বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

‘বিধ্বস্ত শহর ছেড়ে যেতে যেতে’

  • লাভা মাহমুদা   
  • ১ জুলাই, ২০২১ ১২:৩৩

যুগ-যুগান্তরের পথপরিক্রমায় যে শহরের অলিগলি-রাজপথের প্রতিটি ধূলিকণায় মিশে আছে নিজের প্রাণের স্পন্দন, ধমনিতে বইছে যে শহরের রক্তস্রোত; সেই শহর এখন আর তার আপন কেউ নয়, দূরের, বহু দূরের। অথচ এই শহর বিনির্মাণে তারও ঘাম আছে, শ্রম আছে, বিনিয়োগ আছে, আছে ভালোবাসাও। সেই শহরেই সে এখন পরিযায়ী। অনেকটা অচ্ছুতই বলা যায়।

এ লেখার শিরোনামটি কবি নাসির আহমেদের একটি আলোচিত কাব্যগ্রন্থের। সেই ১৯৯৯ সালে প্রকাশিত গ্রন্থটির শিরোনাম আজও কত প্রাসঙ্গিক। বিধ্বস্ত শহরের নাগরিকের মর্মযাতনা প্রকাশ পেয়েছে শিরোনামটির মধ্যে। আমাদের আলোচনার বিষয় এটি নয়; উন্মূল হওয়া অসহায় মানুষ আবার শেকড় খুঁজছে সেটিই বলার চেষ্টা। এবার মূলকথায় প্রবেশ করা যাক।

রাতের আঁধারে ট্রাকে কিংবা পিকআপ ভ্যানে গাদাগাদি করে জিনিসপত্র তুলে চোখের জল মুছতে মুছতে গত এক বছর থেকেই প্রতিনিয়ত শহর ছাড়ছে মানুষ। আর দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবছে, এতদিন সে কেন বুঝতে পারেনি, এ শহরটি তার নিজের নয়। অধিকাংশেরই জীবনের লম্বা সময় পার করলেও শহরটি তার একান্ত হতে পারেনি।

একদিন লাল-নীল, সবুজ নিয়ন বাতির ঔজ্জ্বল্যে আকৃষ্ট হয়ে স্বপ্নের জাল বুনতে বুনতে একবুক আশা নিয়ে পা রেখেছিল রঙিন এ শহরে। টিকে থাকার নিরন্তর সংগ্রামে ক্লান্ত হয়েছে কিন্তু পরাজিত হয়নি। কারণ পরাজিত হওয়ার জন্য কেউ স্বপ্ন দেখে না। সেই স্বপ্নেরা বেঁচে ছিল বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ। যে স্বপ্নে ছিল আশা-ভালোবাসা, আশ্বাস আর বিশ্বাস।যুগ-যুগান্তরের পথপরিক্রমায় যে শহরের অলিগলি-রাজপথের প্রতিটি ধূলিকণায় মিশে আছে নিজের প্রাণের স্পন্দন, ধমনিতে বইছে যে শহরের রক্তস্রোত; সেই শহর এখন আর তার আপন কেউ নয়, দূরের, বহু দূরের। অথচ এই শহর বিনির্মাণে তারও ঘাম আছে, শ্রম আছে, বিনিয়োগ আছে, আছে ভালোবাসাও। সেই শহরেই সে এখন পরিযায়ী। অনেকটা অচ্ছুতই বলা যায়।

এটাই নাকি বাস্তবতা! কিন্তু এ কেমন বাস্তবতা?

শহুরে নিম্নবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত বা মধ্যবিত্তের জীবনটা শুরুই হয় তীব্র লড়াই দিয়ে। আয়-রোজগারের সঙ্গে ব্যয়ের প্রভেদের ফাঁকটা কোনোভাবেও পূরণ করতে পারে না। বার বার হোঁচট খায়, আবার উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। একটু উন্নত জীবন মান, একটু স্বচ্ছলতা, সন্তানদের একটু ভালো প্রতিষ্ঠানে পড়ানো, একটু ভালো চিকিৎসা...এ দায়িত্বটুকু পালন করতেই হাঁপিয়ে উঠতে হয়, সঞ্চয় বলতে অবশিষ্ট কিছুই থাকত না। ফলে করোনাকালের কর্মহীনতায় এ মানুষগুলো প্রচণ্ড সংকটে পড়েছে। মূল সংকটটা বাসাভাড়া নিয়ে। অনেকের বাসাভাড়া জমেছে মাসের পর মাস। চাকরি বা ব্যবসা না থাকায় অর্থনীতির শেষ সমতাটুকুও নষ্ট হয়ে গেছে। তাই কেউ নিজে মেসে উঠে পরিবারকে গ্রামে রাখছে, কেউবা সপরিবারে গ্রামেই চলে যাচ্ছে। এই অনিবার্য বাস্তবতায় হতোদ্যম মানুষ ভেঙে পড়ছে ঠিক প্রচণ্ড ঝড়ে চূর্ণবিচূর্ণ হওয়া বৃক্ষের মতো। মহামারি করোনা তাদের জীবনে যে বিপর্যয় নিয়ে এসেছে তা অভাবনীয়। দীর্ঘকালে তিলে তিলে গড়ে তোলা সংসার ফেলে অথবা কোনোরকমে সঙ্গে নিয়ে ফিরে যাচ্ছে অনিশ্চয়তার সেই গ্রামে। অনেকদিন আগে ভালো থাকার বাসনা নিয়ে যে গ্রাম ছেড়ে এসেছিল, সেই গ্রামে ফিরে কী করে টিকবে, কিছুই জানে না এই মানুষগুলো। জনবহুল শহরে জীবিকানির্বাহ কিছুটা সহজ হলেও, অর্থনীতির গতিপ্রবাহ শ্লথ হওয়ায় মফস্বলে বা গ্রামে ঠিক ততটাই কঠিন।করোনা তাণ্ডবে লণ্ডভণ্ড হয়ে যাচ্ছে সবকিছু। ভেঙে পড়ছে একের পর এক আয়ের উৎসগুলো। কয়েক লাখ গার্মেন্টস শ্রমিক বেকার হয়েছে অথবা হওয়ার পথে। সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে ব্যবসা, বন্ধ হয়ে আছে শিল্প কারখানা, হোটেল, স্কুল-কলেজ, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। প্রাইভেট স্কুল কলেজের শিক্ষক, হাউজ টিউটর থেকে শুরু করে ছোট বড় চাকরিজীবী অনেকেই কাজ হারিয়ে ঢাকা ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। মাঝারি বা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরাও টিকতে না পেরে নিদারুণ অসহায় অবস্থায় পড়েছেন।বেতন আটকে গেছে অনেক প্রতিষ্ঠানে। কেউবা দু’মাসে একবার বেতন পাচ্ছেন, কেউবা অর্ধেক। ব্যাংক বিমা থেকে শুরু করে বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান তাদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন কমিয়েছে। বলা হচ্ছে, সরকারি চাকরিজীবী ছাড়া আর কেউই ভালো নেই, আর্থিক নিরাপত্তায় নেই।ফাঁকা হচ্ছে শহরের বাসাগুলো। এখন সবখানেই ‘টু লেট’ বিজ্ঞাপনের ছড়াছড়ি। বাসাভাড়ার এত বিপুলসংখ্যক বিজ্ঞাপন আগে কখনো দেখেনি শহরের মানুষ। অনেক বাড়িওয়ালাও রয়েছেন বিপাকে, ভাড়াটিয়াও পাচ্ছেন না। বাড়ির মালিকেরা, যারা বড় অঙ্কের ঋণ নিয়েছেন ব্যাংক বা ফিন্যান্স থেকে, তাদেরও মাথায় হাত। এই ঋণ শোধ করে তারাইবা টিকে থাকবেন কীভাবে? তবে শুধু শহর নয়, বিভিন্ন গবেষণা সংস্থার যৌথভাবে পরিচালিত জরিপে দেখা যাচ্ছে, সারা দেশে এ পর্যন্ত ১০ কোটির বেশি মানুষ আর্থিক ঝুঁকিতে পড়েছে।

এপ্রিল পর্যন্তই দেশে প্রায় দেড় কোটি মানুষ কর্মহীন হয়েছে। করোনায় দেশে নতুন করে দরিদ্র হয়েছে দুই কোটি ৪৫ লাখ মানুষ।গবেষণাপ্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) যৌথ উদ্যোগে জরিপে দেখা গেছে, ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত দেশে এই ‘নতুন দরিদ্র’ শ্রেণির সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ১৪.৭৫ শতাংশ হয়েছে। পিপিআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান আশঙ্কা করছেন, করোনার দ্বিতীয় ঢেউ দারিদ্র্য পরিস্থিতিকে আরও প্রকট করে তুলতে পারে।

বাংলাদেশের মতো একটি মধ্যম আয়ের উন্নয়নশীল দেশে এক বছরেরও অধিক সময় একমাত্র কৃষিখাতের বাইরে উৎপাদনের সব কলাকৌশলে ব্যাঘাত ঘটছে। লকডাউন, শাটডাউন, সাধারণ ছুটি ইত্যাদির ফাঁদে পড়ে তাই আয়ের পথও প্রায় বন্ধ। যেভাবে করোনার ডেল্টা বা ডেল্টা প্লাস ভেরিয়েন্টের প্রকোপ বাড়ছে, তাতে কবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে কেউই জানে না।তাই গ্রামের সেই উপড়ানো শেকড় আবারও নতুন করে প্রোথিত করার প্রয়াসে এবারও শেকড়ে ফিরছে মানুষ। তবে সে ফেরায় আনন্দ-উল্লাস নেই, জীবনের জয়গান নেই, নেই শহুরে জীবনের মোহময় চাকচিক্যের গল্প। আছে শুধুই আক্ষেপ আর নিদারুণ হাহাকার। কে কবে ভেবেছিল, খুব আপন করে পাওয়া এ শহরটাই একদিন হয়ে যাবে অচিনপুর! হয়তো অনেক দিন পর একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসবে, ভালোবাসার সেই শহরটা একদিন আমারও ছিল।

লেখক: প্রাবন্ধিক, শিক্ষক।

এ বিভাগের আরো খবর