আবার এসেছে সুখতাড়ানিয়া-দুঃখজাগানিয়া লকডাউন। মানুষের বিক্ষত দিন। ‘কেউ খাবে কেউ খাবে না’র দিন। উপেক্ষা, বেদনা হাহাকার আর রোদনভরা দিন। গতবছর করোনাকালে মানুষ মানুষের জন্য ছুটে গিয়েছিল। সেটা সামাজিক মাধ্যমে দেখানোর (শো-অফ) জন্যই হোক কিংবা সরকারের সামনে জনদরদি সাজার জন্যই হোক, এবার তারা কোথায়? কাউকেই তো দেখা যাচ্ছে না। মানুষ লকডাউন মানে না, লকডাউন বোঝে না- বলে যারা গলা ফাটান তারা কি মানেন? লকডাউন আমজনতা কেন বোঝে না- সেটা তলিয়ে দেখেছেন কেউ?
গত প্রায় দেড় বছর ধরে করোনার তাণ্ডব চলছে দেশে। কয়েক মাসের কঠোর লকডাউনে জীবিকার সঙ্গে চোরাবালিতে আটকে গেছে জীবন ও সংস্কৃতি। নিঃস্ব, অসহায় হয়ে পড়েছেন আয়-কর্ম বন্ধ হয়ে যাওয়া লাখ লাখ মানুষ। ধনী-উচ্চবিত্তরা পরিস্থিতি যতটা সামলাতে পেরেছে নিম্নবিত্ত আর খেটে খাওয়া মানুষেরা ততটাই ব্যর্থ হয়েছে। তাদের এখন টিকে থাকাই দায়। দ্রুত শহরায়নের এ দেশে উল্টো গ্রামায়ন ঘটে চলেছে।
করোনার ভয়াবহতা ঠেকাতে সরকার যথেষ্টই উদ্বিগ্ন। সংক্রমণ প্রতিরোধে নানা পরিকল্পনা-উদ্যোগ নিচ্ছে। সামাজিক নিরাপত্তা বাড়াতে প্রণোদনাসহ সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। তবে জাতির এই দুর্যোগের মধ্যেও কিছু লোভী স্বার্থপর ঘরপোড়া আগুনে আলুপোড়া খাওয়ার জোগাড় করেছেন। আবার সরকারের বিভিন্ন দপ্তরেও দেখা গেছে সমম্বয়হীনতা। যাদের কারণেই সরকারের নানা ধরনের সহায়তা ঠিকমতো পৌঁছাচ্ছে না দুর্গতদের কাছে। যখন বাংলাদেশ মধ্য-আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার চেষ্টা করছে, প্রবাসী আয় আর প্রবৃদ্ধি বেড়েই চলছে, তখন নীরব দর্শকের ভূমিকা না নিয়ে বরং এই মহাদুর্যোগকে সম্মিলিতভাবে মোকাবিলা করতে হবে।
বিশেষ করে জাতির এই ক্রান্তিকালে দেশের শিল্পপতি ও ধনীদের আগে এগিয়ে আসতে হবে। গত কয়েক দশকে দেশে অসংখ্য লাখ আর কোটিপতির জন্ম হওয়ার নজির রয়েছে। আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়াদের সংখ্যাও কম নয়। ঘুষ খেয়ে গাড়ি বাড়ি করা লোকদের সংখ্যা সংবাদের শিরোনামে যা আসে তার চেয়েও বেশি। ‘দুশ টাকার বালিশ দুই লাখ টাকা’ দেখিয়ে ফুলে ফেঁপে উঠেছেন অনেকেই। তোশক-বালিশের তলায় কোটি কোটি টাকার সন্ধানও পাওয়া গেছে। সুইস ব্যাংকে সয়লাব হয়ে গেছে যেসব বাংলাদেশির টাকায় তারা আজ কোথায়? এই দুর্যোগকালীন তাদের টিকিটিও পাওয়া যাচ্ছে না।
দেশের টাকা পাচার করে বিদেশে যারা বাড়ি বানাচ্ছে সেই আমলা আর ব্যবসায়ীরাইবা কোথায়? যেসব মানুষ আজ কাজ হারিয়ে নিঃস্ব, অসহায়, তাদের শ্রমঘামের টাকাতেই তো তারা ধনী। শ্রমিক-মজুর আর খেটে খাওয়া মানুষদের শ্রম-ঘাম, শোষণ করেই তো তাদের টাকার পাহাড় গড়ে ওঠে। এদেশের শিল্পপতিরা এই দেশের মাটিতেই জিরো থেকে হিরো, শূন্য থেকে কোটিপতি হয়েছে। তাদের আজ এগিয়ে আসতে হবে নিজ উদ্যোগেই, কেউ তাদের ডেকে আনবে না।
আমরা দেখি, যারা লকডাউন আর সামাজিক দূরত্ব না মেনে রাস্তায় নামে, যানবাহনে উঠে বাড়ি ফেরে, তাদের মূর্খ বলে গালি দিই, অবজ্ঞা করি, প্রয়োজনে লাঠিপেটা করি, শাস্তি দিই। কখনও কি ভেবে দেখেছি, তারা কেন নিয়ম ভাঙে, স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করে? ঘরে দুদিনের খাবার থাকলে, ক্ষুধার জ্বালা না থাকলে, সংসার চালানোর নিশ্চয়তা থাকলে কেউ কি পথে নামে? তাই লকডাউনের সুফল পেতে হলে আগে অসহায় মানুষদের খাদ্যনিরাপত্তা দিতে হবে। তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে।
কেউ এখনও নিশ্চিত নন, করোনার তাণ্ডব কবে থামবে? বিশেষজ্ঞরা বার বারই বলে আসছেন, করোনার ভয়াবহতাকে সঙ্গী করেই বাঁচতে হবে, জীবন চালানোর কৌশল করতে হবে। সমাজ আর রাষ্ট্রকে যদি করোনার সঙ্গেই চলতে হয়, তাহলে সবার আগে সবার জন্য খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। যারা আয়ের পথ হারিয়েছে তাদের যেকোনোভাবে পুঁজি দিতে হবে। যেসব তরুণ কর্মসংস্থান খুঁজছে আর যাদের বেকারত্ব দীর্ঘ থেকে দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে জরুরি ভিত্তিতে তাদের জন্য কিছু করতে হবে। জাতীয় স্বার্থেই তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। পরিকল্পনা করতে হবে করোনা পরবর্তী সময়ের প্রভাব কাটানো নিয়ে।
করোনার ভয়াবহতায় বেশি দায়িত্ব রাজনৈতিক নেতাদের। যেকোনো উপায়ে তাদের সবচেয়ে সক্রিয় থাকতে হবে। দুর্গত লোকদের পাশে সার্বক্ষণিক থাকা জরুরি। বিগত সময়ে রাজনীতি যাদের ‘সোনার ডিম দেয়া হাঁস’ হিসেবে ধরা দিয়েছিল এই মহাদুর্যোগে তাদের যেভাবে উপস্থিত হওয়ার কথা ছিল, সেভাবে চোখেই পড়ছে না। সংসদে থাকা বিরোধীদলের কাজ কি কেবল বিরোধিতা করা আর হাস্যকর কথাবার্তা বলে আলোচনায় থাকা? গত বছর দুর্যোগের চরম পরিস্থিতিতে নেতাদের ‘জরুরি ত্রাণ’ দেয়ার ছবি সামাজিক মাধ্যম আর সাংবাদিকের ক্যামেরাতেই সীমাবদ্ধ থাকতে দেখা গেছে।
আবার একসময়কার ব্যাপক জনপ্রিয় একটি রাজনৈতিক দলকে তো শুধু শব্দবোমা ফাটাতেই ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়। যদিও ক্ষমতায় থাকাকালে সেই দলের ব্যাপক লুটপাট করে অর্থ কামানো নেতা বা ব্যবসায়ীদের মাইক্রোস্কোপ দিয়েও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তারা কি তবে ক্ষমতার বাইরে গিয়ে পথে বসে পড়েছেন? চিহ্নিত দলীয় লোকজনের মধ্যে কয়েক পোটলা ত্রাণ বিতরণ করেই কি মহাদুর্যোগে মহাদায়িত্ব পালনই যথেষ্ট মনে করছেন?
আরেকটি দল আছে, যারা সংসদে না থাকলেও রাজপথে মাঝে মধ্যেই রাজনীতির সুনামি বইয়ে দেয়। প্রাচীনকালের লাঠি, সরকি, তলোয়ার, ঘোড়া নিয়ে বিশেষ দিনে (শুক্রবার) দেশ উদ্ধারে হামলে পড়ে। কখনও কখনও বিমূর্ত প্রতিপক্ষের ওপর অভিশাপ আর গজব নাজেল করে। তাদের মধ্যে আবার অনেক নেতা হেলিকপ্টারে উড়ে উড়ে দেশের আনাচে কানাচে শান্তি ফেরি করে বেড়ান। বিনিময়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন। তারা আবার আধুনিক স্টাইলে কোটি টাকার দামি গাড়ি হাকান, থাকেন আলিশান বাড়িতে। ব্যাংক ব্যালান্সও নাকি লাগামছাড়া! তাই দেখে দুর্নীতি দমন কমিশনও (দুদক) তাদের পিছু নিয়েছে। এসব শান্তি বিতরণকারীরা কোথায়? স্বাধীনতার পর থেকেই জাতির কোনো দুর্যোগ-দুর্বিপাকে এদের কাউকে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর কোনো নজির দেখা যায়নি। ট্যাক্স ফাাঁকি দিয়ে আয় করা লাখ লাখ, কোটি কোটি টাকার কিছু অংশ নিয়ে তারা কি আজ দুর্গত মানুষদের পাশে দাঁড়াতে পারেন না?
করোনার ধাক্কায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তীব্র খাদ্য-সংকটের আশঙ্কা প্রকাশ করছেন বিশেষজ্ঞরা, এমনকি মহামারির প্রভাবে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে দুর্ভিক্ষ হতে পারে বলেও ভবিষ্যদ্বাণী করা হচ্ছে। এমন পরিস্থিতির জন্য সম্ভাব্য প্রস্তুতিও নিচ্ছে অনেক দেশ। বাংলাদেশ খাদ্যে অনেকটাই স্বয়ংসম্পূর্ণ হলেও কৃত্রিম সংকট যে কেউ তৈরি করবে না তা আগে থেকে বলা যায় না।
আমাদের মনে আছে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৪ সালে দুর্ভিক্ষ হয়েছিল। যা বঙ্গবন্ধু সরকারকে বেকায়দায় ফেলতেই আয়োজনটা করা হয়। সেই দুর্ভিক্ষ খাদ্যের অভাবে নয়, হয়েছিল সুষম বণ্টনের অভাবে। বিদেশ থেকে প্রচুর খাদ্য আমদানি করেছিল বঙ্গবন্ধু সরকার; তবে সেসব মাটির তলার গুদামে রেখে তৈরি করা হয়েছিল কৃত্রিম সংকট। এ কাজটি করা হয়েছিল অত্যন্ত দক্ষতা ও চতুরতার সঙ্গে। ঘটনা কোথা থেকে কীভাবে হচ্ছে তা বুঝতেই পারেনি কেউ। বঙ্গবন্ধু যখন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটিকে জানপ্রাণ দিয়ে পুনর্গঠিত করার চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন ঠিক তখনই এই ঘটনা ঘটানো হয়। সদ্য স্বাধীন দেশের নতুন সরকারকে ব্যর্থ করাই ছিল তাদের লক্ষ্য।
বঙ্গবন্ধুর অগাধ আত্মবিশ্বাস, সবার প্রতি অতিবিশ্বাস আর সীমাহীন উদারতার সুযোগ নিয়েছিল তখনকার ওই প্রতিক্রিয়াশীলরাই। সেই চক্র কিন্তু আজও ওঁত পেতে আছে। জাতির সামনে আসা এই দুর্যোগে সরকার সতর্ক না হলে, শত্রুমিত্র বুঝতে বা চিহ্নিত করতে না পারলে আবারও তারা বিপদে ফেলতে পারে। তাই জাতির এই দুর্যোগকালে সবচেয়ে বেশি তৎপর ও সতর্ক থাকতে হবে তাদেরই, যারা বুকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ করেন।
আমরা জানি, আমাদের অর্থনীতি অনেক বড় হয়েছে। নিজস্ব অর্থায়নেই কিছু বড় কাজ করছি আমরা। মহাদুর্যোগের মধ্যেও বিশ্বের বহু দেশকে টপকে গেছে আমাদের অর্থনীতি। প্রবাসী আয় না কমে বরং বেড়েছে। একই সঙ্গে প্রবৃদ্ধিহারও উচ্চ। তবে অর্থনীতির এই ইতিবাচক দিক নিয়ে বেশি আত্মতুষ্টিতে ভুগলে বিপদ বাড়ার সম্ভাবনাই বেশি।
সরকারের নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দলে এখন অনেক সংকট দেখা দিয়েছে। দলের অনেকের মধ্যেই স্বার্থপরতা আর লোভ বেড়েছে। অনেকে ক্ষমতার অপব্যবহার করছেন। অনেকে মাঠের প্রকৃত চিত্র বা বাস্তবতা বঙ্গবন্ধুকন্যার কাছে তুলে ধরছেন না বলেই মনে হচ্ছে। সে কারণে সরকারের অনেক সিদ্ধান্ত নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি সমালোচনা হচ্ছে। তাছাড়া দলীয় কোন্দল আর স্বার্থপরদের ব্যবহার করে যেসব প্রতিক্রিয়াশীল দলে অনুপ্রবেশ করেছে তারাও বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা করছে।
অপরদিকে মৌলবাদী মানসিকতার বহু নেতা ঠাঁই পেয়েছেন বঙ্গবন্ধুর দলটিতে। যে বাস্তবতার কথা অনেক নেতা প্রকাশ্যেই বলছেন। বাস্তবতাকে গুরুত্ব না দিলে সরকারের ভাবমূর্তিকে যেকোনো ঘটনায় ম্লান করে দিতে পারে। জাতীয় এই দুর্যোগ মোকাবিলায় এসব কিছুই মাথায় রাখতে হবে সরকারের। সে মোতাবেক সিদ্ধান্তও নিতে হবে। তবে সবার আগে দেশের নিম্নবিত্ত প্রান্তিক অসহায় মানুষের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
মনে রাখা দরকার, ক্ষুধার জ্বালা না মিটিয়ে কঠিন-কঠোর আইন প্রয়োগে গোটা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীবাহিনী নিয়োজিত করেও কোনো লাভ হবে না। জাতীয় জীবনে একাত্তরের মতোই আরেকটা যুদ্ধের মধ্যেই আছি আমরা। যে যুদ্ধে সব শত্রুই অদৃশ্য। অদৃশ্য এই শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে জিততে হলে সম্মিলিত মানবিক প্রচেষ্টা ও সহানুভূতির বিকল্প নেই।
লেখক: কবি ও সাংবাদিক।