবই কিন্তু কাগজকলমে আছে, কিন্তু বাস্তবে নেই। তবে বর্তমানে যা আছে, তা হলো একদল প্রবল সক্রিয় ফেসবুকার। যাদের আবার ফেসবুকের বাইরে কোনো জীবন নেই, জগৎ নেই। বুলি আর বুলিং ছাড়া তাদের আর কোনো তৎপরতা নেই।
এই যে ‘ফেসবুক ক্লাব’ ছাড়া দেশে অন্য কোনো সংঘ-সংগঠন ‘নেই’ সেটাই বর্তমান বিরাজনীতিকীকরণের সবচেয়ে বড় অর্জন। এ রকম অবাঞ্ছিত পরিস্থিতি তখন হয় যখন গোটা সমাজে বহু বছর ধরে বিরাজনীতিকীকরণের প্রক্রিয়া চলতে থাকে সেই বিরাজনীতিকীকরণের প্রক্রিয়া তখন সম্ভব হয়, যখন সৎ ব্যক্তি রাজনীতি ছাড়ে। শঠ ব্যক্তিরা সেই জায়গা পূরণ করে। দাবির রাজনীতির ভাষা হারিয়ে যায়। দাবানোর ভাষা প্রকট হয়ে ওঠে।
রাজনীতির মৃত্যু ঘটিয়ে হিংসা সমাজকে গ্রাস করে। গণতান্ত্রিক দাবির ওপর ভিত্তি করে, সাধারণ মানুষকে সঙ্গে নিয়ে এবং সুবিধাবাদকে প্রশ্রয় না দিয়ে দীর্ঘ গণ-আন্দোলন যখন বছরের পর বছর না হয়, তখন সমাজে হককথা বলার জন্য দুরবিন দিয়ে লোক খুঁজতে হয়। এই রকম সন্ধিক্ষণে মানুষ তার অধিকারবোধ হারায়। আত্মসম্মান হারায়। সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলার মতো এতটুকু সাহস আর অবশিষ্ট থাকে না। চারদিকে ধান্দাবাজ ও ধাপ্পাবাজদের অবস্থা রমরমা হয়। মেরুদণ্ড হারিয়ে সরীসৃপে পরিণত হওয়া চাটুকার ও স্তাবকদের উদ্দাম উদ্বাহু নৃত্য বাড়তে থাকে। এমতাবস্থায় কিছু মানুষ তখন আরও রাজনীতিবিমুখ হন, রাজনীতির কথা শুনলে তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠেন, ‘রাজনীতি খারাপ’ বলে এক সহজ নিরাশাবাদী সিদ্ধান্তে উপনীত হন।
বাংলাদেশে সত্যিকার অর্থে দীর্ঘদিন গণতন্ত্র ছিল না। প্রায় সব সময়ই স্বৈরাচারী কায়দায় দেশ চলেছে। সার্বিকভাবে গণতন্ত্রের চর্চাও হয়নি। আমাদের দুর্ভাগ্য, কোনো সরকারই স্বৈরাচারী একনায়কতন্ত্রের ঊর্ধ্বে উঠতে পারেনি। গণতন্ত্রের কথা মুখে বললেও কার্যত কোনো সরকারই তা চর্চা করেনি। পাশাপাশি গণতন্ত্রের চর্চার জন্য আবশ্যক সহযোগী যেসব প্রতিষ্ঠান আছে, তা প্রতিটি সরকার নিজেদের দলীয় স্বার্থে দুর্বল করে বর্তমানে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে এসেছে।
গণতন্ত্র মুখে আছে, কাজে নেই। তবু কিছুটা হলেও দেশে রাজনীতি ছিল। বাকস্বাধীনতা ছিল, সরকারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কার্যকর বিচারিক পদ্ধতি ছিল, সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ছিল। ভোটের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনের সুযোগ ছিল। বর্তমানে রাজনীতি নেই, ভোটাধিকার নেই, নীতি-নৈতিকতা নেই। আছে শুধু ক্রমান্বয়ে বিরাজনীতিকীকরণ।
আমাদের মূলধারার রাজনীতি এবং ছাত্ররাজনীতি- দুটোই আজ অবক্ষয়গ্রস্ত। মূলধারার রাজনীতি বলতে যেমন ‘ক্ষমতা ও মানুষসহ দেশের সম্পদ লুটপাটের’ লাইসেন্স বোঝায়, তেমনি ছাত্ররাজনীতি বলতেও এদেরই আজ্ঞাবাহী হয়ে ভবিষ্যতে কীভাবে কত নিত্যনতুন কলাকৌশলে প্রতিদ্বন্দ্বীকে পরাস্ত (সমূলে ঘায়েল) করে নিজেই একচেটিয়া মাফিয়া ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে বিনিয়োগবিহীন, প্রভাব-প্রতিপত্তি ও দম্ভের সঙ্গে সীমাহীন কামাই করা যায় তার উত্তম মহড়া বা প্রশিক্ষণকাল অতিবাহন বোঝায়। এটা হলো মহাডাকাতির লাইসেন্সের শিক্ষানবিশকাল। এই হলো বিরাজনীতিকীকরণ প্রক্রিয়ার ভয়াবহ বিষফল! দিন শেষে একটা শঙ্কা নিয়েই মানুষ রাতে ঘুমাতে যায়- কেউ জানে না কালকের সকালটা কোন রূপে উদয় হবে?
লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা, প্রাবন্ধিক-কলাম লেখক।