বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

ধর্ষিতার সন্তানের দায়িত্ব কে নেবে?

  •    
  • ২ জুলাই, ২০২১ ১১:৪৮

বিচারপতি, আইনজীবী, মানবাধিকার ও নারী সংগঠনগুলো অনেক আগে থেকেই ব্রিটিশ আমলে প্রণীত সাক্ষ্য আইনের ওই ধারাটিকে বাতিল বা সংশোধনের দাবি তুলেছিলেন। আইনের এই ধারাটি এতটাই অদ্ভুত ও দুঃখজনক যে, নারী যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে বিচার চাইতে গেলে, উল্টো তার চরিত্র নিয়েই আসামিপক্ষের আইনজীবী কথা বলেন। সবার প্রশ্ন ছিল, ধর্ষণ কী, এ ব্যাপারে আইনে সুস্পষ্ট সংজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও কেন ভুক্তভোগী নারীকে তার নৈতিক চরিত্রের পরীক্ষা দিতে হবে?

জাহানারা ( ছদ্মনাম) ছোট একটা বাচ্চা কোলে নিয়ে যখন শহরের মীরপুরের একটি বস্তিতে আসে, তখন তার হাতে ছিল মাত্র এক হাজার টাকা। জামালপুরের একটি গ্রামের কিশোরী মা এই জাহানারা। বাচ্চার বাবা এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তির ছেলে মোতাহার। মোতাহারদের বাসায় জাহানারা কাজ করত। জোরজবরদস্তি করে ছেলেটি তাকে দুবার ধর্ষণ করেছিল। পরে জাহানারা গর্ভবতী হয়ে পড়লে এলাকায় সালিশ বসে এবং তাদের পরিবারকে একঘরে করে দেয়া হয়। তবে সালিশে ওর পরিবারের হাতে ৫০০০ টাকা তুলে দেয়া হয় মুখ বন্ধ রাখার জন্য।

এরকম জাহানারার কাহিনি কিন্তু একটা নয়। গ্রাম ও শহরে খুঁজলে আরও অনেক পাওয়া যাবে। পারিবারিক গণ্ডির মধ্যে, রাস্তাঘাটে, কর্মস্থলে, যানবাহনে নারী যৌন নিপীড়ন ও ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। এই ধর্ষণের শিকার হয়ে বা প্রেম করে সঙ্গীকে বিশ্বাস করে যৌন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার পর অনেক নারীই সন্তান ধারণ করেন। এই অবস্থায় কেউ কেউ সন্তানের জন্ম দিতে বাধ্য হন। কেউ গর্ভপাত ঘটান, আর কেউ নামমাত্র বিয়ে করে সমাজের লজ্জার হাত থেকে রক্ষা পান।

কিন্তু আমরা কি কখনও ভেবে দেখেছি, সেইসব পরিচয়হীন সন্তানের বেঁচে থাকাটা কতটা ভয়াবহ হয়। হয় মা তাকে আঁকড়ে থেকে গ্রাম বা ভিটেছাড়া হয়, নয়ত সালিশের মাধ্যমে একটা অগ্রহণযোগ্য ফয়সালা হয়, অথবা কোনো এতিমখানায় শিশুটি বেড়ে ওঠে পরিচয়হীন শিশু হিসেবে। সাধারণত ধর্ষণের শিকার হয়ে কোনো নারী সন্তানের মা হলে, এর দায়িত্ব কেউ নেয় না। সমাজ তাকে অচ্ছুত ঘোষণা করে।

অথচ অদ্ভুত ব্যাপার, যে লোকটি তাকে ধর্ষণ করে, যে লোকটি সন্তানের পিতা হয়েও সহজেই অস্বীকার করছে তার পিতৃত্ব, সমাজ কিন্তু তাকে কিছু বলে না। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারাই সমাজের মতো মোড়ল হয়ে যায়। সমাজ কখনও তাদের দিকে আঙুল তোলে না।

আছিয়া (ছদ্মনাম) কুড়িগ্রামের গ্রামের স্কুলে পড়ত। প্রতিদিন স্কুলে যাওয়া-আসার সময় গ্রামের ধনী বাড়ির ছেলে তাকে বিরক্ত করত। একদিন ধরে নিয়ে ধর্ষণ করে। আছিয়া বাসায় এসে বাবা মাকে বলে। তারা এলাকার মোড়লদেরও বলেছিল। কিন্তু তারা প্রত্যেকেই আছিয়াকে অবিশ্বাস করেছে, ঘটনার সাক্ষী চেয়েছে।

প্রকৃতপক্ষে, একজন নারী যখন ধর্ষণ বা যৌন হয়রানির অভিযোগ তোলেন, তখন তার মামলা থেকে শুরু করে তদন্ত এবং বিচার প্রতিটি ক্ষেত্রেই সেই নারীকে সন্দেহ বা অবিশ্বাস করা হয়। সমাজ, আইন, পুলিশ, স্থানীয় প্রশাসন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নারীকে বা ভিকটিমকে দায়ী করে। সেখানে সন্তানের পিতৃপরিচয় বা দায়িত্ব কে নেবে, এটা ভাবারতো কোনো প্রশ্নই আসে না।

ভাবটা এমন যে ধর্ষণের শিকার নারী গর্ভবতী হয়ে খুব অপরাধ করে ফেলেছেন এবং সন্তানের দায়-দায়িত্ব তাকেই নিতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক তাসলিমা ইয়াসমিন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন নিয়ে কাজ করেন। তিনি বলেছেন, ‘যখনই একজন নারী আসবেন আদালতে যৌন হয়রানির অভিযোগ নিয়ে, এখানে প্রথমেই ধরে নেয়া হয় যে, তিনি হয়ত সত্য কথা বলছেন না, তিনি মিথ্যা বলছেন।’ (বিবিসি)

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নীনা গোস্বামী বলেছেন, ১০ বছর ধরে তারা প্রায় তিনশটি ধর্ষণের মামলায় আইনি সহায়তা দিয়েছেন। কিন্তু বেশিরভাগ মামলারই বিচার শেষ করা যায়নি। সমস্যাটা হচ্ছে ধর্ষণ মামলায় বিচারের দীর্ঘসূত্রতা ( বিবিসি)।

কাজেই এখান থেকে বোঝা যায় ধর্ষণের শিকার নারীর গর্ভে যে শিশু জন্মগ্রহণ করে, তার পিতৃত্বের অধিকার আদায় করার কাজটি আরও কতটা সুদূর পরাহত। মাকে আগে প্রমাণ করতে হবে তিনি ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, এরপর তার গর্ভস্থ সন্তানের পিতৃত্বের প্রশ্ন আসে। তবে মুশকিলটা হয়ে যায় ধর্ষণের শিকার নারী বা যৌন হয়রানির শিকার নারীকে মামলার শুনানিতে আইনের সুযোগ নিয়ে তার চরিত্র নিয়ে প্রতিপক্ষের আইনজীবী এমন সব প্রশ্ন করেন, তার মাধ্যমে তাকে আরেকবার হেনস্থা করা হয়।

সাক্ষ্য আইনটা অনেক দিনের পুরানো। এই আইনে বলা আছে, ডিফেন্স নেয়ার জন্য ডিফেন্সের আইনজীবী ক্ষতিগ্রস্ত নারীর চরিত্র তুলে প্রশ্ন করতে পারবে। এর ফলে সারভাইভার কোর্টে সাক্ষ্য দিতে এলে আসামিপক্ষের আইনজীবী ডিফেন্সের নাম করে তাকে চরিত্র তুলে নানা রকম হয়রানিমূলক প্রশ্ন করে।

সাক্ষ্য আইন ১৮৭২-এর ১৫৫ (৪) ধারা অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি যখন ‘বলাৎকার বা শ্লীলতাহানির চেষ্টার’ অভিযোগে ফৌজদারিতে সোপর্দ হন, তখন দেখানো যেতে পারে যে অভিযোগকারী সাধারণভাবে ‘দুশ্চরিত্রা’। তবে আশার কথা হলো যে ধর্ষণ মামলায় ধর্ষণের শিকার নারীর চরিত্র নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করার সুযোগ আইন থেকে বাদ দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। সেজন্য সরকার বিদ্যমান সাক্ষ্য আইন সংশোধনে কাজ করছে বলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক গত ৩০ জুন ২০২১ সংসদে জানিয়েছেন।

বিচারপতি, আইনজীবী, মানবাধিকার ও নারী সংগঠনগুলো অনেক আগে থেকেই ব্রিটিশ আমলে প্রণীত সাক্ষ্য আইনের ওই ধারাটিকে বাতিল বা সংশোধনের দাবি তুলেছিলেন। আইনের এই ধারাটি এতটাই অদ্ভুত ও দুঃখজনক যে, নারী যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে বিচার চাইতে গেলে, উল্টো তার চরিত্র নিয়েই আসামিপক্ষের আইনজীবী কথা বলেন। সবার প্রশ্ন ছিল, ধর্ষণ কী, এ ব্যাপারে আইনে সুস্পষ্ট সংজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও কেন ভুক্তভোগী নারীকে তার নৈতিক চরিত্রের পরীক্ষা দিতে হবে?

বাংলাদেশে ধর্ষণের শিকার নারীকে যে ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়, তা থেকেই ধর্ষণের শিকার নারীর সন্তান হলে, তার ব্যয়বহন করার কথা আইনে বলা আছে। অথচ বাংলাদেশে ধর্ষণের মামলা শেষ হতে দশ বা বিশ বছরও লেগে যায়। বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড সার্ভিসেস ট্রাস্টের এক গবেষণা অনুযায়ী ২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের আওতায় নিষ্পত্তি হওয়া ৫০টি মামলার মধ্যে মাত্র ৩টি মামলায় জরিমানার অর্থকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে গণ্য করার আদেশ দিয়েছে আদালত। শতাংশের হিসেবে যা মাত্র ৬%। এই হিসাব থেকে সহজেই অনুমেয় ধর্ষণের শিকার নারীর সন্তান কতদিন পরে কী সুবিধা পেতে পারে।

শুধু যে দেশের ভেতরেই নারীরা ধর্ষণের শিকার হয়ে সন্তান ধারণ করছেন, তা নয়। অভিবাসী নারী শ্রমিকরা গত কয়েক বছরে বিদেশে চাকরি করতে গিয়ে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন এবং পরে সন্তান নিয়ে দেশে ফিরেছেন বেশ কয়েকজন নারী।

ব্র্যাকের একটি হিসেব অনুযায়ী অতি সম্প্রতি এই ধরনের ১২টি ঘটনা ঘটেছে এবং গত পাঁচ বছরে অন্তত দশ হাজার নারী নিপীড়িত হয়ে এবং আশাভঙ্গের বেদনা নিয়ে ফিরেছেন সৌদি আরব থেকে। ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড সন্তানসহ দেশে ফেরা ১৫ নারী শ্রমিকের পুনর্বাসনের উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে। তবে কতজন নারী কাজ করতে গিয়ে সন্তান নিয়ে ফিরেছেন, সেই তথ্য কোথাও সংরক্ষণ করা নেই। (প্রথম আলো)।

কিন্তু কেন এমনটা হবে? কেন এসব নারীকর্মীকে নিপীড়িত-নির্যাাতিত হয়ে, মান সম্মান, টাকা-পয়সা সব হারিয়ে সন্তান কোলে নিয়ে ফিরে আসতে হচ্ছে। এসব সহায় সম্বলহীন, নিরক্ষর বা কম পড়াশোনা জানা মেয়েরা যখন রেমিটেন্স-যোদ্ধা হিসেবে বিদেশে যান তখন তাদের বাংলাদেশ দূতাবাসের আওতাধীন বা মনিটরিংয়ে থাকার কথা।

বাংলাদেশের দূতাবাসের উচিত নারী অভিবাসী শ্রমিকদের নিয়োগকর্তার নাম পরিচয় খুঁজে বের করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ এবং নির্যাতিত নারীদের সন্তানসহ ক্ষতিপূরণ দেয়ার ব্যবস্থা করা। কিন্তু দেখা যায় যে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে লেবার এটাচি মামলা করার উদ্যোগ নেয় না, মামলা হলেও অভিবাসী নারীকর্মী দেশে চলে আসায় মামলাটি চলমান থাকে না।

কাজেই ধর্ষণের শিকার নারীর সন্তানের দায়িত্ব রাষ্ট্রের হলেও, অবশেষে মাকেই সেই শিশুর দায়িত্ব নিতে হচ্ছে। আর একসময় সমাজের চাপে সেই অসহায় মাকে তার আদরের সন্তানকে বেওয়ারিশ হিসেবে ফেলে দিতে হয়, নয়ত কোনো এতিমখানায় পিতৃপরিচয়হীন সন্তনটি বড় হতে থাকে। মামলার দীর্ঘসূত্রতার কারণে ধর্ষণের শিকার নারীর সন্তানের দায়িত্ব বা পরিচয় একসময় বিবর্ণ হয়ে পড়ে।

লেখক: প্রাবন্ধিক, সিনিয়র কো-অর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন

এ বিভাগের আরো খবর