আমার বাসার পাশের আলেয়া (ছদ্মনাম)। ছয় ভাইবোনের অভাবের সংসারে দিন কাটছিল কোনোরকম খেয়ে না খেয়ে। অল্প বয়সে মা বাবাকে হারায়। আত্মমর্যাদার কারণে মানুষের বাসায় কাজ করবে না। নিজের চেষ্টায় সেলাই শিখেন তিনি। বস্তিতে থেকে সেলাই করে ছোট ভাইবোনদের নিয়ে সংসার চলছিল না। এর মধ্যেই ভালোবেসে বিয়ে করে, সন্তানও আসে কোলজুড়ে কিন্তু নেশাগ্রস্ত স্বামীর অত্যাচার সহ্য করতে পারছিল না আলেয়া। সন্তান মারা যায়। কী করবে কী করবে ভেবে অবশেষে সরকারি ব্যবস্থাপনায় তিনি পাড়ি জমান সৌদি আরবে। অভাবী আলেয়া হয়ে ওঠেন বাংলাদেশের রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের একজন। জানা গেছে, তিনি খারাপ নেই, তবে অনেক কষ্ট। মালিক ভালো হলে আরাম না হয় অত্যাচারের মুখে বেঁচে থাকতে হয় তাদের। এমন লাখো আলেয়া কেবল একটু ভালো থাকার আশায় নিজের সহায়-সম্বলকে বিক্রি করে দিয়ে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। কিন্তু কতজনইবা ভালো থাকতে পারছে?
বর্তমানে প্রায় ১০ লাখের মতো বাংলাদেশি নারী প্রবাসে আছে যাদের বেশিরভাগেরই কপালে ভালো কিছু জুটছে না। প্রায়শই তারা সংবাদ হয়ে আসেন আমাদের সামনে। রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিটের তথ্যমতে, করোনাকালে যে রেমিট্যান্স এসেছে তার বেশিরভাগটাই এসেছে নারী শ্রমিকদের মাধ্যমে।
জানা যায়, এর হিসাব প্রায় ৬৯ শতাংশ। নারীরা তাদের আয়ের প্রায় পুরোটাই পাঠিয়ে দেয় দেশে। অথচ এই বিশাল অংশটিকে নিয়ে আমরা বলতে গেলে একেবারেই উদাসীন। পরিসংখ্যান বলছে, বিদেশফেরত প্রায় ৩৫ শতাংশ নারীই শারীরিক বা যৌন নির্যাতনের মতো সহিংসতার শিকার এবং ৪৪ শতাংশ নারীকে ঠিকমতো বেতন দেয়া হতো না। করোনা মহামারির বছরে ২০২০ সালে বিদেশ থেকে ফেরত এসেছে মোট চার লাখ ২৫ হাজার ৬৯৭ কর্মী। এর মধ্যে ৫০ হাজার ৬১৯ জন নারী।
আর তাদের ২২ হাজারই সৌদিফেরত। এসব নারীর বেশিরভাগই নানা ধরনের শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের অভিযোগ করেন বলে জানা যায়। সৌদি আরবে গৃহকর্মীর অভাব সংস্থান করতে বাংলাদেশ থেকে নিয়ে যায় এমন হতভাগা লাখো আলেয়াদেরকে কিন্তু দিনের পর দিন যে পরিমাণ নির্যাতনের খবর আসছে তার প্রেক্ষিতে আমরা আদৌ আর ওখানে নারীদেরকে এমন অসহায় অবস্থায় পাঠাতে পারবো কি না ভাবার সময় এসেছে।
অনেক ধরনের নির্যাতনের সংবাদ পাওয়া গেলেও সম্প্রতি একটি সংবাদে আমি স্তম্ভিত হয়ে গেছি। জানা যায়, গৃহকর্মী হিসেবে গেলেও অনেক নারীই গৃহকর্তাদের লোভের শিকার হয়ে ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। ধর্ষণের শিকার সেসব নারীদের কেউ কেউ আবার সন্তানও জন্ম দিচ্ছে যাদের পরিচয় হয় না কারোই। ছয় মাস বয়সী সন্তানকে অন্যের হাতে তুলে দিয়ে খালি হাতে দেশে ফিরতে বাধ্য হয়েছেন এক নারী। স্বামী তালাক দেয়ায় দুই সন্তানকে দেশে আত্মীয়ের কাছে ফেলে রেখে বিদেশে যায় কর্মের সংস্থান করতে অথচ সেই দেশে গিয়েও শেষরক্ষা হয়নি তার। ধর্ষণের শিকার হয়ে সন্তানের জন্ম দিয়েছে অথচ সেই সন্তানের পরিচয় দিতে রাজি নয় জন্মদাতা।
এমন অবস্থায় পড়েছে আরও অনেক নারী, যারা ধর্ষণের শিকার হয়ে সন্তান জন্ম দিয়ে পায়নি সন্তানের জন্মদাতার স্বীকৃতি। আইন আদালত করেও সুরাহা হয় না। শেষ পর্যন্ত নিজের সম্মানের কথা চিন্তা করে জন্ম দেয়া সন্তানকে বিক্রি করে দিয়ে কোনোরকম দেশে ফিরে আসছে। কিন্তু একজন মা হিসেবে তো সে নিজের সন্তানকে অস্বীকৃতি করতে পারে না।
সংবাদ বলছে কতজন নারী কাজ করতে গিয়ে সন্তানসহ ফিরে আসছে তার কোনো পরিসংখ্যান নেই কারো কাছে। সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশ থেকে সন্তান পেটে করে বা সন্তান নিয়ে ফিরে আসা নারীরা সামাজিকভাবে নানা প্রতিকূলতার সম্মুখীন হচ্ছে। এমন কিছু নারী নানা বেসরকারি সংস্থার অধীনে আশ্রিত আছে বলেও জানা যায়।
অথচ এদের কি এমন আশ্রিত হবার কথা ছিল? নিজের আত্মমর্যাদার বিনিময়ে রেমিট্যান্স পাঠানো নারীদের প্রতি এমন অবহেলা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। সন্তানদের ভবিষ্যৎইবা কী হবে? একজন মা কতটা অসহায় হলে নিজের জন্ম দেয়া সন্তানকে প্রবাসে ফেলে রেখে পালিয়ে আসে?
বিমানবন্দরে মালামাল আনার বেল্টের কাছে একটি শিশুকে পাওয়া গেছে যার পরিচয় কেউ জানে না। ধারণা করা হচ্ছে কোনো মা হয়তো বিদেশ থেকে ফিরে আসার পর পরিচয়হীন সন্তানকে ফেলে রেখে গেছে।
সন্তান নিয়ে ফিরে আসা মায়েদের পুনর্বাসনের দায় বা দায়িত্ব আসলে কার? তারাতো সকল রকম বৈধ নিয়মের মাধ্যমেই বিদেশ গিয়েছিল অথচ ফিরে আসার পর এদের দায়িত্ব নিতে চাইছে না কেউ। কেন? এদের বিষয়ে সরকারকেই ভাবতে হবে, নিতে হবে কঠোর পদক্ষেপ।
কাজ করতে গিয়ে যারা নানা প্রকার নির্যাতনের শিকার হচ্ছে তাদেরকে আইনি সহায়তা দেয়ার ব্যবস্থা করার দায়িত্ব আমাদের প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়কে নিতে হবে। যেসব নারী ধর্ষণের শিকার হচ্ছে বা সন্তানের জন্ম দিচ্ছে তাদের হয়ে আইনি লড়াই করার জন্য নিতে হবে পদক্ষেপ, কারণ তাদের কারো পক্ষেই ভিনদেশে আইনি লড়াই করা বা সন্তানের অধিকার আদায় করা সম্ভব নয়। অন্তত জন্ম নেয়া শিশুটিরতো কোনো অপরাধ নেই। সে কেন জন্মের পর পরই এতিমের খাতায় উঠে যাবে?
সন্তান ও মায়ের নিরাপত্তায় সরকারকে অবশ্যই এগিয়ে আসতে হবে। সংশ্লিষ্ট দেশের সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসতে হবে। কোনো প্রকার আইনের প্রয়োজন হলেও নিতে হবে সঠিক পদক্ষেপ। কাজ করতে যাওয়া নারীরা কোনো অপরাধ করেনি। তারা কেন অত্যাচারের মুখোমুখি হয়ে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ঘুরবে? দরকার নারী শ্রমিককে আরও প্রশিক্ষণ দেয়া। কীভাবে নির্যাতনের বিরুদ্ধে লড়াই করবে এ বিষয়েও শিক্ষিত করতে হবে।
লেখক: প্রাবন্ধিক, কলাম লেখক।