বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়: ‘পাচার হওয়া’ মেধা ফিরে আসুক

  •    
  • ৩০ জুন, ২০২১ ১৪:৫৪

সেরা মেধার অধিকারী ছাত্রছাত্রীরা যদি বিশ্ববিদ্যালয়ে না থাকে তাহলে আমরা কীভাবে র‌্যাংকিংয়ে উন্নতি করব? কিন্তু আমরা চাইলেই কি বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা মেধাবীদের ফিরিয়ে আনত পারব? অন্যভাবেও বলা যায়- স্বেচ্ছায় যদি অনেকে একযোগে আসতে চান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কি তাদের যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারবে? তারা গবেষণার সুযোগ পাবেন?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শতবর্ষ পূরণ করল। করোনাকালে এ উপলক্ষে মিছিল-সমাবেশ-আনন্দ উৎসব আয়োজন করা সম্ভব নয়। এ প্রতিষ্ঠানের দুর্ভাগ্য, প্রতিষ্ঠার সুবর্ণজয়ন্তীর বছর ১৯৭১ সালে ছিল পাকিস্তানিদের গণহত্যা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সে সময়ের প্রায় দুশ ছাত্রছাত্রী-শিক্ষক-কর্মচারী মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ দিয়েছেন।

বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছিল অগ্রণী ভূমিকা। কিন্তু এ ভূমিকার কারণে পাকিস্তানের বর্বর হানাদারবাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে পরিণত করেছিল বধ্যভূমিতে। ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইটের নীলনকশা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে তারা প্রথম টার্গেটে রেখেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে। ১ জুলাই সুবর্ণজয়ন্তী পালনের প্রশ্ন সংগত কারণেই আসেনি। ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক ও কর্মচারী- কারো জীবনের নিরাপত্তা ছিল না।

কেবল মানুষ নয়, ছাত্রছাত্রীরা বটতলায় সমাবেশ করে স্বাধীনতা ও মুক্তির কথা বলে- এ ক্ষোভ ও রোষ থেকে তারা এমনকি কলাভবনের সামনের বটগাছটিও সমূলে উপড়ে ফেলে। গুড়িয়ে দেয়া হয় কেন্দ্রীয় শহীদমিনার। মধুর ক্যান্টিনও রেহাই পায়নি। ক্যান্টিনের মালিক মধুসূদন দেকে স্ত্রী-পুত্র-পুত্রবধূসহ হত্যা করা হয়। তাদের স্থান হয় আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন দার্শনিক ড. জিসি দেবসহ আরও অনেকের সঙ্গে জগন্নাথ হলের বধ্যভূমিতে।

স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং ভাষা আন্দোলন, সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন প্রভৃতি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে ঢাকা বিশ্বদ্যিালয়ের অবদান সচরাচর আলোচনায় আসে। কিন্তু এ প্রতিষ্ঠানে কী ধরনের গবেষণা কাজ পরিচালিত হয়, সেটা কমজনেই জানার সুযোগ পায়। আরেকটি অভিযোগ শুনি- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ও গবেষণার মান নিম্নমুখী।

এ কালের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকেরা আগের মতো নেই- এ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি দেয়াই যায়। তবে শতবর্ষ উপলক্ষে আমি বিশেষভাবে আলোচনায় আনতে চাই ‘মেধা পাচার’ এবং এই পাচার হওয়া মেধা ফিরিয়ে আনার বিষয়টি।

গত একশ’ বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সেরা ছাত্র-ছাত্রী হিসেবে যারা উত্তীর্ণ হয়েছেন এবং যারা শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন- তাদের একটি অংশ এ প্রতিষ্ঠানের, এমনকি এ ভূখণ্ডের বাইরে নানা পেশায় কাজ করছেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতেও অনেকে উন্নত বিশ্বে যাচ্ছেন শিক্ষা-গবেষণা-পেশার সূত্রে। এটা এক অনন্য উপহার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে। ভালো সুযোগ পাওয়া থেকে ব্যক্তিগত হিসাব-নিকাশ, অনেক কারণ রয়েছে এভাবে চলে যাওয়ার পেছনে। বিষয়টিকে কেউ কেউ মেধাপাচার হিসেবও অভিহিত করে থাকেন।

অনেকে বলেন, সেরা মেধার অধিকারী ছাত্রছাত্রীরা যদি বিশ্ববিদ্যালয়ে না থাকে তাহলে আমরা কীভাবে র‌্যাংকিংয়ে উন্নতি করব? কিন্তু আমরা চাইলেই কি বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা মেধাবীদের ফিরিয়ে আনত পারব? অন্যভাবেও বলা যায়- স্বেচ্ছায় যদি অনেকে একযোগে আসতে চান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কি তাদের যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারবে? তারা গবেষণার সুযোগ পাবেন? প্রয়োজনীয় অর্থও বরাদ্দ মিলবে? নিকট ভবিষ্যতে কি এমন সক্ষমতা তৈরির সম্ভাবনা রয়েছে?

কিন্তু তথ্য-প্রযুক্তির অনন্য বিকাশের এ যুগে সবার শারীরিকভাবে ফিরে আসার কি দরকার? সাবেক ছাত্র বা ছাত্রীদের কেউ হয়ত উন্নত বিশ্বের কোনো বড় শিক্ষা বা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন। কেউ বিজ্ঞানের উদ্ভাবনে যুক্ত রয়েছেন। তারা যুক্ত হতে পারেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে। তারা অন্যদের গবেষণার সুযোগ করে দিতে পারেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যেন বিশ্বমানের প্রতিষ্ঠানে তার সেরা ছাত্রছাত্রীদের পাঠাতে পারে গবেষণা ও শিক্ষার জন্য, তার ব্যবস্থা করে দিতে পারেন। এভাবেও তারা ফিরে আসতে পারেন, পাচার হওয়া মেধা হবে বিপরীতমুখী।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বের সেরা শিক্ষকদের নিজের পাঠদান প্রক্রিয়ায় যুক্ত করতে পারে। তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী হতে পারে, অন্য দেশের নাগরিক হতে পারে। আমাদের দেশেই ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ যতটা এগিয়েছে, তাতে এমনকি করোনাকালেও বাংলাদেশের নানাপ্রান্তে ছড়িয়ে থাকা ছাত্রছাত্রীরা বিশ্বমানের শিক্ষকের লেকচার শুনতে পারে। এ জন্য অর্থ চাই, চাই প্রযুক্তি। এর জোগান দিতে পাশে দাঁড়াতে পারেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রছাত্রীরা। এটাই হবে নিজের প্রতিষ্ঠানকে শতবর্ষের উপহার।

করোনার ভ্যাকসিন উদ্ভাবনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদের কোনো কোনো শিক্ষক কাজ করছেন। এ প্রচেষ্টা আরও সংগঠিত হতে পারত। এ জন্য বিশ্বব্যাপী তৎপরতা চালানো যেত। বাংলাদেশের কয়েকটি ওষুধ কোম্পানির ভ্যাকসিন উৎপাদনের কারিগরি সক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ফর্মুলা, সেটাই নেই।

উন্নত বিশ্বের কয়েকটি কোম্পানি ব্যবসায়িক স্বার্থে এ ফর্মুলা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বা একাধিক শিক্ষক চাইলেই এ ফর্মুলা উদ্বাবন করতে পারবেন না। কিন্তু চেষ্টা তো করা যেতে পারে। সংঘটিত প্রয়াসে বাধা থাকার কথা নয়। সবচেয়ে বড় কথা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিজেরা কতটা আগ্রহী, সেটা তুলে ধরতে পারেন বাংলাদেশের সামনে, বিশ্বের সামনে।

আমরা মেধাবীদের ফিরিয়ে আনতে চাই। সেরা ছাত্রছাত্রীদের পাশে পেতে চাই। যে যেভাবে পারবেন, পাশে দাঁড়াবেন। শতবর্ষের মহতী উৎসবে শামিল হওয়ার জন্য কেবল শোভাযাত্রা, বেলুন ওড়ানো কিংবা গান-নাচের অনুষ্ঠান গুরুত্বপূর্ণ বটে, কিন্তু অপরিহার্য নয়।

এ উপলক্ষে বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক নানা বিষয়ে ১০০টি গবেষণা কাজ হাতে নিতে পারে। এ প্রতিষ্ঠান অক্সফোর্ড, হার্ভার্ডসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সেরা ছাত্রছাত্রীদের বৃত্তি দিতে পারে বাংলাদেশ নিয়ে গবেষণার জন্য। গবেষণার বিষয়বস্তু নির্ধারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরামর্শ দিতে পারে।

২০৪১ সালের ভিশন সামনে রেখে নির্ধারণ হতে পারে বিষয়বস্তু। অন্যদের কাছেও পরামর্শ চাইতে পারে। বৃত্তির অর্থের জোগান আসতে পারে বিশ্বের নানা দেশে ছড়িয়ে থাকা আমাদের সাবেক ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে। তারা নিজেদের উপার্জন থেকে অর্থ বা প্রযুক্তি দিতে পারেন, অন্যকে বলতে পারেন। তারা যেসব প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন তাদের কাছ থেকেও গবেষণার বৃত্তি সংগ্রহ করতে পারেন।

এক কথায় শতবর্ষ সামনে রেখে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে সামনের সারিতে থাকা প্রতিষ্ঠানটি এমন বহুবিধ উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে, যা কেবল এ প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা বাড়াবে না- বাংলাদেশকেও উন্নত বিশ্বের কাঙ্ক্ষিত সারিতে পৌঁছে দিতে অবদান রাখবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যে মেধা নানা কারণে ‘পাচার হয়ে গেছে’ সেটা কোনো না কোনোভাবে ফিরিয়ে আনার সংকল্প হোক শতবর্ষে- এটাই কাম্য।

লেখক: মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিকতায় একুশে পদকপ্রাপ্ত।

এ বিভাগের আরো খবর