বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

জনপ্রতিনিধি ও আমলা: অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত

  •    
  • ৩ জুলাই, ২০২১ ১০:৪২

প্রশাসনযন্ত্রে নিম্ন থেকে সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত নির্বাহী আদেশ পালন, বাস্তবায়ন এবং জবাবদিহির একটি সংস্কৃতি কার্যকর রয়েছে। এর ফলে রাষ্ট্রের নির্বাহী প্রশাসনিক বিভাগ সরকারের গুরত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের শৃঙ্খলায় নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। জনপ্রতিনিধিত্বের সর্বনিম্ন থেকে সর্বোচ্চ পর্যায়ের কাঠামো সেভাবে কার্যকর নয়। এটি দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতাব্যতীত খুব একটা পুষ্টও হয় না। আমাদের এখানেও গড়ে ওঠা জনপ্রতিনিধিত্বমূলক সকল প্রতিষ্ঠান কার্যকর ভূমিকা রাখার ক্ষেত্রে এখনও চেইন অফ কমান্ডের মতো কোনো ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হচ্ছে না। সংসদ সদস্যগণ ব্যতীত অন্যান্য জনপ্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠানগুলো অংশত স্বায়ত্তশাসন ভোগ করে আবার নিচের দিকের প্রতিষ্ঠানগুলো স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সরকারের বিভিন্ন সিদ্ধান্তের বাস্তবায়নের বিভিন্ন পর্ষদভুক্ত হয়ে ভূমিকা রাখে।

সম্প্রতি সংসদে আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান নেতা তোফায়েল আহমেদ তার জেলা ভোলায় করোনা নিয়ন্ত্রণ-সংক্রান্ত জেলার সমন্বয়কের দায়িত্বপ্রাপ্ত সচিব ভোলার পরিস্থিতি দেখার জন্য না যাওয়ার অভিযোগ তোলেন। বিষয়টি নিয়ে সংসদে সরকারি ও বিরোধী দলের উপস্থিত এমপিরা বেশ বড় ধরনের বিতর্কের ঝড় তোলেন। কেউ কেউ প্রশ্ন তোলেন দেশ কারা চালাচ্ছে- আমলা নাকি রাজনীতিবিদ? স্বয়ং তোফায়েল আহমেদ মন্ত্রী-এমপিদের পদমর্যাদা আমলাদের চাইতে কতটা উপরে সেটিও উল্লেখ করেন। জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশীদ এই বিতর্কে অংশ নিয়ে সরকার পরিচালনায় জগৎ শেঠের নাম তুলে আনেন। জগৎ শেঠ আসলে কোনো একজন ব্যক্তি নন, ধনাঢ্য পরিবারের উপাধি ছিল। এই পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মানিক চাঁদ। তিনি ছিলেন আঠারো শতকের শুরুতে একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী ও ব্যাংকার।

তিনি মুর্শিদাবাদে নবাব মুর্শিদকুলী খানের আস্থাভাজন ছিলেন। সম্রাট ফররুখ শিয়ার তাকে পরবর্তী সময়ে ‘নগর শেঠ’ উপাধি প্রদান করেন। তার মৃত্যুর পর সম্রাট মাহমুদ তার দত্তক পুত্র শাহ ফতেহ চাঁদকে ‘জগৎ শেঠ’ উপাধি দেন। জগৎ শেঠ পরিবারের পরবর্তী বংশধররা ব্যাংক প্রতিষ্ঠা, অর্থলগ্নি এবং মুদ্রা তৈরিতে বড় ধরনের অবদান রাখেন। এরা মুর্শিদাবাদ সরকারের ওপর ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেন। শেষের দিকে কেউ কেউ ইংরেজদের সঙ্গেও হাত মেলান। মাহতাব চাঁদ নামক জগৎ শেঠ নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার পতনে ইংরেজদের সঙ্গে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন। জগৎ শেঠ পরিবারের পরবর্তী ইতিহাস বেশ উত্থান-পতনের মধ্য দিয়েই সমাপ্ত হয়েছে।

সংসদে আলোচনাটি সরকারি ও বিরোধী দলের সদস্যরা রাজনীতিবিদ বনাম আমলার কর্তৃত্বের অবস্থান থেকে দেখা ও বলার চেষ্টা করেছেন। সারা বছর সংসদ নিয়ে কারও তেমন কোনো বিশেষ আগ্রহ না থাকলেও সংসদে যখন সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে তুমুল বাগ্‌যুদ্ধ হয় কিংবা উভয় দলের সদস্যরা অভিন্ন সুরে সংসদকে মাতিয়ে তোলেন তখন গণমাধ্যমের কল্যাণে সারা দেশবাসী সেটি দেখেন, শোনেন এবং অনেকে বেশ উপভোগও করেন।

সেই বিতর্ক দেশ ও জাতির কতটা লাভ বা উপকার বয়ে আনবে সেটি ভিন্ন প্রশ্ন। দর্শক-শ্রোতারা তেমন চিন্তা তাৎক্ষণিকভাবে না-ও করতে পারেন। কিন্তু উপভোগ করতে দোষের কী! রাজনীতিবিদ বনাম আমলারা দেশ চালাচ্ছেন সেদিনের এমন বিতর্ক সংসদের অধিবেশনকক্ষের সীমানা ছাড়িয়ে গণমাধ্যমে বিশেষভাবে খবর হয়েছে। বেশ কয়েকটি টিভি-চ্যানেল এ নিয়ে টক শোতেও ঝড় তোলার চেষ্টা করেছে।

ইলেকট্রনিক মিডিয়াগুলো যেকোনো বিষয়ে পক্ষ-বিপক্ষের কয়েকজনকে আলোচক হিসেবে ডেকে বিতর্কটাকে বেশ চাঙা করার চেষ্টা করে। রাজনীতিবিদ ও আমলাদের দেশ পরিচালনার কর্তৃত্ব নিয়ে কয়েকটি চ্যানেলের পরদিনের আলোচনা গভীর মনোযোগ দিয়ে শোনার চেষ্টা করেছি। কিন্তু উপকৃত হওয়ার মতো জ্ঞান পাওয়ার জন্য এত দীর্ঘ সময় ধরে নানাজনের নানা মত-অভিমত, কূট-তর্ক শোনার খুব বেশি প্রয়োজন ছিল বলে হয়নি।

বাংলাদেশ কে চালাচ্ছেন, আমলা নাকি রাজনীতিবিদ- এই বিতর্ক সংসদেই নয়, পত্রপত্রিকা, রাজনৈতিক অঙ্গন, টিভি টক শোসহ অনেক জায়গাতেই ব্যাপকভাবে উচ্চারিত হয়। বিএনপির নেতারা বর্তমান সরকারকে আমলানির্ভর সরকার বলে অভিহিত করে থাকে। বিএনপির আরও অভিযোগ হচ্ছে ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ের পেছনে আমলাদের ব্যাপক সমর্থন ছিল। সে কারণে আমলারা সরকারের কাছ থেকে নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিচ্ছে, পাচ্ছে এবং রাষ্ট্র ও প্রশাসনকে অপব্যবহার করার মাধ্যমে দুর্বল করছে।

বিএনপির এই অভিযোগ আমলাদের প্রতি থাকতেই পারে কিন্তু বিএনপির শাসনামলেও আমলারা যথানিয়মে সরকারের অন্যতম অঙ্গ হিসেবে ছিলেন। সেই সময়ের অনেক আমলার বিএনপি-জামায়াতের জোটপ্রীতির কথা নিশ্চয়ই মানুষ এখনও ভুলে যায়নি। খোদ নির্বাচন কমিশনেই কয়েকজন সাবেক আমলা ও কর্মকর্তাকে ইসি পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। নির্বাচন কমিশনের সচিব আব্দুর রশিদের কথা বোধ হয় কেউ এখনও ভুলে যায়নি। আরও অনেক আমলাই বিএনপি ও জামায়াতের সঙ্গে রাজনৈতিকভাবে ঘনিষ্ঠ ছিলেন। এমনকি জেলা প্রশাসক, বিভাগীয় কমিশনার পর্যায়েও কেউ কেউ বিএনপির নেতার মতো আচরণ করতেন বলে পত্রপত্রিকায় নানা ধরনের খবর ও প্রতিবেদন ছাপা হতো। অনেক আমলাই বিএনপি থেকে সুযোগ-সুবিধা বাগিয়ে নিয়েছিলেন আবার আমলাদের মধ্যে যারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বলে পরিচিত ছিলেন তাদের পদোন্নতি হয়নি।

আবার কারও কারও ক্ষেত্রে ওএসডি বা চাকরি হারানোর মতোও ঘটনা ঘটেছে। সুতরাং এখন যখন বিএনপির কোনো কোনো নেতা আমলাদের ‘আওয়ামী লীগের আমলা’ হিসেবে সম্বোধন করেন তখন আওয়ামী লীগের প্রতি বিদ্বেষটি আমলাদের ওপরই ক্ষোভ ঝাড়ার মতো মনে হয়। বাংলাদেশে আসলেই বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা, পর্যালোচনা ও ধারণা লাভের সুযোগ এসব তর্কবিতর্ক, কূটতর্ক ইত্যাদির মধ্যে খুব একটা পাওয়া যায় বলে মনে হয় না। এখন সংসদে সরকারি দলের সংসদ সদস্যরা আমলাতন্ত্র সম্পর্কে যা বলেছেন তাতে সুর জমিয়ে বিষয়টিকে মানুষের দৃষ্টিতে এনেছেন তারা। বিরোধী দল তাদের সঙ্গে একাত্ম হয়েছে। কিন্তু সরকারি দলের সংসদ সদস্যগণ কি বিষয়টি নিয়ে দলীয়প্রধান শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা বলতে চেষ্টা করেছিলেন কখনও?

সেখানেই জানা যেত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি আমলাদের নির্বাহী ক্ষমতা দিয়েছেন নাকি সিদ্ধান্ত নেয়ার কিংবা সরকার পরিচালনার প্রধান শক্তির মর্যাদা দিয়েছেন সেটি তার কাছ থেকেই স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যেত। সংসদের এই আলোচনাটি প্রধানমন্ত্রীকে বিব্রত ও বিতর্কিত করার পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে বলেই বাইরে থেকে মনে হয়। সংবিধানে দেয়া প্রধানমন্ত্রীর সাংবিধানিক এখতিয়ার সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যথেষ্ট ধারণা রাখেন বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকগণ মনে করেন।

প্রশাসন হচ্ছে রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের অন্যতম একটি । দেশ পরিচালনার জন্য সংসদ ও সরকার সাংবিধানিকভাবে যেসব আইন প্রণয়ন এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তার বিরাট একটি অংশ বাস্তবায়ন করার দায়িত্ব পড়ে গোটা প্রশাসন ব্যবস্থার ওপর।

আইনপ্রণেতারা সংসদে আইন পাস করেন, সরকার আইনের ভিত্তিতে দেশ পরিচালনার নানা ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকেন রাজনৈতিকভাবে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, যারা সংসদের জন্য নির্বাচিত হন। সুতরাং ৫ বছরের জন্য নির্বাচিত সরকারের নীতিনির্ধারনী সিদ্ধান্ত, আইন প্রণয়ন এবং দেশের উন্নতি-অগগ্রতির পরিকল্পনা প্রণয়ন সর্বোচ্চ জনপ্রতিনিধিরাই নিয়ে থাকেন। এর সঙ্গে শুধু ক্ষমতাশীল দলের সদস্যরাই নয়, বিরোধী সদস্যরাও যুক্ত থাকেন।

সুতরাং দেশ পরিচালনার এই দায়িত্বটি রাজনীতিবিদদের মধ্যে যারা সরকারে কিংবা বিরোধী দলের হয়ে নির্বাচিত হয়ে আসেন-তাদের। কিন্তু প্রণীত আইন, বিধিবিধান, সরকারের সিদ্ধান্তাবলি ও বিধি অনুযায়ী বাস্তবায়ন করার জন্য পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেও প্রশাসনিক ব্যবস্থা কার্যকর রয়েছে। সরকারকে প্রধানত সব সিদ্ধান্ত কার্যকর করার জন্য প্রশাসন যন্ত্রের ওপর নির্ভর করতে হয়। আমাদের দেশেও সরকার এবং প্রশাসন এভাবেই চলে আসছে। এমনকি মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত রাজনৈতিক সরকার মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় একদিকে বেসামরিক- সামরিক মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর নির্ভর করেছিল, অপরদিকে সরকারের প্রশাসনিক কাঠামো তখনই গঠন এবং কার্যকর করার ব্যবস্থা গ্রহণ করে প্রশাসন। তখন মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনের বিষয়াদি ছাড়াও সরকার পরিচালনায় গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহ বাস্তবায়ন করেছিল প্রশাসন।

স্বাধীনতা লাভের পর নতুন রাষ্ট্রের প্রশাসনিক ব্যবস্থা মুক্তিযুদ্ধের সময়ে গঠিত সীমিত কাঠামোকে রাষ্ট্রের প্রয়োজনে বিস্তৃত করা হয়েছে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের এখন সরকার ব্যবস্থার ব্যাপকতর পরিবর্তন ঘটেছে, সঙ্গে সঙ্গে প্রশাসনেরও। অনেক ক্ষেত্রে মনে হতে পারে প্রশাসনের মাথা ভারী হয়ে গেছে। হয়ত এর সততাও আছে। কিন্তু প্রশাসনের ডালপালা উপজেলা এমনকি ইউনিয়নপর্যায় পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। আবার অপরদিকে জনপ্রতিনিধিদের স্তরও গত ৫০ বছরে নানাভাবে বিস্তৃত হয়েছে।

উপজেলা এবং জেলা পরিষদের প্রতিনিধিরাও জনপ্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত বা মনোনীত হচ্ছেন। ইউপি, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা, সিটি করপোরেশন ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের জনপ্রতিনিধি হিসেবে যুক্ত হয়েছেন। এসব প্রতিষ্ঠান ও জনপ্রতিনিধিদের বিধিবিধান এবং আইন অনুযায়ী যার যার পরিমণ্ডলে নানা ধরনের কর্মকাণ্ড গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হয়। তাদেরকেও এক ধরনের আমলা প্রশাসনিক কর্মকর্তা, নিয়মকানুন, বিধিবিধান অনুযায়ী সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে হয়। এসব জনপ্রতিনিধত্বমূলক সংস্থাও সরকারেরই অংশ। সেগুলোর কাজে জনপ্রতিনিধিদের প্রত্যক্ষ দায়িত্ব ও নির্বাহী ক্ষমতা থাকে। জবাবদিহি তাই সরকার এবং জনগণের কাছে করতে হয়।

অপরদিকে সরকারের সকল নির্বাহী প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্র ও সরকারের আইন, বিধিবিধান এবং সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সরাসরি সরকারের কাছে দায়বদ্ধ থাকে। সরকার রাষ্ট্রের আইন অনুযায়ী নির্বাহী বিভাগের কর্মকাণ্ড পরিবীক্ষণ করে থাকেন। সকল স্তরের জনপ্রতিনিধিগণ মর্যাদার ভিত্তিতে ভিন্ন ভিন্ন অবস্থানে থাকেন। তারপরও দেখা যায় সর্বোচ্চ এবং সর্বনিম্ন জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে কাজের সমন্বয় সবসময় কাঙ্ক্ষিত মানে হয় না।

রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, জনপ্রতিনিধি প্রশাসনের সঙ্গে একত্রে কোন পর্যায়ে কতটা যুক্ত থাকলে বর্তমান সময়ের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকারের অর্জন কতটা হবে সেটি জনপ্রতিনিধি, সরকারি দল এবং সরকার নির্ধারণ করবেন। জনপ্রতিনিধিদের ভূমিকার সঙ্গে সবসময় সব কাজে প্রশাসনের একাত্ম হওয়ার প্রয়োজন কতটা রয়েছে সেটিও দল এবং সরকারকে নির্ধারণ করতে হয় তাহলেই সমস্যার সমাধানে সাফল্য অর্জনের পথ সুগম হয়।

জনপ্রতিনিধিরাও সকলে একক পদ এবং মর্যাদার নয়। একই বৃহত্তর নির্বাচনি আসনে একাধিক সংস্থার জনপ্রতিনিধি রয়েছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, এসকল স্তরের জনপ্রতিনিধিদের অবস্থান ও মর্যাদার মধ্যে চেইন অফ কমান্ড গড়ে না ওঠায় রাজনৈতিক এবং জনপ্রতিনিধিত্বের দায়-দায়িত্ব এবং জবাবদিহির সংস্কৃতি অনেক ক্ষেত্রেই উপেক্ষিত হচ্ছে।

অপরদিকে প্রশাসনযন্ত্রে নিম্ন থেকে সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত নির্বাহী আদেশ পালন, বাস্তবায়ন এবং জবাবদিহির একটি সংস্কৃতি কার্যকর রয়েছে। এর ফলে রাষ্ট্রের নির্বাহী প্রশাসনিক বিভাগ সরকারের গুরত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের শৃঙ্খলায় নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। জনপ্রতিনিধিত্বের সর্বনিম্ন থেকে সর্বোচ্চ পর্যায়ের কাঠামো সেভাবে কার্যকর নয়। এটি দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতাব্যতীত খুব একটা পুষ্টও হয় না। আমাদের এখানেও গড়ে ওঠা জনপ্রতিনিধিত্বমূলক সকল প্রতিষ্ঠান কার্যকর ভূমিকা রাখার ক্ষেত্রে এখনও চেইন অফ কমান্ডের মতো কোনো ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হচ্ছে না।

সংসদ সদস্যগণ ব্যতীত অন্যান্য জনপ্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠানগুলো অংশত স্বায়ত্তশাসন ভোগ করে আবার নিচের দিকের প্রতিষ্ঠানগুলো স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সরকারের বিভিন্ন সিদ্ধান্তের বাস্তবায়নের বিভিন্ন পর্ষদভুক্ত হয়ে ভূমিকা রাখে। এটি প্রশাসনের নির্বাহী সংস্থা এবং জনপ্রতিনিধিত্বমূলক সংস্থাগুলোর মধ্যে প্রয়োজনে সমন্বয় সাধনের মাধ্যমেই গুরত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হয়। এটিও একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে এক ধরনের দায়িত্ব ভাগাভাগির অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হবে।

আপাতত রাষ্ট্রের নির্বাহী সংস্থার সঙ্গে অঙ্গসংগঠনসমূহের সঙ্গে জনপ্রতিনিধত্বের ক্রমোচ্চ শ্রেণিবিন্যাসের সহাবস্থান নানা অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে চলছে। এতে দেশে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা করায় কোথাও কোথাও ভুল বোঝাবুঝি, দূরত্ব এবং প্রভাব বিস্তারের কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাও ঘটতে দেখা যায়।

বর্তমানে বৈশ্বিক করোনা সংক্রমণ রোধে সরকারকে বেশ কিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই রাষ্ট্রীয় আইন ও বিধিবিধানকে কঠোরভাবে মেনেই এসব কার্যকর করতে হচ্ছে। এটি রাষ্ট্রের প্রশাসন যন্ত্রের দায়িত্বের অংশ। জনপ্রতিনিধিত্বমূলক ক্রমোচ্চ শ্রেণিবিন্যাসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত থাকলে সরকারের লক্ষ্যপূরণে সহায়ক শক্তির সমাবেশ বিপুলভাবে ঘটে। সেটি সরকারের নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ নির্ধারণ করবেন।

বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের অংশগ্রহণ, পরিবীক্ষণ, মূল্যায়ন এবং তাৎক্ষণিকভাবে জন-আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন ঘটাতে সবধরনের ভূমিকা রাখবে। সেই ক্ষমতা কেবলমাত্র তাদেরই রয়েছে। এটি রাজনৈতিক দল এবং সরকারের ওপর নির্ভর করে। আমরা আশা করব প্রশাসন প্রশাসনের দায়িত্ব পালন করবে। রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও জনপ্রতিনিধিত্বমূলক সংস্থাগুলোও তাদের সাংবিধানিক ভূমিকা যথাযথভাবে রাখবে। সংঘাত নয় বরং সহযোগিতাই হবে প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা রাখার রাষ্ট্রনৈতিক অবস্থান।

লেখক: গবেষক, অধ্যাপক।

এ বিভাগের আরো খবর