একটা সময় আমরা ক্লাব বলতে বুঝতাম আবাহনী, মোহামেডান, আরামবাগ, ব্রাদার্স, ওয়ান্ডারার্স এসব। ক্লাবেগুলোতে মূলত ফুটবল খেলা হতো। তবে ক্রিকেট ও অন্যান্য খেলাও হতো সীমিত পরিসরে। ঢাকা স্টেডিয়ামে আবাহনী-মোহামেডানের ফুটবল খেলায় দর্শকদের মধ্যে উত্তেজনা ও ক্ষেত্র বিশেষে অপ্রীতিকর ঘটনা ছিল যেন অবধারিত। তবে সেসব ঘটনা ছিল আনন্দ আর খেলাকেন্দ্রিক বিনোদন।
পরবর্তী সময়ে জানতে পেলাম পাশ্চাত্যের ক্যাসিনো ক্লাবও নাকি এ দেশে এসেছে। এই তো কিছুদিন আগে সেই ক্যাসিনো ক্লাবে চলল ব্যাপক ধরপাকড়।ঢাকার অভিজাত শ্রেণির আড্ডা দেবার জন্য নানান ক্লাবও আছে। এর মধ্যে ঢাকায় অবস্থিত ব্রিটিশ শ্বেতাঙ্গদের বিনোদনের জন্য ১৯১১ সালে গড়ে ওঠে ঢাকা ক্লাব। যা পরবর্তীতে এ দেশীয় নব্য ধনিক আর অভিজাত শ্রেণির বিনোদনকেন্দ্রে পরিণত হয়। তেমনি এলাকাভিত্তিক অভিজাত শ্রেণির জন্য গড়ে উঠেছে নানাধরনের নানা নামের ক্লাব। আবার এখন জানছি, বোট ক্লাব, নৌকা ক্লাব, স্টিমার ক্লাব ইত্যাদি। এসব হয়তো আগে থেকেই ছিল, নিজের অজ্ঞতার কারণে জানতে পারিনি। অচিরেই হয়তো জানা যাবে ল্যাম্বোরগিনি ক্লাব, মার্সিডিজ ক্লাব, বিএমডব্লিউ ক্লাব, রোলস রয়েস ক্লাব... প্রভৃতি। বিপুল পরিমাণ অর্থব্যয় করে এসব ক্লাব গড়ে ওঠার পেছনে নিশ্চয়ই কারণ আছে।বিশ্বায়নের এই কালে উন্নত সমাজ ব্যবস্থা থেকে আমাদের সমাজে প্রতিনিয়তই ঢুকে পড়ছে ভিন্ন ভিন্ন জীবনধারা, আচরণ। এই ভিন্ন আচরণ, জীবনধারাকে একত্রিত করে নিয়তই রূপান্তর ঘটছে সামাজিক কাঠামোয়। বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতির কারণে মানুষের জীবনধারাও বদলে যাচ্ছে।
আর একথা বলার অপেক্ষা রাখে না, উন্নততর জীবনধারায় কে না প্রবেশ করতে চায়। তাইতো এই যে সংস্কৃতির রূপান্তর, মানুষের বদলে যাওয়া মনোজগৎ; এতে সমাজের কতটুকু লাভক্ষতি হয়েছে, তারচেয়েও বড় কথা বিজ্ঞানের উৎকর্ষের কারণে অপরিহার্যভাবে আমাদের সামাজিক রূপান্তর ঘটেছে।মনুষ্যত্বের বিকাশ ও মূল্যবোধের অন্তর্নিহিত চেতনাকে জাগ্রত করার মধ্য দিয়েই একটি জাতিগোষ্ঠীর মানুষ পরিপূর্ণ নাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠে। মানুষের নাম নিয়ে জন্ম হলেও মনুষ্যত্ব অর্জন একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। এই দীর্ঘ যাত্রাপথে শিক্ষা-সৌজন্যবোধ, মায়া-মমতা, নৈতিকতা-নম্রতা, ভদ্রতার সঙ্গে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি জড়িয়ে আছে তাহলো সংস্কৃতিবোধ। সাংস্কৃতিক চেতনার ঢেউ যথাযথভাবে ছড়িয়ে না পড়ায় সমাজে অপসংস্কৃতি স্থান করে নিয়েছে প্রবলভাবে। অর্থবিত্তের নিরিখে তাই এসব ক্লাবে আনাগোনা না কমে বরং বেড়েছে।
খেলার ক্লাবগুলো ভালো উদ্দেশ্য নিয়েই আত্মপ্রকাশ করেছিল, যদিও পরবর্তী সময়ে সেগুলোর কিছু জুয়ার আখড়ায় পরিণত হয়। বাকিগুলোর উদ্দেশ্য কী ছিল জানি না। তবে বিত্তবান আর অভিজাত পরিবারের সদস্যরা টাকার বিনিময়ে এসব ক্লাবের সদস্য হন। নিজের বিনোদনের জন্য, মনোরঞ্জনের জন্য, আড্ডা দেবার জন্য। আর কী কী হয় এর সব খবর প্রকাশ্যে আসে না।
এসব ক্লাব নিয়ে সাধারণের ধারণা খুব স্বচ্ছ নয়, ইতিবাচক তো নয়ই। কারণেএক শ্রেণির ধনিকগোষ্ঠীর আনন্দ-ফুর্তি-বিনোদনের জন্য গড়ে ওঠা এই ক্লাবগুলোর সামাজিক আন্দোলন এবং সংস্কৃতিকবোধ বিকাশে কোনো ভূমিকা রাখতে দেখা যায়নি।
অপ্রিয় সত্য হলো, বেশিরভাগ ক্লাবই ধোয়া তুলসী পাতা নয়। সেখানে এলিট শ্রেণির মনোরঞ্জনের নৈতিক এবং অনৈতিক নানা কর্মকাণ্ড চলে বলে প্রায়ই সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ পায়।একথা সত্য, শহর-গ্রাম সবখানেই সুস্থ বিনোদনের বড়ই অভাব। চিত্তকে বিকশিত করার আদি ও অকৃত্রিম মাধ্যমগুলো হটিয়ে, বিজাতীয় ও সংগতিহীন সংস্কৃতি ধারণ করতে যেয়ে আমরা না দেশীয়, না পাশ্চাত্য কোনোটিকেই আত্মস্থ করতে পারিনি।বরং পশ্চিমের মন্দ দিকগুলো প্রতিষ্ঠা করতে উঠে পড়ে লেগেছি। আমাদের আবহমান সংস্কৃতি জাতির শেকড় পর্যায়ে ছড়িয়ে দিতে ব্যর্থ হয়েছি।দেশের নাগরিক হিসেবে সংবিধান আমাদের কর্তৃত্ব দিয়েছে সবখানে যাওয়ার। কিন্তু সংবিধান দিয়ে দেশ চললেও সমাজে এর প্রভাব পড়ছে না। সংবিধানিক বাধ্যবাধকতা থাকলেও আমরা নারী-পুরুষের সমতার বিধান করতে পারিনি, পারিনি বৈষম্য দূর করতে। নারীকে পরিপূর্ণ মানুষের মর্যাদা দিতে পারিনি। আমাদের সমাজে পাশ্চাত্যের সংস্কৃতি ঢুকতে সাহায্য করেছি কিন্তু নৈতিকতা প্রবেশ করাতে পারিনি। তাই সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে পঙ্কিলতার পুঁতিগন্ধ ছড়িয়ে রয়েছে। পশুদের অভয়ারণ্যের মতো অসুরের অভয়ারণ্য তৈরি হয়েছে।
স্বাধীনতার অর্ধশতক পরেও এ দেশের মাটিতে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে নির্বিঘ্নে চলতে পারে না। এ ব্যর্থতার দায় একা রাষ্ট্রের নয়, এ ব্যর্থতা আমাদের সবার।এ সমাজকে ক্লেদাক্ত কুৎসিত গহ্বর থেকে যতদিন বের করা না যাচ্ছে, ততদিনই আমাদের সংগ্রামের ভেতর দিয়ে যেতে হবে। সে সংগ্রাম হবে নৈতিকতা এবং মূল্যবোধের আদর্শিক শিক্ষার মাধ্যমে সমাজের মানসিক উৎকর্ষ সাধনের সংগ্রাম। শুধু নারী নয়, শুধু পুরুষ নয়; মানুষে মানুষে সম্মান, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে।তাহলে সকাল-বিকাল, সন্ধ্যা বা গভীর রাতেও যেখানে ইচ্ছে যাওয়া যেতে পারে।
যতদিন তেমন পরিস্থিতি তৈরি করতে না পারছি, ততদিন নিজেকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে কখন কোথায় যাওয়া উচিত অথবা অনুচিত।সম্প্রতি এক ক্লাবে সেলিব্রিটি নারী অপদস্ত হয়। বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। অথচ ক্লাবগুলোর ঝলমলে রঙিন আলোর নিচে প্রতিনিয়ত কত নারীর স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে যাচ্ছে, হাহাকারে বিদীর্ণ হচ্ছে হৃদয়ের কোমল অনুভূতি সে খবর কজন রাখে?
ভারতের অমিতাভ বচ্চনের ‘পিঙ্ক’ মুভির খুবই শক্তিশালী ‘না’ ( No means no) শব্দটি এখানে ব্যঙ্গাত্মক ভঙ্গিমায় ফুটে উঠবে। নিজ ঘরেই যেখানে নারীরা নিরাপদ নয়, সেখানে মধ্যরাত্রিতে মদ জুয়ার আসরে যাওয়াটাও কোনো বিচক্ষণতার পরিচয় বহন করে না। ঘটনাটি অবশ্যই নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি রাখে। আরও তদন্তের দাবি রাখে, ক্লাবের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির কারণে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কি না। আমরা যতই ক্লাব বা কর্পোরেট কালচারে উদ্বুদ্ধ হই না কেন, ঘুরেফিরে সেই আবহমানকালের বাঙালি সংস্কৃতিতেই ফিরে যেতে হবে। সেই সোঁদা মাটির গন্ধ, সেই জারি-সারি, ভাটিয়ালি গান উপজীব্য করেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।
রবীন্দ্র-নজরুল-জীবনানন্দ-সুকান্ততে আমাদের জীবনের তাল-লয়-সুর খুঁজে নিতে হবে। আব্বাসউদ্দীন আর আব্দুল আলীমের লোকগানের ভেতর থেকে রসাচ্ছাদন করতে হবে। নৈতিক চেতনাকে উদ্বুদ্ধ করতে, মনুষ্যত্ববোধকে জাগ্রত করতে আমাদের সেই আদি অকৃত্রিম শেকড়েই ফেরত যেতে হবে। যে শেকড় জীবনকে মোহময়, মায়াময়, কাব্যময় করে ভাববার বাসনা দিয়েছে। যে জীবন থেকে খুঁজে পাই কঠিনতম বাস্তবতার মাঝেও আনন্দময় জীবনের রসদ। ‘দিকে দিগন্তে যত আনন্দ লভিয়াছে, এক গভীর গন্ধ'... এই সেই গন্ধ যা মদিরতা মাখানো শৈশব থেকে আহরিত। এটা ইউটোপিয়ান ড্রিম বা ‘কাল্পনিক স্বপ্ন’ নয়, এটা অতীতাশ্রয়ী মধুরতম অনুভূতি। এই মধুর অনুভূতি দ্বারাই উন্নততর সাংস্কৃতিক চেতনা জাগ্রত করার মাধ্যমে সভ্যতার সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও শিক্ষক