সম্প্রসারিত দ্বিতীয় ঢেউ বলুন আর তৃতীয় ঢেউ; এই ঢেউ যে আসবে এটা সবাই জানতেন। কারণ এটা বিজ্ঞান। করোনার ঢেউ কোথায় কখন বাড়বে, দুয়ে দুয়ে চার মেলালে, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা সেটা বলে দিতে পারবেন। অবশ্য বাংলাদেশে এখন করোনা বিশেষজ্ঞের কমতি নেই। এই হঠাৎ গজিয়ে ওঠা বিশেষজ্ঞরাও জানতেন বিপদ আবার আসছে। কী হলে এই ঢেউ কিছুটা কমিয়ে রাখা যাবে, সেটাও কারো অজানা নয়। কিন্তু কোনো চেষ্টাই কাজে আসেনি। তৃতীয় ঢেউ এখন আমাদের ভাসিয়ে নিতে ঘরের দরজায়। সংক্রমণের হার এবং মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে হু হু করে।
এ নিবন্ধ লেখা পর্যন্ত (রোববার) ১১৯ জনের মৃত্যুর খবর গেল। এটা চলতি বছরের সর্বোচ্চ সংখ্যক মৃত্যু। গত দেড়বছরে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ছিল ১১২ জন। মারা গিয়েছিলেন ১৯ এপ্রিল। পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে, নতুন বেদনার রেকর্ডের জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। এতদিন বলা হতো, করোনা শহুরে রোগ। মূল সংক্রমণ ছিল ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ আর চট্টগ্রামে। এবার করোনার ঢেউ ভাসিয়ে নিতে চলেছে গোটা বাংলাদেশকে। কোভিড-১৯ সম্পর্কিত জাতীয় পরামর্শক কমিটি বলছে, দেশের ৫০ জেলায়ই করোনার উচ্চ সংক্রমণের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।
করোনা যে সহজে যাচ্ছে না, এটা সবাই বুঝে গেছে। এখন জীবন সাজাতে হবে করোনার মতো করে, মানে নিউ নরমাল লাইফ। সহজে যাচ্ছে না, এটা যেমন ঠিক; আবার কী হলে করোনার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে, সেটাও সবাই জানে। কিন্তু উন্নত দেশগুলো যেমন পারেনি, আমরাও পারিনি। পারাটা কিন্তু খুব কঠিন নয়। আমরা যদি আমাদের আগের আয়েশি জীবনটা ভুলে গিয়ে নিউ নরমাল লাইফে অভ্যস্ত হতে পারি, করোনাকে অত ভয়ংকর মনে হবে না।
এখন পর্যন্ত করোনার কোনো সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা আবিষ্কার হয়নি। ডাক্তাররা নানা লক্ষণ দেখে চিকিৎসা দেন। করোনা থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় হয়ে এসেছে টিকা। যদিও টিকা দেয়ার পরও করোনা হতে পারে, এমনকি মৃত্যুও হতে পারে; তবুও দুই ডোজ টিকা ঝুঁকি কমিয়ে আনতে পারে অনেকটাই। সরকার নানা চেষ্টা করছে। কিন্তু ১৮ কোটি মানুষের দেশকে টিকা দিয়ে সুরক্ষিত রাখা সত্যিই কঠিন। করোনা থেকে দূরে থাকার আরেকটি সহজ উপায় আছে- মাস্ক।
আপনাদের মনে হতে পারে, এত কোটি কোটি টাকার টিকা রেখে আমি মাস্কের কথা বলছি কেন? করোনা মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায়। আর করোনা আপনার শরীরে ঢুকতে পারবে আপনার মুখ, নাক, চোখ দিয়ে। তাই আপনি যদি আপনার এই তিনটি অঙ্গ ঢেকে রাখতে পারেন, তাহলেই আপনি নিরাপদ। করোনার স্বাস্থ্যবিধি কিন্তু কঠিন নয়। মাস্কে নিজেকে ঢেকে রাখা, জনসমাগম থেকে দূরে থাকা এবং নিজেকে পরিচ্ছন্ন রাখা। এটুকু মানতেই আমাদের যত কষ্ট, হাজারটা অজুহাত। আপনি স্বাস্থ্যবিধি মানলে কিন্তু সরকারের কোনো লাভ নেই, আপনারই লাভ শুধু।
আমাদের প্রথম চেষ্টা হলো, করোনা থেকে দূরে থাকা। দ্বিতীয় চেষ্টা হলো, আক্রান্ত হলেও যেন যথাযথ চিকিৎসা পাওয়া যায়। আগের দুটি ঢেউ থেকে শিক্ষা নিয়ে সরকার যেন হাসপাতালগুলো তৈরি রাখে। আগের দুই ঢেউয়ের অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের শিক্ষা হলো, সময়মতো আইসিইউ পাওয়া যায় না, অনেক সময় আসনই পাওয়া যায় না।
অ্যাম্বুলেন্সে এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতাল ঘুরতে ঘুরতে অনেকে মারা যান। এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি যেন না ঘটে। অনেকে করোনা আক্রান্ত হলেই হাসপাতালে ছুটে যান। তাতে যাদের সত্যিকার হাসপাতালের আসন দরকার তারা পান না। আবার অনেকে কিছুতেই হাসপাতালে যেতে চান না।
যখন বাধ্য হয়ে যান, তখন অনেক দেরি হয়ে যায়। তাই ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করে, ঠিক যখন দরকার, তখনই যেন রোগীরা হাসপাতাল পান, তা নিশ্চিত করতে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে।
জনগণকে স্বাস্থ্যবিধি মানাতে সরকারের কিন্তু চেষ্টার কোনো কমতি নেই। গতবছর প্রথম সাধারণ ছুটি দিয়ে শুরু। ৬৬ দিনের সাধারণ ছুটিতে সংক্রমণ অনেকটাই কমে এসেছিল। গত এপ্রিলে দ্বিতীয় ঢেউ আসার পর সরকার বিধিনিষেধ, কঠোর বিধিনিষেধ ইত্যাদি দিয়ে চেষ্টা করেছে।
সারা দেশের পাশাপাশি সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে আঞ্চলিক লকডাউনও হয়েছে। কিন্তু এই লকডাউন নিয়েই সরকার রীতিমতো তামাশা শুরু করেছে। সরকারের অবস্থা হয়েছে ‘কাজীর গরু কেতাবে আছে, গোয়ালে নেই’-এর মতো। সরকার নিজের সিদ্ধান্তে স্থির থাকতে পারছে না। যা-ই শুরু করে, এরপর নানামুখী চাপে তা থেকে সরে আসে।
বুধবার পরামর্শ কমিটির সুপারিশের পর শুক্রবার সরকার জানাল, সোমবার থেকে ‘কঠোর লকডাউন’। সরকারের সিদ্ধান্ত শুনে শনিবারই মানুষ বাড়ি ফেরার জন্য পাগল হয়ে গেল, বাজারে উপচে পড়া ভিড়।
শনিবার সন্ধ্যায় জানাল- সোমবার নয়, কঠোর লকডাউন শুরু হবে বৃহস্পতিবার থেকে। সরকার যখন সিদ্ধান্ত বদলাল, মানুষ কিন্তু তখন রাস্তায়। শুক্রবার কঠোর লকডাউনের সিদ্ধান্ত ঘোষণার সময়ই সরকারের জানা উচিত ছিল, অর্থবছরের শেষ সময়ে লকডাউন দেয়া সম্ভব নয়। আগেও আমরা দেখেছি, সরকার লকডাউন দিয়ে তারপর নানামুখী চাপে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিত পরিসরে গার্মেন্টস, শপিং মল, যানবাহন খুলে দেয়।
করোনা ঠেকাতে যেটা দরকার, সেটাই কঠোরভাবে করতে হবে। সরকার তার সিদ্ধান্ত নেবে। প্রয়োজনে সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে কথা বলে নিতে হবে। কিন্তু একবার সিদ্ধান্ত নেয়ার পর বার বার তা থেকে সরে আসলে তাতে সরকারের অস্থিরতারই প্রমাণ মেলে। তাতে মানুষ আর সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর আস্থা রাখতে পারে না।
সেই ‘বাঘ আসার’ গল্পের মতো সত্যিকারের লকডাউনকে তামাশা মনে করে সবাই। তবে সরকারকে পুরো দোষ দেয়া যাবে না। সরকার যা-ই করে আমরা করি তার উল্টোটা। এই খামখেয়ালির ফাঁক গলে করোনা ছড়িয়ে যায় সারা দেশে।
সাধারণ ছুটি, বিধিনিষেধ, কঠোর বিধিনিষেধ, লকডাউন, কঠোর লকডাউন, শাটডাউন- যা-ই হোক; সাফল্য নির্ভর করে সরকারের আন্তরিক চেষ্টার ওপর। বার বার আমরা দেখেছি, জীবন-জীবিকার সমন্বয়, অর্থনীতিকে বাঁচানোর কথা বলে সরকার কিছু না কিছু ছাড় দিয়েছে। নানা মহলের দাবি মানতে মানতে সরকার একসময় ছাড় দিতেই থাকে। তাতে ‘বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরো’র মতো অবস্থা হয়।
বার বার লম্বা সময়ের জন্য কাগুজে কঠোর লকডাউন দেয়ার চেয়ে অল্প সময়ের জন্য সত্যিকারের লকডাউন অনেক বেশি কার্যকর। তবে নিম্নবিত্তের মানুষের জীবিকার বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে। জীবন সবচেয়ে মূল্যবান সন্দেহ নেই, কিন্তু করোনা থেকে বাঁচতে গিয়ে ক্ষুধার খপ্পড়ে যেন কেউ না পরে, এই বিষয়টিও সরকারকে মাথায় রাখতে হবে।
লকডাউন, কঠোর লকডাউন, শাটডাউন- শব্দ যা-ই হোক; আমাদের সবার একটাই চেষ্টা করোনাকে ডাউন করা। তবে জনগণ যদি আন্তরিক সহায়তা না করে, তাহলে কোনো কিছু করেই লাভ হবে না। করোনাকে ডাউন করতে হলে কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি পালন করতে হবে। নইলে লাশ গোনা আর কান্নাকাটি করা ছাড়া আর কিছু করার থাকবে না।
লেখক: সাংবাদিক, কলাম লেখক