বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

বোমার সঙ্গে ‘অলৌকিকভাবে’ বেঁচে থাকা

  •    
  • ২৯ জুন, ২০২১ ১০:৫৮

বাসাবাড়ি ও কলকারখানায় এই গ্যাস সরবরাহের জন্য পাইপ লাইন নেয়া হয়েছে মাটির তলদেশ থেকে। সেই একই জায়গায় ওয়াসার পানির লাইন, একই জায়গায় টিএন্ডটির টেলিফোন লাইন। ফলে কিছুদিন পরপরই এসব রাষ্ট্রীয় সংস্থা তাদের বিবিধ উন্নয়নকাজের জন্য খোঁড়াখুঁড়ি চালাতে থাকে। ফলে কখন কোথাও গ্যাস লাইনে লিক হচ্ছে, তা বোঝাও মুশকিল। বিশেষজ্ঞরা অনেক দিন ধরেই এ রকম আশঙ্কা করছেন যে, ঢাকার মধুপুর ফল্টে যদি ৫ বা ৬ মাত্রার ভূমিকম্পও হয়, তাহলে ঢাকা শহরে ‘গজব’ নেমে আসবে। ভবনধসে যত না মানুষ মারা যাবে, তার চেয়ে বেশি মানুষের মৃত্যু হবে আগুনে পুড়ে। কারণ ত্রুটিপূর্ণ গ্যাস লাইনের কোথাও একটু আগুনের স্পর্শ পেলে পুরো শহর আগুনের কুণ্ডে পরিণত হবে।

রোববার সন্ধ্যায় রাজধানীর মগবাজার এলাকায় আউটার সার্কুলার রোডের একটি পুরোনো ভবনে বিস্ফোরণের পর সাংবাদিক পলাশ মাহবুব ফেসবুকে লিখেছেন, তিনি ও মাহমুদ মেনন অলৌকিকভাবে বেঁচে গেছেন। আসলে এই শহরে আমরা সবাই এ রকম ‘অলৌকিকভাবেই’ বেঁচে আছি। কে কখন সংবাদ হব, জানি না। মূলত এই শহরটি একটি অ্যাটম বোমার ওপর দাঁড়িয়ে আছে। নিয়মিত বিরতিতে এ রকম বিস্ফোরণে শ শ মানুষের প্রাণহানির পরও এর কোনো সুরাহা হয় না।

অতীতের আরও অনেক ঘটনার মতো মগবাজারের বিস্ফোরণের পেছনেও দায়ী করা হচ্ছে গ্যাসকে। প্রাথমিকভাবে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস ধারণা করছে, গ্যাস জমে ভবনে বিস্ফোরণ ঘটেছে। তিনতলা ভবনের নিচতলায় ফাস্টফুডের দোকান, দ্বিতীয় তলায় সিঙ্গারের একটি গোডাউন ছিল।

বিস্ফোরণের কারণে ব্লাস্ট ওয়েভ ও সাউন্ড ওয়েভ সৃষ্টি হয় বলে ধারণা করা হচ্ছে। ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে তিতাস গ্যাসের কর্মকর্তারাও বলেছেন, ওই ভবনে থাকা শর্মা হাউজে দুটি এলপিজি গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে এই ঘটনা ঘটতে পারে। তবে এত বড় ঘটনার পেছনে শুধু গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণই দায়ী কি না, সে প্রশ্নও এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। সঠিক তদন্ত হলে নিশ্চয়ই আসল রহস্য বেরিয়ে আসবে। তবে রহস্য যা-ই হোক, প্রাণ গেছে মানুষের। হাসপাতালে কাতরাচ্ছে মানুষ— যারা এই ঘটনার জন্য দায়ী নন; যারা এই ঘটনার নিরীহ ও নির্মম শিকার।

স্মরণ করা যেতে পারে, ২০১৬ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর উত্তরায় গ্যাসলাইন বিস্ফোরণে দগ্ধ হয়ে একই পরিবারের চার সদস্যের নির্মম মৃত্যু হয়। ওই বছরের মার্চে বনানীর ২৩ নম্বর সড়কে গ্যাস পাইপলাইনের ত্রুটিপূর্ণ কাজের ফলে সেখানকার একটি ছয়তলা ভবন এতটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল যে, সেটি বসবাসের অযোগ্য ঘোষণা করা হয়। এ ঘটনায় ওই ভবনের মালিকের ছেলে দগ্ধ হন। আহত হন ছয়জন। গণমাধ্যমের খবর বলছে, ভবনের মালিক তিতাস কর্তৃপক্ষকে তিনবার গ্যাসলাইন থেকে গ্যাস বেরোনোর কথা জানালেও কোনো কাজ হয়নি।

গত বছরের ৪ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জের পশ্চিমতল্লা বাইতুস সালাত জামে মসজিদে বিস্ফোরণে যে হতাহতের ঘটনায় ৩০ জনের বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটে, তার পেছনেও রয়েছে এই গ্যাস। তখনও এই ঘটনার পেছনে তিতাসের অবহেলাকে দায়ী করা হয়। মসজিদ কমিটি তখন অভিযোগ করে, গ্যাস লিকেজের বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে লিকেজ মেরামত করতে তিতাস গ্যাস থেকে ৫০ হাজার টাকা ঘুষ চাওয়া হয়। কিন্তু ঘুষ না দেয়ায় তিতাসের লোকজন লিকেজ মেরামত করেনি।

২০১৯ সালের ১৭ অক্টোবর চট্টগ্রামের আনোয়ারায় রোগী বহনকারী একটি অ্যাম্বুলেন্সের গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়ে একই পরিবারের তিনজনের মৃত্যু হয়। এর আগেও সিএনজিচালিত যানবাহনের সিলিন্ডার বিস্ফোরণে অনেকের প্রাণ গেছে।

বস্তুত, গ্যাস সিলিন্ডারের নির্দিষ্ট ব্যবহার-উপযোগী সময় বা আয়ু থাকে। সরকারের বিস্ফোরক অধিদপ্তরের বক্তব্য অনুযায়ী, প্রতিটি গ্যাস সিলিন্ডারের আয়ু ১০ থেকে ১৫ বছর হয়ে থাকে। এই সময়েরে পরে সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঝুঁকি সৃষ্টি হয়।

তাই আয়ু শেষ হলে সেগুলো বাতিল করার কথা থাকলেও গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী ২৫ বছরের পুরানো সিলিন্ডারও যানবাহনে ব্যবহৃত হচ্ছে। এসব সিলিন্ডার শক্তিশালী বোমা হয়ে অসংখ্য যানবাহনের চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করছে এবং প্রতিনিয়ত লাখ লাখ মানুষ এই বোমায় চড়ে এখান থেকে ওখানে যাচ্ছেন। এই শক্তিশালী বোমাগুলোই বাসা বাড়িতে, হোটেল রেস্তোরাঁয় কোটি মানুষের রান্নার কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। অথচ এক মুহূর্তের বিস্ফোরণে অগণিত মানুষের প্রাণ উড়ে যাচ্ছে।

পুরান ঢাকার চকবাজারের ভয়াবহ আগুনে হতাহতের পরেও কেমিক্যালের গোডাউনের পাশাপাশি এই গ্যাস সিলিন্ডার নিয়েও নানা ফোরামে আলোচনা শুরু হয়। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) তৎকালীন কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া ঘটনার ভিডিও বিশ্লেষণ করে তখন বলছিলেন, তার কাছেও মনে হয়েছে চকবাজারের চুরিহাট্টায় পিকআপের ওপরে যে গ্যাস সিলিন্ডারগুলো ছিল, বিস্ফোরণটা প্রথমে ওখানেই হয়েছে। সেখান থেকে রেস্টুরেন্টে গিয়েছে। তারপর সরাসরি ওয়াহিদ ম্যানশনের দ্বিতীয় তলার বডি স্প্রের গোডাউনে ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে দাহ্য পদার্থ ছিল। এর কারণে আগুনের ভয়াবহতা বেড়ে যায়।

এই ঘটনার পরে যানবাহন ও বাসাবাড়িতে ব্যবহৃত গ্যাস সিলিন্ডারের ঝুঁকিও সামনে চলে আসে। এরকমও বলা হয় যে, ঢাকা শহরে যে বিপুল পরিমাণ যানবাহনে সিএনজিতে চলে, তার অধিকাংশই রিটেস্ট বা নিয়মিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয় না। অনেকগুলোই মেয়াদোত্তীর্ণ।

ফলে ট্রাফিক জ্যামের ভেতরে যখন শত শত যানবাহন অপেক্ষা করে, তখন এর কোনো সিলিন্ডারে বিস্ফোরণ হলে সেটি মুহূর্তে অসংখ্য গাড়িতে ছড়িয়ে পড়বে এবং একসাথে বহু লোকের প্রাণহানি ঘটবে; যা আকাশ থেকে কোনো বোমারু বিমান থেকে ফেলা বোমায় হতাহতের চেয়ে সেটা কম হবে না।

মূলত দেশে প্রাকৃতিক গ্যাস এখনও সহজলভ্য হওয়ায় সবচেয়ে বেশি সুবিধাভোগী ঢাকার নাগরিকরা। তারা যে দামে মাসব্যাপী অফুরন্ত গ্যাস পায় এবং এই প্রাকৃতিক সম্পদের যেভাবে যথেচ্ছ ব্যবহার করে, সেটি অবিশ্বাস্য। সমস্যা হলো, বাসাবাড়ি ও কলকারখানায় এই গ্যাস সরবরাহের জন্য পাইপ লাইন নেয়া হয়েছে মাটির তলদেশ থেকে। সেই একই জায়গায় ওয়াসার পানির লাইন, একই জায়গায় টিএন্ডটির টেলিফোন লাইন। ফলে কিছুদিন পর পরই এসব রাষ্ট্রীয় সংস্থা তাদের বিবিধ উন্নয়ন কাজের জন্য খোঁড়াখুঁড়ি চালাতে থাকে।

ফলে কখন কোথাও গ্যাস লাইনে লিক হচ্ছে তা বোঝাও মুশকিল। বিশেষজ্ঞরা অনেক দিন ধরেই এরকম আশঙ্কা করছেন যে, ঢাকার মধুপুর ফল্টে যদি ৫ বা ৬ মাত্রার ভূমিকম্পও হয়, তাহলে ঢাকা শহরে ‘গজব’ নেমে আসবে। ভবনধসে যত না মানুষ মারা যাবে, তার চেয়ে বেশি মানুষের মৃত্যু হবে আগুনে পুড়ে। কারণ ত্রুটিপূর্ণ গ্যাস লাইনের কোথাও একটু আগুনের স্পর্শ পেলে পুরো শহর আগুনের কুণ্ডে পরিণত হবে।

অপরিকল্পিত, অবিবেচনাপ্রসূত এবং সমন্বয়হীন রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন কর্মকাণ্ড এবং নিয়ম মেনে ভবন তৈরি না করাও ঢাকা শহরকে অ্যাটম বোমায় পরিণত করেছে। কিন্তু এই অনিয়মের জঞ্জাল একদিনে তৈরি হয়নি। ফলে মাঝেমধ্যে নিমতলী, চকবাজার কিংবা মগবাজার আমাদের কষে চপেটাঘাত করে গেলেও, কিছুদিন পরে সেই চড়ের কথা আমরা ভুলে যাই এবং যথারীতি আরেকটি ঘটনার জন্য অপেক্ষা করি।

এই অপেক্ষা করা ছাড়া নাগরিকের কিছু করার থাকে না। কারণ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এসব ঘটনার জন্য যারা দায়ী, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের কিছুই হয় না। বিশেষ করে সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের জবাবদিহির আওতায় আনা বা বড় কোনো দুর্ঘটনার জন্য তাদের দায়ী করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হয় না। তার বড় কারণ এসব ঘটনায় যে তাদের দায় আছে, অধিকাংশ সময় সে বিষয়টিই তদন্তে উঠে আসে না। সাধারণত এসব তদন্ত সরকারি কর্মকর্তারাই করেন। নারায়ণগঞ্জের মসজিদে বিস্ফোরণের ঘটনায় তিতাসের কয়েকজন মাঠপর্যায়ের প্রকৌশলী ও কর্মী বরখাস্ত হলেও বড় কোনো কর্তার শাস্তি হয়নি।

প্রশ্ন হলো, যদি রাষ্ট্রীয় কোনো প্রতিষ্ঠানের গাফিলতির কারণে এরকম হতাহতের ঘটনা ঘটে, সেখানে রাষ্ট্র কি তার দায় এড়াতে পারে? এরকম ঘটনায় আজ পর্যন্ত কোনো সরকারের তরফে কি এই ঘটনার জন্য নিজেদের ব্যর্থতা স্বীকার করা হয়েছে না কি যে যার জায়গা থেকে শুধু অপরকেই দোষারোপ করছে?

প্রতিটি দুর্ঘটনার পরে প্রথমেই একটি তদন্ত কমিটি হয়। কখনও মামলাও হয়। কিন্তু অনেক সময়ই তদন্ত রিপোর্ট আলোর মুখ দেখে না। আবার তদন্ত রিপোর্টে এ জাতীয় ঘটনা প্রতিরোধে অনেক সুপারিশ থাকলেও সেগুলো বাস্তবায়িত হয় না। কারণ সেসব সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে গেলে অনেক বড় সিদ্ধান্ত নিতে হয়। সেসব সিদ্ধান্তে আবার রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী নাগরিকদের একটি অংশের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার শঙ্কা থাকে। ফলে প্রভাবশালীদের চাপে সেসব সুপারিশ ফাইলেই বন্দি থাকে।

আবার মামলা হলেও বিচার শেষ হয় না। পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টায় বিস্ফোরণে ৮০ জন এবং তার আগে নিমতলীতে ১২৪ জনের প্রাণহানি হলেও সেসব ঘটনায় বিচার শেষ হয়নি। চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় দায়ের করা মামলার তদন্তও এগোচ্ছে না। তদন্ত প্রতিবেদনের জন্য দফায় দফায় তারিখ দিয়ে যাচ্ছেন আদালত।

পুরান ঢাকায় একাধিকবার কেমিক্যালের গোডাউনে বিস্ফোরণে অনেক মানুষ নিহত হলেও এসব ঘটনায় দায়ীদের বিরুদ্ধে সরাসরি হত্যামামলা দায়ের করা হয়নি। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, নিমতলীর ঘটনায় কোনো মামলাই হয়নি। বরং বংশাল থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) হয়েছিল। সেটিরও তদন্ত হয়নি। এত বড় একটি ঘটনা, যেখানে ১২৪ জন মানুষের প্রাণহানি হলো, সেই ঘটনায় কেন হত্যামামলা হলো না— সেটিরই বরং বিচারবিভাগীয় তদন্ত হওয়া দরকার।

সুতরাং, মগবাজারের পুরনো একটি ভবনে ভয়াবহ বিস্ফোরণে যে বেশ কয়েকজন মানুষের প্রাণ গেল, সেই ঘটনায়ও দায়ীদের চিহ্নিত করে তাদের কঠিন শাস্তির মুখোমুখি করা যাবে কি না— সেটি একটি বিরাট প্রশ্ন। কারণ দায়ী করতে গেলে অনেকগুলো প্রশ্ন সামনে চলে আসবে এবং যেসব প্রশ্নের সরাসরি উত্তর দিতে হবে আসলে রাষ্ট্রকেই। কিন্তু রাষ্ট্রকে জবাবদিহির আওতায় আনবে কে? তার চেয়ে বরং এই অ্যাটম বোমার শহরে যতদিন বেঁচে থাকা যায়—সেটিই সৌভাগ্য।

লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।

এ বিভাগের আরো খবর