‘আমি ঘর পেয়ে খুবই খুশি। আগে ছিলাম রাস্তার ভিখারি। এখন আমি লাখপতি। বঙ্গবন্ধুকন্যার জন্যই এটা পেয়েছি। ভগবান তাকে দীর্ঘজীবী করুন। স্বর্গ থেকে বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা আজ এই খুশির মুহূর্তটি দেখছেন, তাদের আত্মা শান্তিতে ভরে উঠছে। আমি আপনার (প্রধানমন্ত্রী) জন্য এখনও একটি করে দুই টাকার বাতি জ্বালাই।’
কথাগুলো বলছিলেন মুজিববর্ষে বাড়ি পেয়ে সিলেট জেলার উপকারভোগী বীরাঙ্গনা শীলা গুহ। বাড়ি পেয়ে আবেগে আপ্লুত হয়ে যে কথাটি বলেছিলেন তা শুধু তার ব্যক্তিগত কথা নয়, সেকথা উপকারভোগী লাখ লাখ মানুষের কথা। গত ২০ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে দ্বিতীয় পর্যায়ে ভূমি ও গৃহহীনদের মাঝে বাড়ি বিতরণ করেন। তখন বীরাঙ্গনা শীলা গুহের বক্তব্যে তিনি নিজেও চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি।
দেশের এই লাখ লাখ শীলা গুহকেই তিনি নিজের পরিবার, অতি আপনজন মনে করেন। এমন ভূরি ভূরি উদাহরণ আছে। তাদের মতো কোটি কোটি নিঃস্বার্থ মানুষের ভালোবাসাই বঙ্গবন্ধুকন্যার কাজের শক্তি।
চলমান মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে বাংলাদেশের প্রতিটি গৃহহীন পরিবারকে বাড়ি করে দেবেন অঙ্গীকার করেছেন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনা। একটি পরিবারও যেন গৃহহীন না থাকে সে লক্ষ্য নিয়েই তিনি নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন।
এ বছরের ২৩ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথমপর্যায়ে ৬৯ হাজার ৯০৪টি ও দ্বিতীয়পর্যায়ে ২০ জুন ৫৩ হাজার ৩৪০ পরিবারকে মালিকানা স্বত্বসহ বাড়ি প্রদান করেন। একসঙ্গে এত মানুষকে জমির মালিকানা দিয়ে পাকা বাড়ি করে দেয়া পৃথিবীর ইতিহাসে এটিই প্রথম এবং একমাত্র ঘটনা।
বিভিন্ন দেশে ভূমিহীন, গৃহহীনদের ঘর-বাড়ি নির্মাণের জন্য সুদবিহীন ঋণ দেয়ার নজির থাকলেও এভাবে লাখ লাখ পরিবারকে পুনর্বাসন সত্যিই বিরল। প্রতিটি পরিবারের স্বামী-স্ত্রীর যৌথ নামে ভূমির মালিকানার দলিল, রেজিস্ট্রি ও নামজারি করে দেয়া হচ্ছে যাতে করে তারা এই সম্পদের স্থায়ী মালিক হতে পারেন। শুধু বাড়ি করে দিয়েই বঙ্গবন্ধুকন্যা দায়িত্ব শেষ করেননি। প্রতিটি পরিবার যাতে সব ধরনের নাগরিকসুবিধা পায় সে ব্যবস্থাও নিশ্চিত করেছেন।
শিক্ষা-স্বাস্থ্য, সুপেয় পানি, উপাসনালয়, কমিউনিটি সেন্টার নির্মাণ, কবরস্থান, পুকুর ও গবাদিপশু প্রতিপালনের জন্যও ব্যবস্থা করা হয়েছে। কারিগরি প্রশিক্ষণ দান এবং প্রশিক্ষণ শেষে তাদের মধ্যে ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণ করা, যাতে করে তারা নিজেরাই উপার্জন করে চলতে পারে। তাহলেই অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। দারিদ্র্য বিমোচন ও বেকার সমস্যার সমাধান হবে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু সারা জীবন এদেশের অসহায়, সম্বলহীন ও অধিকারবঞ্চিত মানুষের জন্য কাজ করেছেন। গৃহহীনদের পুনর্বাসনের কাজটিও শুরু করেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের সরকারপ্রধান হিসেবে ১৯৭২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি নোয়াখালী জেলার (বর্তমান লক্ষ্মীপুর) চরপোরাগাছা গ্রাম পরিদর্শনকালে ভূমিহীন, গৃহহীন ও অসহায় লোকদের দুর্দশা দেখে তাদেরকে পুনর্বাসনের জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুকন্যা পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে বৃহৎ পরিসরে গৃহহীন প্রতিটি পরিবারকে বাড়ি দিয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন পূরণের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন।
১৯৯৭ সালের ১৯ মে কক্সবাজারসহ পার্শ্ববর্তী এলাকাসমূহ ঘূর্ণিঝড়ে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গৃহহীন হয়ে পড়ে বহু পরিবার। তৎকালীন ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরের দিন এলাকা পরিদর্শনে গিয়ে বাস্তুহারা মানুষের দুঃখ-দুর্দশা দেখে সব গৃহহীন পরিবারকে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন। নির্দেশনা মোতাবেক ১৯৯৭ সালেই ‘আশ্রয়ণ প্রকল্প’ নামে একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। যা সম্পূর্ণ বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে পরিচালিত।
প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল, ভূমিহীন, গৃহহীন, ছিন্নমূল অসহায় দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসন, ঋণপ্রদান ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে জীবিকানির্বাহে সক্ষম করে তোলা এবং আয়বর্ধক কার্যক্রম সৃষ্টির মাধ্যমে দারিদ্র্যকে দূর করা। এই প্রকল্পের আওতায় (১৯৯৭-২০০১) সাল থেকে (২০১০-২০২০) সালের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত তিন লাখ ২০ হাজার ৫২টি ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। কিন্তু অত্যন্ত লজ্জাজনক বিষয় যে, ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় প্রকল্পটি বন্ধ করে দেয়া হয়। আওয়ামী নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রকল্পটি পুনরায় চালু হয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে ৬৪টি জেলার প্রতিটি উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়নের অসহায় সম্বলহীন পরিবারকে আশ্রয় দেয়ার জন্য বাড়ি নির্মাণের উদ্যোগ নেন। সেই লক্ষ্যে আশ্রয়ণ প্রকল্পের অধীনে ২০২০ সালে ৮ লাখ ৮৫ হাজার ৬২২টি পরিবারের তালিকা তৈরি করেন। তাদের মধ্যে ২ লাখ ৯৩ হাজার ৩৬১টি ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবার এবং ৫ লাখ ৯২ হাজার ২৬১টি পরিবারের ১-১০ শতাংশ ভূমি রয়েছে। তবে তাদের বসবাসের বাড়ি নেই। এই দুই শ্রেণির পরিবারকে সেবা প্রদানের জন্য তালিকা প্রস্তুত করা হয়।
সরকার তিনটি কর্মসূচির আওতায় দেশের ভূমিহীন, গৃহহীন মানুষদেরকে বাড়ি তৈরি করে দিচ্ছে। এসব কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের আওতায় দুর্যোগ সহনীয় বাড়ি প্রকল্প, ভূমি মন্ত্রণালয়ের আওতায় গুচ্ছগ্রাম প্রকল্প ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আশ্রয়ণ প্রকল্প-২। এর বাইরে ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্প যার নতুন নাম করা হয়েছে ‘আমার বাড়ি আমার খামার’। শহরে বা শহরের কাছাকাছি সুবিধামতো জায়গায় যেখানে খাসজমি নেই, সেখানে বহুতল ভবন করে ফ্ল্যাটের মাধ্যমে পরিবারগুলোকে পুনর্বাসন করা।
অন্যদিকে শহরের বাইরের ভূমিহীন পরিবারকে ২ শতাংশ জায়গার ওপর দুটি শোবার ঘর, একটি বারান্দা, একটি রান্নাঘর ও একটি বাথরুম-সংবলিত ঘর করে করে দেয়া আর যাদের জায়গা আছে, ঘর নেই তাদেরকেও একই ধরনের ঘরের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এছাড়া যারা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উদ্বাস্তু তাদের জন্য কক্সবাজারেরর খুরুশকুলে ৬০০ পরিবারের জন্য ২০টি পাঁচতলা ভবন নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ ডিটেইল্ড প্রজেক্ট প্রপোজালের (ডিপিপি) মাধ্যমে আরও ১১৯টা বহুতল ভবনের কাজ চলমান রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখনই ক্ষমতায় এসেছেন তখনই সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষদেরকে সমাজের মূলস্রোতে নিয়ে আসার জন্য নিয়েছেন বহুমুখী পদক্ষেপ। তারই আন্তরিক উদ্যোগে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ১৯৯৭-৯৮ অর্থবছরে দেশে প্রথমবারের মতো বয়স্কভাতা এবং ১৯৯৮-৯৯ অর্থবছরে বিধবা, স্বামী পরিত্যক্তা মহিলাভাতা, মুক্তিযোদ্ধা সম্মানীসহ নানা ধরনের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি চালু করে।
পরবর্তী সময়ে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্র, প্রতিবন্ধী শিক্ষা, উপবৃত্তি, হিজড়া, বেদে ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন, চা-শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়ন, ক্যনসার, কিডনি, লিভার সিরোসিস, জন্মগত হৃদরোগ, স্ট্রোক ও থ্যালাসেমিয়া রোগীদের আর্থিক সহায়তা, প্রতিবন্ধী মোবাইল থেরাপিভ্যান চালুসহ নানাবিধ সামাজিক নিরাপত্তার ১২৩টি কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। ৩০টি মন্ত্রণালয় এসব কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে।
প্রতিবছর বাজেটে এ খাতসমূহে বরাদ্দ বৃদ্ধি পাচ্ছে। চলতি বছরের বাজেটে ১ লাখ ৭ হাজার ৬১৪ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। যা মোট বাজেটের ১৭ দশমিক ৮৩ শতাংশ এবং জিডিপির ৩ দশমিক ১১ শতাংশ।
এ ছাড়াও মিয়ানমারে যখন লাখ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বাস্তুহারা ও দেশছাড়া হয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হচ্ছিল তখন প্রধানমন্ত্রী সীমান্ত খুলে দিয়ে ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। এই কারণেই বিশ্ব দরবারে ‘মাদার অব হিউম্যানিটি’ উপাধিতে ভূষিত হন শেখ হাসিনা। ভাসানচরে মনোরম পরিবেশ ও সব সুযোগ-সুবিধাসহ সেই সব রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা পিতার মতোই দেশ ও দেশের মানুষকে ভালোবাসেন। তিনি একটি ভিশন নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। জাতির পিতার সোনার বাংলা গড়াই একমাত্র লক্ষ্য। যেখানে একটি মানুষও না খেয়ে থাকবে না, আকাশের নিচে থাকবে না সেই লক্ষ্য পূরণের ব্রত নিয়ে তিনি নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। প্রতিটি অসহায় মানুষের সেবা করাকে তিনি ঈমানি দায়িত্ব বলে মনে করেন।
এজন্যই গৃহহীন-ভূমিহীনদের মাঝে বাড়ি উপহার দিয়ে তিনি বলেন- ‘আজ আমার আনন্দের দিন। যাদের কিছুই ছিল না, তাদের ঘর দিয়ে মাথা গোঁজার ঠাঁই করে দিতে পেরেছি। যখন এই মানুষগুলো এই ঘরে থাকবে, তখন আমার মা-বাবার আত্মা শান্তি পাবে। লাখো শহিদের আত্মা শান্তি পাবে। কারণ, এসব দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোই তো ছিল আমার বাবার লক্ষ্য’।
‘আশ্রয়নের অধিকার শেখ হাসিনার উপহার’—এই স্লোগানকে সামনে রেখে সরকার দেশের প্রতিটি ভূমিহীন ও গৃহহীনদের জন্য এই ‘স্বপ্নের নীড়’ তৈরির লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে।
ইতোমধ্যে এ বছরই ১ লাখ ২৩ হাজার ২শ ৪৪টি বাড়ি হস্তান্তর করা হয়েছে আরও ১ লাখ হস্তান্তরের প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। পৃথিবীর ইতিহাসে এই বিরল কাজটি করে বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবেন। সাধারণ মানু্ষের জন্য বঙ্গবন্ধু ছাড়া এমন করে আর কোনো রাষ্ট্রনায়ক কখনও কোনোদিন ভাবেননি।
শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেই হয়ত এমনি করে মানুষের কথা চিন্তা করতে পারেন এবং দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য কাজ করে থাকেন। সকল অসম্ভবকে সম্ভব করেই দেশকে তিনি সাফল্যের স্বর্ণশিখরে নিয়ে যাচ্ছেন। লাখ লাখ মানুষের চোখের জল তিনি মুছে দিচ্ছেন। দেশের প্রতিটি অসহায় সম্বলহীন মানুষের কাছে মায়ের ভূমিকায় তিনি আজ অবতীর্ণ হয়েছেন।
লেখক: সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ ও সাবেক ছাত্রনেতা।
haldertapas80@gmail.com