চায়নার কমিউনিস্ট পার্টি ১ তারিখ তাদের শতবর্ষ উদযাপন করল। এই শতবর্ষে চায়নার কমিউনিস্ট পার্টি ক্ষমতায় আছে ৭২ বছর। টানা এতদিন ক্ষমতায় এ মুহূর্তে কোনো দেশে কোনো রাজনৈতিক দল নেই। তা ছাড়া এই পার্টির সক্রিয় মেম্বার প্রায় ১০ কোটি। এত পার্টি মেম্বারও পৃথিবীর কোনো রাজনৈতিক দলের নেই।
এমন একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান ও দেশের প্রেসিডেন্ট, চায়নার প্রেসিডেন্ট ১ তারিখ তিয়েনআনমেন স্কয়ারে ৭০ হাজারের বেশি মানুষের একটি সভায় প্রায় এক ঘণ্টা বক্তব্য রেখে উদযাপন করলেন তার দলের শতবর্ষ। তার এই উদযাপন সভায় ৭০ হাজারের ওপরে মানুষ ছিলেন এবং তারা সবাই ছিলেন মাস্কবিহীন। যে সময়ে প্রায় গোটা পৃথিবীর মানুষের মুখে মাস্ক। পৃথিবীর ৪০টির ওপরে দেশ কোভিড-১৯-এর আলফা ও বিশেষ করে ডেল্টা ভাইরাসে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষের মৃত্যুকে প্রত্যক্ষ করছে। আমেরিকা যে মুহূর্তে নতুন করে আবার সবাইকে মাস্ক পরার জন্য আহ্বান জানাচ্ছে। যুক্তরাজ্য ৫৭ ভাগ মানুষকে দুই ডোজ করে ভ্যাকসিন দেয়ার পরেও তারা আবার কোভিড-১৯-এর ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের কারণে সবাই মাস্ক পরছে।
ভারত ও বাংলাদেশের মতো জনঘনত্বপূর্ণ দারিদ্র্যে ভরা দেশগুলো ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টে পর্যুদস্ত, সে সময়ে চায়নার কমিউনিস্ট পার্টি প্রধান ৭০ হাজার মাস্কবিহীন মানুষকে সামনে রেখে তার ৯৪, ৯৬ বছর বয়স্ক নেতাদের সঙ্গে নিয়ে মাস্ক ছাড়াই উদযাপন করলেন শতবর্ষ। যা এ মুহূর্তে পৃথিবীতে একটি বড় সাফল্য।
চায়নার প্রেসিডেন্ট ও কমিউনিস্ট পার্টি প্রধান তার ওই এক ঘণ্টার বেশি সময় দেয়া বক্তব্যের এক পর্যায়ে গোটা পৃথিবীকে অলিভ পাতা দেখিয়েছেন বা শান্তির বাণীই শুনিয়েছেন। এ মুহূর্তে চায়নার সব থেকে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী আমেরিকার বিরুদ্ধেও কোনো কথা বলেননি। এমনকি সাউথ চায়না সি নিয়ে চায়নার প্রেসিডেন্ট খুব বেশি কিছু বলেননি। তবে চায়না আমেরিকার বিরুদ্ধে কিছু না বললেও যে মুহূর্তে চায়না তাদের কমিউনিস্ট পার্টির এই শতবর্ষ পালন করছে, এ সময়ে পেন্টাগন উদ্বিগ্ন চায়নার পরমাণু অস্ত্র নিয়ে। কারণ, চায়নাই ভবিষ্যতে সব থেকে বড় পরমাণু শক্তি হতে যাচ্ছে। পেন্টাগনের তথ্য অনুযায়ী চায়না আরও এক শ পরমাণু অস্ত্রাগার করতে যাচ্ছে মাটির নিচে। পশ্চিম বেইজিং থেকে ১ হাজার ৩০০ মাইল দূরে চায়নার গানসু প্রদেশে ইউমেন নামক স্থানে ৭০০ বর্গমাইল জায়গা নিয়ে তৈরি হচ্ছে পরমাণু অস্ত্র রাখার এই সংরক্ষিত স্থানগুলো। তবে কারো কারো মতে, এই ১০০ অস্ত্রাগারের সবগুলোতে তারা পরমাণু অস্ত্র রাখবে না। আরও নতুন ধরনের অস্ত্র তারা রাখবে। পেন্টাগনের মতে, চায়নার ডিএফ ৪১ পরমাণু মিসাইলের ক্ষমতা হবে ৯ হাজার ৩০০ মাইল দূরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করার, যা সহজেই আমেরিকার লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করতে পারবে বলে পেন্টাগন মনে করছে।
বাস্তবে চায়নার কমিউনিস্ট পার্টি তাদের ৭২ বছরের ক্ষমতায় থাকাসহ যখন এই শতবর্ষে পৌঁছাল, তখন সত্যি অর্থে চায়না আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও অস্ত্র ক্ষমতার এক বড় প্লেয়ার। তাকে বাদ দিয়ে কোনোমতেই আর পৃথিবীর ভবিষ্যৎ রাজনীতি ও অস্ত্র প্রতিযোগিতাকে ভাবার কোনো উপায় নেই। এবং তারা যেভাবে পরমাণু অস্ত্র তৈরি করতে যাচ্ছে, তাতে উদ্বিগ্ন পৃথিবীর অধিকাংশ রাজনৈতিক ও সমর বিশ্লেষক আর তার সঙ্গে সঙ্গে শান্তিকামী মানুষ। যে কারণে চায়নার কমিউনিস্ট পার্টি যে সময়ে শতবর্ষ পালন করছে, এ সময়ে আমেরিকার অনেক পত্রপত্রিকা খুব গুরুত্বের সঙ্গে লিখেছে, আমেরিকার বাইডেন প্রশাসনের উচিত হবে অবিলম্বে চায়নার সঙ্গে পরমাণু অস্ত্র প্রতিযোগিতা বন্ধ করা নিয়ে আলোচনায় বসা। সারা পৃথিবীর শান্তিকামী মানুষও তাই মনে করে। এ মুহূর্তে আমেরিকাসহ ন্যাটোভুক্ত দেশগুলো, রাশিয়া, ভারতও আশিয়ানভুক্ত দেশগুলোর উচিত হবে এ বিষয়ে সরব হওয়া। জাতিসংঘকেও সরব হতে হবে। কারণ, এই কোভিড-পরবর্তী পৃথিবীকে যদি চায়না পরমাণু অস্ত্র প্রতিযোগিতায় ঠেলে দেয়, তাহলে পৃথিবীতে পরমাণু অস্ত্র প্রয়োগের আগেই অনেক মানুষ মারা যাবে দারিদ্র্যে।
চায়নার প্রেসিডেন্ট ও কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান দাবি করেছেন, তার দেশের লক্ষ্য ছিল ২০২১-এর মধ্যে দারিদ্র্য দূর করা। তারা সে লক্ষ্যে পৌঁছেছে। তাদের দেশে কোনো দরিদ্র মানুষ নেই। চায়নার প্রেসিডেন্টের এ দাবি কতটা সঠিক, তা বলা সত্যিই দুষ্কর। কারণ, চায়নায় কোনো স্বাধীন মিডিয়া নেই। তবে হংকংয়ের মিডিয়ার মতে, এ মহূর্তে চায়নায় যেমন পৃথিবীর সব থেকে বেশি বিলিয়নিয়ার, তেমনি তাদের দারিদ্র্যও কম নয়। অর্থাৎ শ্রেণিবৈষম্য চায়নাতেও বেশি। বাস্তবে সাধারণভাবে চায়না ঘুরেও সত্যি অর্থে বোঝার কোনো উপায় নেই সেখানে কত পরিমাণ দরিদ্র আছে। তবে এ সত্য যে অবকাঠামো উন্নয়নে চায়না গত তিন দশকে এক অবিশ্বাস্য অবস্থানে পৌঁছে গেছে। কিন্তু তাদের ফুটপাত ধরে হাঁটা মানুষ ও কাঁচাবাজারে গেলে এ সত্য বোঝা যায় যে এক শ চল্লিশ কোটি মানুষ সবাই দারিদ্র্যসীমা পার হতে পারেননি।
বাস্তবে এই সত্য যেমন পাওয়া যায় না, তেমনি চায়নার রাষ্ট্রকাঠামোর সব অঙ্গ মিলবে না উদার পৃথিবীর সঙ্গে। চায়নার রাষ্ট্রযন্ত্রে এই উদারতা আনার জন্য আজ থেকে ৩২ বছর আগে চায়নার শিক্ষিত তরুণরা একত্রিত হয়েছিল। তারা ‘উদার চায়না চায়’ এ দাবিতে সারা পৃথিবীর দৃষ্টি কেড়েছিল। চায়নার প্রেসিডেন্ট ও কমিউনিস্ট পার্টি প্রধান শতবর্ষ পালন করলেন যে তিয়েনআনমেন স্কয়ারে, এই তিয়েনআনমেন স্কয়ারেই ১৯৮৯ সালে তরুণরা জড়ো হয়েছিল। চায়না ট্যাংক দিয়ে তাদের দাবি গুঁড়িয়ে দিতে সমর্থ হয় ঠিকই, তারপরে তাদের অর্থনীতি ও রাজনীতিতে অনেক পরিবর্তন আনতেও বাধ্য হয়। কিন্তু তারপরে সেদিন গণতন্ত্রের দাবিকে ট্যাংক দিয়ে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল । আজ আবার বত্রিশ বছর পরে তারা যখন সেই একই চত্বরে তাদের ক্ষমতাসীন পার্টির শতবর্ষ পালন করছে, সে সময়ে তারা পৃথিবীর গণতান্ত্রিক শক্তিকে মোকাবিলা করতে চাচ্ছে পরমাণু অস্ত্র দিয়ে। অর্থাৎ পৃথিবীকে নতুন করে পরমাণু অস্ত্রের প্রতিযোগিতার দিকে ঠেলে দিতে চাচ্ছে।
তবে এটা সত্য, এ মুহূর্তে পৃথিবীতে পরমাণু অস্ত্রের প্রয়োজন নয়, পৃথিবীর জন্য প্রয়োজন দারিদ্র্য দূর করা ও মানুষের মৌলিক অধিকার আরও নিশ্চিত করা। কারণ পৃথিবীর ৭ বিলিয়ন মানুষের বড় অংশই মৌলিক অধিকার ভোগ করছে না। স্বাধীন মিডিয়া নেই অধিকাংশ দেশে আর চায়নাতে আছে শুধু সরকারি মুখপাত্র। স্বাধীন বিচার বিভাগেরও একই অবস্থা। মানুষের জন্মগতভাবে মৌলিক অধিকার হলো সে স্বাধীন, রাষ্ট্র আইনের মাধ্যমে ছাড়া কোনোমতেই তার ওপর কোনো খবরদারি করতে পারবে না। অথচ পৃথিবীর ৭ বিলিয়ন মানুষের ৫ বিলিয়নের বেশি মানুষ এখনও রাষ্ট্রের খবরদারির নিচেই বাস করছে। একসময়ে তারা প্রভূর ক্রীতদাস ছিল, এখন তারা রাষ্ট্রের ক্রীতদাস।
স্বাধীন মিডিয়া, স্বাধীন বিচার বিভাগ, যোগ্য ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত নির্বাহী বিভাগ আর সর্বোপরি রাষ্ট্র পরিচালকদের উদার ও আধুনিক মানসিকতা ছাড়া কোনোমতেই মানুষ তার জম্মগত স্বাধীনতা ভোগ করতে পারবে না। চায়নার কমিউনিস্ট পার্টিকেও তাই শুধু দেশের অবকাঠামো উন্নয়ন নয়, নিশ্চিত করতে হবে মানুষের জন্মগত স্বাধীনতা। মার্কস মানুষের ক্ষমতায়ন চেয়েছিলেন। কখনোই তিনি রাষ্ট্র ও পার্টিকে মানুষের নিয়ন্ত্রক হিসেবে চাননি। এ লক্ষ্যে পৌঁছানোর কোনো পদক্ষেপ মানুষ তাদের পার্টিপ্রধানের শতবর্ষ পালনের ভাষণে জানতে পারেনি। বরং এই শতবর্ষ পালনের মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে তারা বন্ধ করে দিয়েছে হংকংয়ের আপেল ডেইলি। আর শতবর্ষ পালনের বক্তব্যেও ছিল না চায়নার মানুষের স্বাধীন মতপ্রকাশের কোনো আশার বাণী। মূক বা বধির একটি জাতি উন্নতির শিখরে গেলেও কি ওই জাতি বা নরগোষ্ঠী আনন্দ ভোগ করতে পারে? আর টিকে থাকে কি তাদের লোহার বাসর শেষ অবধি?