ডিজিটাল বাংলাদেশ- এই ব্যাপারটি গত দশকে দেশে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় ছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিানার নেতৃত্বে ২০০৮ সালে সরকার দেশ পরিচালনার শুরু থেকে ২০২১ সালের মধ্যে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে ব্যাপক পরিসরে কাজ শুরু করে। ইউএনডপিরি সাহায্যপুষ্ট ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, তথ্য ও প্রযুক্তি বিভাগ ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এটুআই প্রোগ্রামের মাধ্যমে নাগরিক সেবা প্রদানে উদ্ভাবনীর কাজ শুরু হয়।
সরকার প্রদত্ত নাগরিক সেবা প্রাপ্তিতে জনগণের ভোগান্তি কমাতে প্রতিটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ সেবাসমূহকে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে প্রদানের পাশাপাশি সেবা সহজীকরণে নিত্যনতুন উদ্ভাবনী শুরু করে।
ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার ও উদ্ভাবনীর মাধ্যমে শহর থেকে প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত নাগরিক সেবা প্রদানে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি নিশ্চিত করে সুশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ২০২১ সালের মধ্যে ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনের লক্ষ্যে সরকার কাজ করছে। তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার ও উদ্ভাবনীর মধ্য দিয়ে দেশ ২০৪১ সালের মধ্যে ‘ইনোভেটিভ বাংলাদেশ’ নামে বিশ্বব্র্যান্ডে প্রতিষ্ঠিত হবে।
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সরকার সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় প্রায় ১ কোটি লোককে বিভিন্ন প্রকার ভাতা ও অনুদান প্রদান করে থাকে। ভাতাগ্রহীতার নাম অন্তর্ভুক্তিকরণ, যাচাই ও ভাতা বিতরণ কার্যক্রম নিয়ে নানা ধরনের ভোগান্তির কথা প্রচলিত ছিল।
সব ধরনের ভাতাকে জিটুপির (গভর্নমেন্ট টু পিপল) আওতায় সরাসরি সুবিধাভোগীদের হাতে পৌঁছে দিতে চলতি অর্থবছরের জুনের মধ্যে শতভাগ ভাতা মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রদানের কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। এটুআইয়ের সহযোগতিায় ২০১৮ সালে সব ভাতাভোগীর ডিজিটাল তথ্যভাণ্ডার তৈরির পাইলটিং শুরু হয়।
২০১৮ সালে বিশ্বব্যবাংকের সহযোগিতায় সমাজসেবা অধিদপ্তরের মাধ্যমে ক্যাশ ট্রান্সফার মডার্নাইজেশন (সিটিএম) প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু হয়। যার মাধ্যমে ৪৯ লাখ বয়স্ক, ২০ লাখ ৫০ হাজার বিধবা ও স্বামী পরিত্যক্ত মহিলা, ১৮ লাখ প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ও ১ লাখ প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী উপবৃত্তিসহ মোট ৮৮ লাখ ৫০ হাজার ভাতাভোগীর তথ্য ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমে (এমআইএস) অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সব ভাতাভোগীর মোবাইলে হিসাব খোলা হয়েছে। যার ফলে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের ভাতাভোগীরাও এখন বিনা বিড়ম্বনায় ঘরে বসে মোবাইলের মাধমে প্রতি মাসে ভাতা পেয়ে যাবেন। সরকারের সেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে এটি একটি মাইলফলক অর্জন।
ভাতা কার্যক্রমের পাশাপাশি মন্ত্রণালয় ও আওতাধীন দপ্তর সংস্থাসমূহের প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনা ও অন্যান্য সেবা কার্যক্রমেও এসেছে ডিজিটাল প্রযুক্তির ছোঁয়া। সব মন্ত্রণালয়ের সেবাসমূহকে একটি সিঙ্গেল ইন্টিগ্রেটেড ডিজিটাল সার্ভিস প্ল্যাটফর্মের আওতায় আনার জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, আইসিটি বিভাগ ও এটুআইয়ের সমন্বয়ে প্রণীত রোডম্যাপ অনুযায়ী সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ও আওতাধীন দপ্তর বা সংস্থার আটটি ডিজিটাল সার্ভিসের ডিজাইন করা হয়েছে।
অনুদান, ফেলোশিপ, বৃত্তি, শিক্ষা উপবৃত্তি, ইন্টার্নশিপ ব্যবস্থাপনা; হাসপাতাল এবং প্রতিবন্ধী সেবা ব্যবস্থাপনা সিস্টেম; উৎপাদন, ব্র্যান্ডিং এবং বাজারজাতকরণ ব্যবস্থাপনা; সচেতনতা তৈরি ও সহায়ক যন্ত্র ব্যবস্থাপনা; ট্রেনিং ও আবাসন ব্যবস্থাপনা; প্রতিবন্ধী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষা ব্যবস্থাপনা; শিশু ব্যবস্থাপনা সিস্টেম এবং সামাজিক নিরাপত্তা ডেলিভারি অ্যাপে আটটি ডিজিটাল সার্ভিসের মাধ্যমে সমাজসেবা অধিদপ্তর, জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন, নিউরো ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্ট, বাংলাদেশ জাতীয় সমাজকল্যাণ পরিষদ ও শারীরিক প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্টের সেবাসমূহ একটি সুইচের মাধ্যমে প্রদান করা হবে।
বর্তমানে এ আটটি সেবাকে ডিজিটালাইজড করার কাজ চলমান রয়েছে। এই ইন্টিগ্রেটেড ডিজিটাল সার্ভিস ডেলিভারি প্ল্যাটফর্ম বাস্তবায়িত হলে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং আওতাধীন দপ্তর বা সংস্থার সেবাসমূহের শতকরা ৮৫ ভাগ ডিজিটাল হবে এবং সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় সেবাগ্রহীতারা বিনা ভোগান্তিতে সব ধরনের সেবা পাবেন।
বার্ষিক উদ্ভাবনী কর্মপরিকল্পনার আওতায় সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রমকে ডিজিটাল করতে অর্থায়ন ব্যবস্থাপনা সিস্টেম সফটওয়্যার, অনলাইন অ্যাপ্লিকেশন সিস্টেম ফর ডিসঅ্যাবিলিটি স্কুল অ্যাপ্রোভাল সফটওয়্যার, থেরাপি সার্ভিস ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম সফটওয়্যার, অনলাইন ট্রেইনিং ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম ফর সোশ্যাল সার্ভিস অ্যাকাডেমি সফটওয়্যার ও ই-বুলেটিন চালু করা হয়েছে। এ সফটওয়্যারসমূহের মাধ্যমে সেবাপ্রত্যাশীদের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি প্রশাসনিক কার্যক্রমেও স্বচ্ছতা ও গতিশীলতা এসেছে।
সফটওয়্যারের পাশাপাশি দুস্থ, অসহায়, দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত জনগোষ্ঠীর জন্য আর্থিক সাহায্য ও চিকিৎসা অনুদান প্রদানের কার্যক্রমও অনলাইনে চালু করা হয়েছে। ক্যানসার, কিডনি, লিভারসিরোসিস, স্ট্রোকে প্যারালাইজড, জন্মগত হৃদরোগ ও থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের আর্থিক সহায়তা কর্মসূচি সহজীকরণে অনলাইনে আবেদন গ্রহণ করা হচ্ছে। এর ফলে প্রায় পাঁচ লাখ সেবাপ্রত্যাশী উপকৃত হচ্ছেন।
তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হচ্ছে প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠী। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় প্রতিবন্ধী শনাক্তকরণ জরিপ কর্মসূচির মাধ্যমে দেশের সব প্রতিবন্ধীর ডিজিটাল ডাটাবেজ তৈরি করেছে এবং এ কাজ চলমান রয়েছে। এ তথ্যভাণ্ডার ব্যবহার করে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ও শিক্ষার্থীদের ভাতা-শিক্ষা উপবৃত্তি প্রদানের পাশাপাশি তাদের কর্মসংস্থানের সুযোগও সৃষ্টি হচ্ছে।
দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী এবং নিরক্ষরদের জন্য প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে ১০৯টি পাঠ্যবইয়ের ডিজিটাল টকিং বুক চালু করা হয়েছে। ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদর জন্য ডিজিটাল শিক্ষা-উপকরণ তৈরি ও বিতরণ করা হচ্ছে। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের চলাচল নিরাপদ করার জন্য বিভিন্ন আধুনিক সুবিধাসংবলিত ডিজিটাল স্মার্ট হোয়াইট ক্যান বিতরণ করা হচ্ছে।
করোনা মহামারির কারণে দেশের অর্থনীতিতে যে বিরূপ প্রভাব পড়েছে এর সরাসরি শিকার অসহায় জনগোষ্ঠী। সরকার ২০২১-২২ অর্থবছরে বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ বাড়িয়েছে। সুবিধাবঞ্চিতদের কাছে সরাসরি সেবা পৌঁছে দিতে ডিজিটাল প্রযুক্তির বিকল্প নেই। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ ও এটুআইয়ের সহযোগিতায় শতভাগ সেবা কার্যক্রম ডিজিটাল করার জন্য কাজ করছে।
চলতি অর্থবছরের মধ্যে শতভাগ ভাতাভোগী মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ভাতা পাবেন। সরকারের পাশাপাশি উন্নয়ন সহযোগী, এনজিও, বেসরকারি উদ্যোক্তা ও সচেতন মহলের সম্মিলিত প্রয়াস ডিজিটাল বাংলাদেশের সুবিধা সবার কাছে পৌঁছে দিতে ভূমিকা রাখতে পারে।
লেখক: সরকারি কর্মকর্তা, কলাম লেখক