ভারতের দৈনিক পত্রিকা ভাস্কর-এর সম্পাদক ওম গৌর গত ১৭ জুন নিউ ইয়র্ক টাইমস-এ ভারতের করোনা পরিস্থিতির বাস্তবতা নিয়ে একটি লেখা লিখেছেন। ওই লেখায় দেখা যাচ্ছে, পৃথিবীর তিন নম্বর সার্কুলেশনের এই দৈনিকটি বিহারের গঙ্গার ধারে ৩০ জন রিপোর্টার ও ফটো জার্নালিস্ট পাঠিয়েছিল। তারা শুধু মে মাসের ১৩ ও ১৪ তারিখে ২ হাজার মৃতদেহ গঙ্গার ধারে পানিতে ও কবরে দেখতে পায়।
ভারতের বিহারের বা উত্তর প্রদেশের এই মৃত্যুর প্রকৃত সংখ্যা কত, তা হয়ত কখনও জানা যাবে না। বিহার সরকারের দেয়া মৃতের সংখ্যা তারা একবার সংশোধন করতে বাধ্য হয়েছে। তারা যে সংখ্যা গোপন করে কম বলছিল, তা ওই ঘটনায় প্রমাণ পায়। ওম গৌরের লেখায়ও ফুটে উঠেছে বাস্তবে মৃতের সংখ্যা যা বলা হচ্ছিল তখন, সেটাই প্রকৃত চিত্র নয়।
শুধু ওম গৌর নয়, ভারতের অধিকাংশ সিনিয়র সাংবাদিকের একই মত। তাদের মতে, আক্রান্তের সংখ্যা এবং মৃতের সংখ্যা যা বলা হয়েছে, বাস্তবে তা অনেক বেশি। কারণ, দরিদ্র যারা গ্রামে বাস করে, এবার ভারতের করোনার দ্বিতীয় ঢেউতে তারা আক্রান্ত হয়েছে অনেক। কিন্তু তাদের কথা সরকারি হিসেবে আসেনি। এমনকি তারা টাকার অভাবে কাঠ কিনতে না পেরে মৃতদেহ গঙ্গায় ভাসিয়ে দিয়েছে, না হয় গঙ্গার চড়ায় তাদেরকে কবর দিয়েছে। আর যারা সৎকারের জন্যে টাকা অভাবে কাঠ কিনতে পারেনি, তারা যে অসুস্থ হলে ওষুধ কিনতে পারেনি, এটাই বাস্তবতা।
ভারতের এই করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের এই ভয়াবহতার কারণের মধ্যে ওম গৌর দুটো বিষয়কে সামনে টেনে এনেছেন। এক, কুম্ভ মেলা। দুই, রাম পূজা। তার মতে, কুম্ভ মেলায় কয়েক হাজার মানুষ আক্রান্ত হয়েছে আর তারা সেটা সারা দেশে ছড়িয়েছে। রাম পূজাতেও একই ঘটনা ঘটেছে।
ভারতে এখন দ্বিতীয় ঢেউ কমেছে। কিন্তু করোনার যে ভ্যারিয়েন্ট অর্থাৎ ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট ভারতের এই দ্বিতীয় ঢেউয়ের মূল কারণ, সেই ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট এখন শুধু বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে না, রাজধানী ঢাকাকেও ব্যাপকভাবে আক্রান্ত করছে। যদিও আক্রান্তের সংখ্যা হাজারের ঘরে আছে এবং মৃত্যুর সংখ্যা এখনও শতকের ঘরে আছে। তবে বাংলাদেশেও যদি ওভাবে এ মুহূর্তে অন্তত কয়েকশ মাইল ঘোরার জন্যে ৫০ জন রিপোর্টার ও ফটো জার্নালিস্টকে পাঠানো হয়, তাহলে ভিন্ন ছবি মিলবে। ইতোমধ্যে দেশের সর্বাধিক সার্কুলেশনের দৈনিক প্রথম আলো রাজশাহীর কবরের সারির ছবি ছেপেছে। তার ভেতর করোনায় মৃতের কবর ও করোনা উপসর্গ নিয়ে মৃতের কবর।
এই করোনা উপসর্গ নিয়ে কিন্তু বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে গ্রামে। কারণ গ্রামের মানুষ তাদের অশিক্ষার কারণে হোক, আর সুযোগের অভাবে হোক, জ্বর হলে করোনা টেস্ট করাচ্ছে খুবই কম। সীমান্তবর্তী জেলার অনেক ডাক্তারের অভিমত, গ্রামের এই মানুষগুলোর টেস্ট করানোর মতো ও চিকিৎসা করানোর মতো সামর্থ্য নেই। তারপর এত লোকের টেস্ট করানোর সুযোগ কোনো জেলা শহরে নেই। তাই ওই সব ডাক্তার মনে করছেন, সরকারের হিসাবের বাইরে আরো অনেক মানুষ দ্রুতই করোনায় আক্রান্ত হবে এবং সরকারের হিসাবের বাইরেই থাকবে তাদের কবর।
ঠিক তেমনিভাবে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ঢাকা শহরে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট প্রবেশ করার মূল কারণ গত রোজার ঈদ এবং মানুষের লকডাউন না মেনে বার বার সীমান্ত এলাকায় নিজ বাড়িতে বা ব্যবসার কাজে যাওয়া এবং ঢাকায় আসা। গত রোজার ঈদে বাংলাদেশের সরকার ভারতের সরকারের মতো ভুল করেনি। ভারতের সরকার যেমন কুম্ভ মেলার অনুমতি দিয়েছিল, বাংলাদেশের সরকার কিন্তু রোজার ঈদে বাড়ি যাবার অনুমতি দেয়নি। গণপরিবহন বন্ধ রেখেছিল। কিন্তু মানুষ মানেনি। মাক্রোবাসে করে তারা যেমন সীমান্ত এলাকার জেলাগুলোতে বাড়িতে গেছে। তেমনি ফেরি পার হয়েছে গাদাগাদি করে। আর এই মাইক্রোতে বসা ও ফেরিতে মানুষের ছবি দেখলে দেখা গেছে, এক থেকে দুই ভাগ মানুষের মুখেও মাস্ক ছিল না।
এ মুহূর্তে করোনা যখন ভয়াবহ আকার ধারণ করতে যাচ্ছে, সে সময়ে আবার কোরবানির ঈদ আসছে। সরকার এখনও কোরবানির ঈদের পশুর হাট নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত জানায়নি। অন্যদিকে যতদূর জানা যাচ্ছে, সরকার মানুষকে বাড়ি যাবার বিষয়ে নিষেধ করবে। কিন্তু এবারও মানুষ শুনবে কি? মানুষের আচরণ দেখে মনে হচ্ছে, তারা শুনবে না।
এ অবস্থায় দেশের বিশেষজ্ঞ কমিটি ১৪ দিনের শাটডাউনের সুপারিশ করেছিলো। সরকার অতটা কড়াকড়িতে না গিয়ে সোমবার থেকে কঠোর লকডাউন দিয়েছে। বাস্তবে ১৪ দিনের একটি শাটডাউন দিয়ে করোনার শেকল ভেঙ্গে ফেলার দরকার ছিল জরুরিভাবে। কিন্তু হয়ত মানুষের অর্থিক কষ্ট ও লকডাউন না মানার প্রবণতা দেখে সরকার বাধ্য হয়ে কঠোর লকডাউন গেল।
কঠোর এ লকডাউন কতোটা কঠোর হবে তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। তাছাড়া সেনাবাহিনী ছাড়া এমন জরুরি অবস্থায় এ ধরনের প্রোগ্রাম বাস্তবায়ন করার প্রশিক্ষণ বেসামরিক প্রশাসনের নেই। তাই এসপি, ডিসিরা এটা পারবেন না। তারা ব্যর্থ হবেন। এ কারণে সেনাবাহিনী যদি না নামানো হয়, তাহলে স্থানীয় এমপিসহ স্থানীয় সরকারের সকল নির্বাচিত প্রতিনিধিদের এই লকডাউন বাস্তবায়নের সঙ্গে যোগ করতে হবে। যোগ করতে হবে প্রতিটি এলাকার সিভিল সোসাইটিকে। তাহলে হয়তো লকডাউন একটা পর্যায়ে নেয়া যাবে। শুধু এসপি-ডিসিদের ওপর নির্ভর করলে এবারও অনান্য বারের মতো ব্যর্থ হবে এই লকডাউন।
আর যে বাস্তবতায় এখন দেশ দাঁড়িয়ে, তাতে যে কোনো মূল্যে ভাইরাসের শেকল ভাঙ্গতে হবে। কারণ, একটা বিষয় মনে রাখা দরকার, ভারতের নিজস্ব দুটো ভ্যাকসিন থাকায় তার সব প্রকার ভ্যাকসিন রপ্তানি বন্ধ করে দিয়ে করোনার সঙ্গে সঙ্গে তাদের ২৬ শতাংশ মানুষকে ভ্যাকসিনেটেড করতে পেরেছে। আমাদের নিজস্ব কোনো ভ্যাকসিন নেই। ভারত রপ্তানি এখনও শুরু করেনি। হয়তো আগস্টের প্রথম সপ্তাহে শুরু করবে। চায়নার প্রতিশ্রুতি অনুয়ায়ী কোনো দেশই ভ্যাকসিন পায়নি চায়নার কাছ থেকে। তারাও ভারতের মতোই সবখানে ফেল করেছে। এদিকে আমাদের ৩ শতাংশ মানুষেরও ভ্যাকসিন দেয়া হয়নি। অন্তত ৬০ থেকে ৭০ ভাগ লোককে ভ্যাকসিন দেয়া না হওয়া অবধি নিরাপদ নয় কোনো দেশ।
আর এর ভেতর ভারত থেকে ইউরোপ অবধি করোনার তৃতীয় ঢেউয়ের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। জাপান বলেছে, তাদের তৃতীয় ঢেউ শেষ হয়ে গেছে। এর থেকে বোঝা যাচ্ছে ৬০ থেকে ৭০ ভাগ লোককে ভ্যাকসিন দেবার আগে কবরের সারি ঠেকানোর একমাত্র পথ করোনা ভাইরাসের শেকল ভেঙ্গে ফেলা। তার জন্যে দরকার কঠোর লকডাউন। যেমন করেছে যুক্তরাজ্য।
আর এছাড়া লকডাউন না মানলে এবং ভ্যাকসিন না পেলে ভারতের গঙ্গার ধারের ওই বিভীষিকাই শুধু ভবিষ্যত হিসেবে দেখা যায়।