ভারতীয় উপমহাদেশের দীর্ঘস্থায়ী সংকট কাশ্মির সমস্যা। ভূ-স্বর্গ বলে পরিচিত, ভারতের (অবিভক্ত) সবচেয়ে আকর্ষণীয় পর্যটন এলাকা অনেকদিনের রাজনৈতিক অসহায়ত্বের শিকার।
হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িকতা, এর ফলে দফায় দফায় সংঘটিত ভয়াবহ দাঙ্গার পটভূমিতে সাম্প্রদায়িক দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালের আগস্টে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। রাজনৈতিক-প্রশাসনিক অঙ্গন থেকে বিদায় নিতে বাধ্য হয় ব্রিটিশরা। এ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দীর্ঘ দু’শ বছর ভারত শাসন-শোষণ করে।
ব্রিটিশ শাসকের ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে দ্বন্দ্ব সংঘাতের স্থায়ীরূপ দেওয়ার লক্ষ্যে ভারতের কিছু অঞ্চল জটিল করে রেখে চলে যায়। কয়েকটি অঞ্চল ভারত অথবা পাকিস্তান কোন দেশের সঙ্গে যুক্ত হবে সে বিষয়টি অমীমাংসিত রেখে চলে যায়।
কাশ্মিরের জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ মুসলিম হওয়া এবং বাসিন্দাদের মতামত জানার চেষ্টা না করেই কাশ্মির রাজা ভারতের অংশীভূত হওয়ার সিদ্ধান্ত জানালে কংগ্রেসশাসিত তৎকালীন ভারত সরকার কাশ্মিরকে ভারতের অংশীভূত করে নিলে জটিলতা আরও বেড়ে যায়।
পাকিস্তান দাবি করে বসে, যেহেতু কাশ্মিরের সংখ্যাগরিষ্ঠ অধিবাসী মুসলিম তাই কাশ্মির হবে পাকিস্তানের অংশীভূত। ভারত সরকার পাকিস্তানের এই প্রস্তাব সরাসরি নাকচ করে দিলে সংকট আরও তীব্র হয়ে ওঠে। বছরের পর বছর ধরে ভারত ও পাকিস্তান এই দুটি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মধ্যে কূটনৈতিক তর্ক-বিতর্ক শেষে দুই দেশের মধ্যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের সূচনা করে। আর এই যুদ্ধের পরিণতিতে একদিকে যেমন উভয়পক্ষের হাজারও সৈন্য ও নিরপরাধ সাধারণ মানুষ মৃত্যুবরণ করতে থাকে-তেমনি উভয় দেশে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ও তিক্ততাও বাড়তে থাকে। পরিণতিতে যুদ্ধক্ষেত্র ছাড়াও দুটি দেশের নানা অঞ্চলে সংঘটিত হতে থাকে রক্তক্ষয়ী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও সংঘাত।
কাশ্মিরের নিরীহ নিরপরাধ অধিবাসীরা এই দ্বন্দ্ব-সংঘাতের অসহায় শিকারে পরিণত হন। তাদেরকেও দফায় দফায় প্রাণবিসর্জন দিতে হয়। এই দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও অসহায় মৃত্যু থামাতে কাশ্মিরীরা স্বাধীন কাশ্মিরের দাবি উত্থাপন করে।
ইতোমধ্যে পাকিস্তান বিষয়টিকে জাতিসংঘে নিয়ে যায় কিন্তু ভারত বিষয়টি ‘মীমাংসিত’ ও কাশ্মির ভারতের অবিভাজ্য অংশ বলে দাবি করে বহুবার জাতিসংঘের অধিবেশনে পাকিস্তানের তোলা প্রস্তাবের অধিবেশনে অংশগ্রহণ করতে অসম্মতি প্রকাশ করে। ফলে বর্তমান বিষয়টি অমীমাংসিতই রয়েছে। তবে তাদের গৃহীত বহু বছর আগের এক প্রস্তাবে সমস্যাটির শান্তিপূর্ণ সমাধান ও কাশ্মির ‘গণভোট’ অনুষ্ঠানের আহ্বান জানান হয়। বলা হয় গণভোটের মাধ্যমেই সমস্যাটির সমাধান করা কাশ্মিরের পাকিস্তানভুক্তির দাবি অক্ষুণ্ন রেখেও জাতিসংঘের প্রস্তাবটির অনুকূলে পাকিস্তান তার অভিমত প্রকাশ করে।
যুদ্ধে পাকিস্তান এক পর্যায়ে কাশ্মিরের কিছু গুরুত্বপূর্ণ অংশ দখল করে নেয়-বর্তমান সেই অংশ পাকিস্তানের দখলেই রয়েছে। কাশ্মিরের সীমান্তজুড়ে বছরের পর বছর, দশকের পর দশক ধরে উভয় দেশের বিপুলসংখ্যক সৈন্য মোতায়ন রয়েছে। ফলে পরিস্থিতি আজও উত্তেজনাকর থাকায় উভয় অংশের কাশ্মিরীদের জীবন এখনও নিরাপত্তাহীন অবস্থায় রয়েছে। মাঝে মধ্যে উভয় সেনা-বাহিনীর মধ্যে গোলাগুলি বর্ষণ এবং তা নিয়ে দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধাবস্থারও তৈরি হয়। কিন্তু ভারতের অংশীভূত কাশ্মির ভারতের এবং পাকিস্তানের অংশীভূত কাশ্মির আজও রয়ে গেছে।
ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী জওহর লাল নেহেরু ভারতের অংশীভূত কাশ্মিরের বিশেষ মর্যাদার স্বীকৃতি দিয় সংবিধান সংশোধন করে তাতে ৩৭০ নং অনুচ্ছেদ সংযুক্ত করেন। ভারতের অংশীভূত কাশ্মিরবাসীরা এতে সন্তুষ্ট হয়ে স্বাগত জানান। পৃথক রাজ্য হিসাবে স্বীকৃতি পাওয়ার পর ভারতের অন্য রাজ্যের মতো কাশ্মিরেও নিয়মিত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতো এবং ওই নির্বাচনগুলোর মাধ্যমে কাশ্মিরীরা নিজেদের পছন্দমতো সরকার গঠন করে আসছিল।
দীর্ঘকাল পর ভারতের বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি অকস্মাৎ ওই ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল ঘোষণা করে সেখানকার নির্বাচিত সরকার উচ্ছেদ করে কেন্দ্রীয় শাসন জারি করেন সম্প্রতি। প্রচণ্ড বিক্ষোভে ফেটে পড়েন কাশ্মিরবাসীরা। নেমে এলো অস্বাভাবিক নির্যাতন কাশ্মিরবাসীদের ওপর। অঘোষিত সামরিক শাসন চালু করা হলো।
বরখাস্তকৃত মন্ত্রিসভার মুখ্যমন্ত্রীসহ বহু সংসদ সদস্য ও অপরাপর বিক্ষোভকারীদেরকে অনির্দিষ্টকালের জন্য কারারুদ্ধ করা হন। কাশ্মিরের সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ শুধু নয়, সমগ্র কাশ্মিরে ইন্টারনেট বন্ধ স্বাধীনচেতা সাংবাদিকদের গ্রেপ্তার প্রভৃতি কারণে অনেক সংবাদপত্রের প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়। টেলিফোনের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হলো। কায়েম হলো এক ত্রাসের রাজত্ব। কিন্তু পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে নরেন্দ্র মোদির সরকার পুরোপুরি ব্যর্থ হলেন।
২০১৯ সালের ৫ আগস্ট ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের আদেশের বিরুদ্ধে কাশ্মিরবাসী ধারাবাহিকভাবে বিক্ষোভ আন্দোলন অব্যাহত রাখেন। বিক্ষোভ বিদ্রোহে উত্তাল হয়ে ওঠে কাশ্মির উপত্যকা।
ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, স্বৈরশাসন নয়, জনমতের সঠিক, সুস্পষ্ট ও নিরপেক্ষ প্রতিফলনই পারে মানুষের ন্যায্য আন্দোলন থামাতে। দীর্ঘদিন পরে হলেও, মনে হয়, কাশ্মিরবাসী সাফল্যের দিকে এগোচ্ছে বলে মনে হয়।
সংবাদ মাধ্যমগুলোতে প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা যায়, গত ২৪ জুন নরেন্দ্র মোদি কাশ্মিরের সর্বদলীয় নেতৃত্বের সঙ্গে প্রথমবারের মতো বৈঠকে বসেন। ৩৭০ ধারা বিলোপের মাধ্যমে জম্মু ও কাশ্মিরকে দুটি পৃথক রাজ্যে পরিণত করার পর এটিই ছিল দিল্লির নরেন্দ্র মোদি সরকারের সঙ্গে কাশ্মিরী দলগুলোর নেতৃবৃন্দের প্রথম বৈঠক। এতে যোগ দেন আটটি দলের ১৪ শীর্ষস্থানীয় নেতা। বৈঠকে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এবং কাশ্মিরের লেফটেন্যান্ট গভর্নর মনোজ সিনহাও ছিলেন।
সেই বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেন, জম্মু ও কাশ্মিরকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল থেকে আবার রাজ্যের মর্যাদা নেয়া হবে। তবে সেটা করা হবে উপযুক্ত সময়ে। সেই উপযুক্ত সময়ের কোনো ব্যাখ্যা অবশ্য তিনি দেননি।
মোদি জানান, কাশ্মিরের সঙ্গে মনের দূরত্ব এবং দিল্লির দূরত্ব ঘোচাতে হবে। তিনি কাশ্মিরে নির্বাচনের কথাও বলেন। অমিত শাহ্ বলেন, তিনি সংসদেই জানিয়েছিলেন জম্মু ও কাশ্মিরকে রাজ্যের মর্যাদা দেয়া হবে। তার জন্যে ডিলিমিটেশন দরকার নির্বাচনি এলাকাগুলোর।
কাশ্মিরের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ও ন্যাশনাল কনফারেন্স নেতা ওমর আবদুল্লাহ ডিলিমিটেশন প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করে বলেন, ডিলিমিটেশন কেন শুধু কাশ্মিরেই হবে? তিনি জানিয়েছেন, উপস্থিত কাশ্মিরী নেতারা বলেছেন জম্মু ও কাশ্মিরকে পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা দিতে হবে। দিল্লির মতো কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল রেখে বিধানসভা নির্বাচন করালে হবে না। আর প্রশাসনের কাশ্মিরী ক্যাডার আবার ফিরিয়ে আনতে হবে।
ওমর আবদুল্লাহ জানিয়েছেন, কোনো দলই দিল্লির কেন্দ্রীয় সরকারের ডিলিমিটেশন প্রস্তাবে খুশি নয়। অন্যান্য রাজ্যে ডিলিমিটেশন হবে ২০২৬ সালে। তবে কাশ্মিরে এখন কেন? আগে কেন্দ্রীয় সরকার ও কাশ্মিরের মধ্যে আস্থা ফেরানো দরকার।
কাশ্মিরী নেতাদের দাবি মেনে বৈঠকে ঠিক হয়েছে, রাজবন্দিদের মুক্তি দেয়ার দাবি খতিয়ে দেখতে একটা কমিটি গঠন করবেন মনোজ সিনহা। কমিটি বন্দিদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।
২০১৯ এর ৫ আগস্ট ৩৭০ ধারা বাতিলের এক সপ্তাহ আগে থেকেই সেনা নামানো হয়েছিল, ইন্টারনেট বিচ্ছিন্ন করা হয়েছিল। আজও কাশ্মির নিরাপত্তা চাদরে ঢাকা আছে বলে নেতৃবৃন্দ জানান।
কংগ্রেস নেতা গুলাম নবী আজাদ পাঁচটি দাবি জোরের সঙ্গে উত্থাপন করেছেন। দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে- পূর্ণাঙ্গ রাজ্যের মর্যাদা ফেরত দেয়া, বিধানসভার ভোট গ্রহণ, সমস্ত রাজবন্দির মুক্তিদান প্রভৃতি। পিডিপি নেত্রী মেহবুবা মুফতি সরাসরি ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের দাবি জানিয়ে বলেন, আস্থা ও বিশ্বাস ফেরাতে গেলে ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল করতেই হবে। তিনি আরও বলেন, দীর্ঘস্থায়ী শান্তি ফিরিয়ে আনতে হলে পাকিস্তানের সঙ্গেও ভারত সরকারের কথা বলা উচিত।
এখন বিবেচ্য, মোদি সরকার বিরোধী নেতৃবৃন্দের দাবি মেনে কতদিনে ৩৭০ অনুচ্ছেদ পুরোপুরি বাতিল করবেন। কাশ্মিরবাসী এ সমস্যাগুলো মেটাতে অবিলম্বে ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল করে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিকল্প নেই।
লেখক: রাজনীতিক, একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক।