বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

জাহানারা ইমামের স্বপ্ন পূর্ণতা পাক

  • তপন পালিত   
  • ২৬ জুন, ২০২১ ১৫:২৮

শহীদ জননী জাহানারা ইমামের আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় কাদের মোল্লার রায়কে কেন্দ্র করে ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে শাহবাগ চত্বরে জন্ম নেয় তারুণ্যের মহাজাগরণ। এই তরুণদের জন্ম মুক্তিযুদ্ধের অনেক পরে। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চেতনাহীনতার অন্ধকার সময়ে একটি গোটা প্রজন্ম বেড়ে উঠেছে। জাহানারা ইমামের আন্দোলন এই তরুণ প্রজন্মকে আলোকিত করে।

আজ ২৬ জুন শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ২৭তম মৃত্যবার্ষিকী। ১৯৯৪ সালের ২৬ জুন শহীদ জননী মৃত্যুবরণ করেন। অবিভক্ত বাংলার মুর্শিদাবাদ জেলার সুন্দরপুর গ্রামে ১৯২৯ সালের ৩ মে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট পিতা আবদুল আলীর তত্ত্বাবধানে রক্ষণশীলতার বাইরে এসে তিনি আধুনিক শিক্ষা লাভ করেন। বিবাহিত জীবনে লেখাপড়ায় তিনি প্রকৌশলী স্বামী শরীফ ইমামের দিক থেকেও উৎসাহ ও আনুকূল্য পেয়েছিলেন। পিতার চাকরিসূত্রে জাহানারা ইমাম বাংলাদেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করেন।

১৯৪৫ সালে কলকাতার লেডি ব্রেবোর্ন কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। ১৯৬০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএড পাস করার পর ১৯৬৫ সালে তিনি প্রাইভেট পরীক্ষার্থী হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এমএ করেন। তার কর্মজীবন শুরু হয় স্কুলে শিক্ষকতার মাধ্যমে।

১৯৫২ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত তিনি ঢাকার সিদ্ধেশ্বরী গার্লস স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা ছিলেন। ফুলব্রাইট স্কলার জাহানারা ইমাম আমেরিকা থেকে উচ্চশিক্ষা নিয়ে ১৯৬৬ সালে ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন এবং ১৯৬৮-র দিকে সেই চাকরি ছেড়ে দেন। পরে তিনি নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন। ক্রমশ ব্যক্তিত্বময়ী জাহানারা ইমাম ষাটের দশকে ঢাকার সংস্কৃতি মহলে সুপরিচিত হয়ে ওঠেন।

ষাট ও সত্তর দশকে সাহিত্যজগতে জাহানারা ইমাম অল্প-বিস্তর পরিচিত ছিলেন শিশু-কিশোর উপযোগী রচনার জন্য। কিন্তু তার সর্বাধিক খ্যাতির কারণ দিনপঞ্জিরূপে লেখা তার অনবদ্য গ্রন্থ ‘একাত্তরের দিনগুলি’।

মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি পুত্র মুক্তিযোদ্ধা রুমী ও স্বামীকে হারান। মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘ নয় মাস কেটেছে তার একদিকে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও ত্রাসের মধ্য দিয়ে; অন্যদিকে মনের মধ্যে ছিল দেশপ্রেম ও স্বাধীনতার স্বপ্ন। সেই দুঃসহ দিনগুলোতে প্রাত্যহিক ঘটনা এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করার বৃত্তান্ত লিখেছিলেন তিনি নানা চিরকুটে, ছিন্নপাতায়, গোপন ভঙ্গি ও সংকেতে।

১৯৮৬ সালে একাত্তরের দিনগুলি গ্রন্থাকারে প্রকাশের পর তা জনমনে বিপুল সাড়া জাগায়। তার এই দিনপঞ্জি বস্তুত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক একটি শিহরণমূলক ও মর্মস্পর্শী ঘটনাবৃত্তান্ত।

স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে জাহানারা ইমাম লেখালেখিতে ব্যস্ত সময় কাটান এবং তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো এ সময়ে প্রকাশ পায়। গল্প-উপন্যাস ও দিনপঞ্জি জাতীয় রচনা মিলিয়ে তার আরও কয়েকটি গ্রন্থ রয়েছে। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: অন্য জীবন (১৯৮৫), বীরশ্রেষ্ঠ (১৯৮৫), জীবন মৃত্যু (১৯৮৮), চিরায়ত সাহিত্য (১৯৮৯), বুকের ভিতরে আগুন (১৯৯০), নাটকের অবসান (১৯৯০), দুই মেরু (১৯৯০), নিঃসঙ্গ পাইন (১৯৯০), ক্যানসারের সঙ্গে বসবাস (১৯৯১) ও প্রবাসের দিনলিপি (১৯৯২)।

১৯৯১ সালে শহীদ জননী জাহানারা ইমাম বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান। এছাড়াও তিনি পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার।

শহীদ জননী লেখালেখির পাশাপাশি মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নিজেকে যুক্ত করেন। জামায়াতে ইসলামীসহ বিভিন্ন ফ্যাসিবাদী শক্তির স্বাধীনতাবিরোধী তৎপরতায় সরকারের সহায়ক ভূমিকার তীব্র সমালোচনা করে ১৯৮১ সালের ২৭ এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে এক নাগরিক সমাবেশের মাধ্যমে ‘সাম্প্রদায়িকতা ও ফ্যাসিবাদবিরোধী নাগরিক কমিটি’ গঠন করা হয়।

তিনি ছিলেন এই কমিটির গুরুত্বপূর্ণ একজন সদস্য। ২৫ মে বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গণে সাম্প্রদায়িকতা ও ফ্যাসিবাদবিরোধী নাগরিক কমিটির উদ্যোগে ‘ভারতীয় আগ্রাসন, সাম্প্রদায়িকতা ও স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে’ এক বিশাল জনসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এই সমাবেশে জাহানারা ইমাম সকল মুক্তিযোদ্ধাকে সন্তান সম্বোধন করে মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার বাস্তবায়নের আহ্বান জানিয়ে এবং দেশপ্রেমিক জনগণকে আন্তর্জাতিক আগ্রাসন এবং দেশের স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার আহ্বান জানান। তিনি বলেন-

‘জামায়াতীরা ধর্ম নিয়ে ব্যবসা করছে। ’৭১-এ ধর্মের দোহাই দিয়ে তারা গণহত্যা করেছে। তারা ধর্মোন্মাদ, বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মানুষের সরলতার সুযোগ নিচ্ছে’।

এই সমাবেশের মাধ্যমে তিনি প্রথমবারের মতো প্রকাশ্য জনসভায় বক্তৃতা করেন। এরপর থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি আর থামেননি। মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের দাবির পাশাপাশি ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে সামনের সারিতে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন।

শহীদ জননী ক্ষমতার চেয়ে রাজপথকে উত্তম মনে করেছিলেন। ১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান জাহানারা ইমামকে মহিলা বিষয়ক উপদেষ্টা করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তিনি রাজি হননি। সেসময়ে অনেক বামপন্থী ও কমিউনিস্ট নেতা জিয়াউর রহমানকে সমর্থন করে তার উপদেষ্টা ও মন্ত্রিপরিষদে যোগ দিয়েছিলেন। কিছু দিনের মধ্যে ১৯৮১ সালের ৩০ মে জেনারেল জিয়াউর রহমান কিছুসংখ্যক সেনা অফিসারের হাতে নিহত হন। জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর নাগরিক কমিটি নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। কমিটির কয়েকজন নেতৃস্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা সদস্য রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রয়োজন অনুভব করেন।

এ নিয়ে কমিটিতে মতপার্থক্য থাকায় ১৯৮১ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সময় পৃথক নাগরিক কমিটি গঠিত হয়। এর প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের ৭ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার লে. কর্ণেল (অব.) কাজী নূর-উজ্জামান ও ডা. জাফরউল্লাহ চৌধুরী। মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল এমএজি ওসমানী ছিলেন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে নাগরিক কমিটির প্রার্থী। জেনারেল ওসমানীর অনুরোধে জাহানারা ইমাম তার নির্বাচন পরিচালনা কমিটির প্রচার ও প্রকাশনা বিভাগের আহ্বায়কের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

জাহানারা ইমামের চেষ্টায় এই ঘোষণায় ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধ করার কথা বলা হয়েছিল যা অন্য প্রার্থীদের ঘোষণায় ছিল না। জেনারেল ওসমানীর নির্বাচনি ইশতেহার প্রকাশিত হওয়ার পর ছোট কিছু রাজনৈতিক দল ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন স্বতঃস্ফূর্তভাবে পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে তাকে সমর্থন করেন। কিন্তু নির্বাচনে জয়লাভ করেন বিচারপতি আব্দুস সাত্তার।

এই সময়ে শহীদ জননীর মুখগহ্বরের ক্যানসার ধরা পড়ে। তবে এই অসুস্থতা তার জীবনগতিকে এতটুকু কমাতে পারেনি, বরং তা আরও গতিশীল হয়ে গভীরে প্রোথিত হয়। নতুন কর্মে ব্যাপৃত হন তিনি।

১৯৮৬ সালে তার লেখা ডায়েরি একাত্তরের দিনগুলি বই আকারে প্রকাশিত হয়। এই বই নতুন প্রজন্মের মাঝে ব্যাপক সাড়া ফেলে। একদিকে মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট, আবেগ, চেতনা, তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের পরিচয় ও সাহস এবং অপরদিকে যুদ্ধের বিস্তৃতি, নৃশংসতা ও স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার, আলবদর, আলশামসদের ক্রূরতা মুক্তিযুদ্ধকে তরুণ প্রজন্মের কাছে নতুন করে পরিচিত করে।

১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সামরিক সরকার স্বঘোষিত হত্যাকারীসহ স্বাধীনতাবিরোধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের সব বিচার কার্যক্রম বন্ধ করে জাতির বিবেককে তমসাবৃত করে দেয়। শহীদ জননীর লেখনীতে পুরো জাতির বিবেক মুক্তির আলোয় পথ খুঁজে পায়। গড়ে ওঠতে থাকে জনমত।

১৯৯০ সালে এরশাদ সরকারের পতনের পর বাংলাদেশে গণতন্ত্রের পুনর্জাগরণ হবে বলে আশা করা হয়। কিন্তু দেখা যায় যে, এক সময়ের যুদ্ধাপরাধী মতিউর রহমান নিজামীর নেতৃত্বাধীন জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে রাজনৈতিক সংলাপের মাধ্যমে তাদেরকে জাতীয় রাজনীতির পাশাপাশি জাতীয় নির্বাচনেও অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়া হয়।

এভাবে ধীরে ধীরে মানবতাবিরোধীরা বাংলাদেশে রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে। ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও সরকার গঠনের জন্য নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে ব্যর্থ হয়। এ পরিস্থিতিতে জামায়াতে ইসলামীর সমর্থন নিয়ে বিএনপি সরকার গঠন করে।

১৯৯১ সালের ২৯ ডিসেম্বর শীর্ষস্থানীয় যুদ্ধাপরাধী ও পাকিস্তানি নাগরিক গোলাম আযমকে দলের আমির ঘোষণা করায় সারা দেশ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। গোলাম আযমকে জামায়াতে ইসলামীর আমির বানানোর প্রতিবাদে ১৯৯২ সালের ১৯ জানুয়ারি শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি এবং কিছুদিন পর ১১ ফেব্রুয়ারি ৭২টি রাজনৈতিক, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন নিয়ে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি’ গঠিত হয়।

দেশের সব প্রগতিশীল জোটের সহযোগিতায় ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি ১৯৯২ সালের ২৬ মার্চ ‘গণ-আদালত’ প্রতিষ্ঠা করে স্বাধীনতা যুদ্ধের শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের বিচারের আয়োজন করে। বিচারে পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগী জামায়াতে ইসলামীর নেতা গোলাম আযমকে গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ এবং যুদ্ধাপরাধের দায়ে প্রতীকী মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। গণ-আদালতের রায় বাস্তবায়নের জন্য তৎকালীন বিএনপি সরকারকে অনুরোধ জানানো হয়।

বিএনপি সরকার জনগণের সেই রায় কার্যকর না করে শহীদ জননী জাহানারা ইমামসহ ২৪ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা করে। শুধু গোলাম আযমের মৃত্যুদণ্ড দিয়ে কাজ শেষ হয়নি।

গোলাম আযম ছাড়াও অন্য যুদ্ধাপরাধীদের অপরাধ তদন্তের জন্য সুফিয়া কামালকে প্রধান করে ১১ সদস্যবিশিষ্ট একটি জাতীয় গণতদন্ত কমিশন গঠন করা হয়। সেই কমিশন ১৯৯৪ ও ১৯৯৫ সালে তদন্ত করে দুই দফায় ৮ জন করে ১৬ শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীর অপরাধের কথা প্রকাশ করে। রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা মাথায় নিয়ে ১৯৯৪ সালের ২৬ জুন জাহানারা ইমাম দুরারোগ্য ক্যানসারে ভুগে মৃত্যুবরণ করেন। সমন্বয় কমিটির দায়িত্ব পালনকালে তাকে অনেক প্রতিকূলতা মোকাবিলা করতে হয়েছে। সেসময়ে তিনি আক্ষেপ করে বলেছিলেন-

‘অনেকগুলো জীবন্ত ব্যাঙকে একসাথে এক ঝুড়িতে রাখা যেমন কষ্টকর তেমনি অনেকগুলো রাজনৈতিক দলকে একসাথে করে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়াও কষ্টসাধ্য। কারণ জীবন্ত ব্যাঙ একটিকে ঝুড়িতে উঠিয়ে রাখলে অন্যটি যেমন লাফ দিয়ে মাঠিতে পড়ে। তেমনি একেক দলের একেক দাবি পূরণ করে সমন্বয় কমিটির কাজ চালিয়ে যেতে হচ্ছে।’ তারপরও সব প্রতিকূলতা অতিক্রম করে রাজনৈতিক দলগুলোর দাবি-দাওয়া পূরণ করে দৃপ্তপ্রত্যয়ে তিনি সংগঠনের নেতৃত্ব দিয়েছেন।

সুশীল সমাজে উদ্ভূত আন্দোলন দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার উদাহরণ খুব কম। তবে শহীদ জননীর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। নির্মূল কমিটির নেতৃবৃন্দ আন্দোলনের একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছেন। নির্মূল কমিটির প্রধান লক্ষ্য ছিল একাত্তরের ঘাতক-দালালদের বিচার। শহীদ জননীর মৃত্যুর পর মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের দাবিতে চলমান আন্দোলনে খানিকটা ভাটা পড়ে। তখন শাহরিয়ার কবির ও কাজী মুকুল নির্মূল কমিটির কার্যক্রমকে বেগবান করেন। শামসুর রাহমান দীর্ঘদিন কমিটির সভাপতি ছিলেন। এছাড়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী, কবীর চৌধুরী, কামাল লোহানী, অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন প্রমুখ এই আন্দোলনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন।

নির্মূল কমিটি পুনর্গঠনের সময় সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে নতুন প্রজন্মকে। এই আন্দোলনের সঙ্গে তাদের যুক্ত করতে এবং দেশের বরেণ্য বুদ্ধিজীবীদের আরও বেশি সম্পৃক্ত করতে কাজ করা হয়। কারণ ১৯৯৪-এর ২৬ জুন মৃত্যুর আগে শহীদ জননী এই আন্দোলনের দায়িত্বভার কোনো ব্যক্তি বা দলের ওপর দিয়ে যাননি। তার অন্তিম বাণী ছিল-

‘এই আন্দোলনকে এখনো অনেক দুস্তর পথ পাড়ি দিতে হবে। দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক, মুক্তিযোদ্ধা, ছাত্র ও যুব শক্তি, নারী সমাজসহ দেশের সর্বস্তরের মানুষ এই লড়াইয়ে আছে। তবু আমি জানি জনগণের মতো বিশ্বস্ত আর কেউ নয়। জনগণই সকল শক্তির উৎস। তাই একাত্তরের ঘাতক ও যুদ্ধাপরাধী বিরোধী মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও ’৭১-এর ঘাতক দালাল নির্মূল সমন্বয় আন্দোলনের দায়িত্বভার আমি আপনাদের বাংলাদেশের জনগণের হাতে অর্পণ করলাম। জয় আমাদের হবেই।’

জাহানারা ইমামের মৃত্যুর পর সমন্বয় কমিটি ভেঙে যায় এবং নির্মূল কমিটি পুনর্গঠন করে আন্দোলনের নতুন পর্যায় শুরু হয়। সামরিক শাসন ও খালেদা জিয়ার শাসনামলে খুব বেশি আন্দোলন হয়নি। তবে বিভিন্ন সভা-সমাবেশ ও পুস্তিকা প্রকাশের মাধ্যমে বিচারের দাবি অব্যাহত রাখা হয়। আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি জোরদার হয়। এই সময়ে মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডাররা বিচারের দাবির সমর্থনে সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম গঠন করে চলমান আন্দোলনকে বেগবান করেন।

২০০৮ সালের নির্বাচনে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের দাবি সমর্থন করে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট বিপুল ভোটে জয়লাভ করে সরকার গঠন করে। নির্বাচনে জয়লাভের পর সংসদের প্রথম অধিবেশনে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের বিষয়টি সর্বসম্মতভাবে পাস হয় এবং ২০১০ সালের ২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার কার্যক্রম শুরু হয়। বিচার শুরুর মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের দাবি সাফল্য লাভ করে।

১৯৭২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারিতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে রাজপথে প্রথম মিছিল করে যে আন্দোলনের সূত্রপাত হয়, সেই আন্দোলন শহীদ জননী জাহানারা ইমামের গণ-আদালতে গোলাম আযমের বিচারের মাধ্যমে সারা বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে।

শহীদ জননী জাহানারা ইমামের আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় কাদের মোল্লার রায়কে কেন্দ্র করে ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে শাহবাগ চত্বরে জন্ম নেয় তারুণ্যের মহাজাগরণ। এই তরুণদের জন্ম মুক্তিযুদ্ধের অনেক পরে। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চেতনাহীনতার অন্ধকার সময়ে একটি গোটা প্রজন্ম বেড়ে উঠেছে। জাহানারা ইমামের আন্দোলন এই তরুণ প্রজন্মকে আলোকিত করে। শহীদ জননীর আন্দোলনের মশাল শহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের তরুণদের হাতে তুলে দেয়া হয়।

২০১৩ সালের ২৫ মার্চ শহীদমিনার থেকে আলোর মিছিল শুরুর আগে শহীদজায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী আনুষ্ঠানিকভাবে মশাল তুলে দেন গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ডা. ইমরান এইচ সরকারের হাতে। পদ্মা-মেঘনা-যমুনার মিলিত স্রোতধারার মতো এই আন্দোলন একদিন সাগরে গিয়ে মিলবে, তারপরও ধর্মনিরপেক্ষ মানবিক সমাজ গড়বার কর্মযজ্ঞ তরুণরা অব্যাহত রাখবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। সভ্যতার এই অগ্রযাত্রা রোধ করবার শক্তি কারো নেই। সভ্যতার বোধ প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধাপরাধী বিচার আন্দোলন করা হয়। আজ অনেক ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে জাতি রায় পর্যন্ত পৌঁছেছে।

মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলায় শকুনির মচ্ছবে শহীদ জননী শোকাভিভূত হয়ে নীরবে শুধু অশ্রুবর্ষণ করেননি। তিনি হৃদয়ের সব অনুভূতি ও চেতনার তাগিদে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর নির্মম নির্যাতনের পৈশাচিক কাহিনি বিধৃত করেছেন তার হৃদয়স্পর্শী লেখায়। কিন্তু শুধু আবেগ প্রকাশ করে ক্ষুব্ধ লড়াইয়ের দিনলিপিই তিনি রচনা করে ক্ষান্ত হননি। তার বুকের ভেতর যে ঘৃণার পাহাড় ক্ষোভের আগ্নেয়গিরি সৃষ্টি করেছিল, একদিন তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটল, সূচিত হলো চেতনাদীপ্ত গণ-আন্দোলনের।

এই আন্দোলন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তিকে জাগরিত করে বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসে বাংলাদেশকে বিচারমুখিনতার সংস্কৃতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের মধ্যেদিয়ে আন্দোলন শেষ হয়ে যায়নি। আন্দোলনের একটি পর্যায়ের সফলতা এসেছে। এখন মানুষের মধ্যে এই বোধ সৃষ্টি হয়েছে যে, অপরাধ করলে বিচার হয় এবং শাস্তিও ভোগ করতে হয়। আন্দোলনের অন্যতম লক্ষ্য ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সফলতা আজও পায়নি।

বাংলাদেশ একটি অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের দাবিতে জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে পরিচালিত আন্দোলন সত্যিকারের সাফল্য লাভ করবে। শহীদ জননী মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার আন্দোলনের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তিকে জাগরিত করার যে কাজ শুরু করেছিলেন তা বাস্তবায়নের মধ্যদিয়ে বাংলাদেশ তরুণ প্রজন্মের হাত ধরে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলায় পরিণত হবে মুজিববর্ষে এই প্রত্যাশা। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু!

লেখক: গবেষক-প্রাবন্ধিক, সহকারী অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

এ বিভাগের আরো খবর