দিন দশেক হলো দেশে করোনায় মৃত্যু ও সংক্রমণ উভয়ই উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। বহুদিন পর দৈনন্দিন মৃত্যুর সংখ্যা ৬০ থেকে ৬৫ হয়েছে। আরও উদ্বেগের বিষয়, করোনা সংক্রমণ এখন গ্রামেও ঢুকেছে। মৃত্যুর সংখ্যা নিকট অতীতে ১০০ ছাড়িয়ে গেলেও তা সীমাবদ্ধ থেকেছে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর এবং চট্টগ্রাম জেলা বা এর আশপাশে। এখন তা বিস্তৃত হয়েছে সারা দেশে, কোথাও কিছুটা কম কোথাওবা মারাত্মকভাবে বেশি।
দুই সপ্তাহ যাবৎ দেখা যাচ্ছে প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতেও ভাইরাসটি ছড়িয়ে গেছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ দিয়ে শুরু হলেও রাজশাহী, খুলনা, নওগাঁ, চুয়াডাঙ্গা, যশোর ও খুলনায় ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা ভয়াবহভাবে বেড়েছে। এ এলাকাগুলো প্রতিবেশী দেশ ভারতের সীমান্তবর্তী অঞ্চল।
এর সঙ্গে আরও উৎকণ্ঠা জাগানো বিষয়টি হলো- দেশে যত মানুষ করোনা সংক্রমণের শিকার হয়েছেন, এর ৬৮ ভাগের ক্ষেত্রেই ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া গেছে। বিশেষজ্ঞরা উদ্বেগ উৎকণ্ঠাও প্রকাশ করেছেন এবং যথেষ্ট সতর্কতা কড়াকড়িভাবে অবলম্বনের সুপারিশ করেছেন। এমতাবস্থায় সরকার স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে স্থানীয় পরিস্থিতি বিবেচনা করে প্রয়োজনে এলাকাভিত্তিক লকডাউন বা বিধিনিষেধ আরোপ করতে বলেছে এবং করোনা নিয়ে আদৌ কোনো রকম ঝুঁকি নেয়া যেন না হয়।
এই নির্দেশ জারির পর থেকে সীমান্তের বহুসংখ্যক জেলা-উপজেলায় এমনকি ইউনিয়নেও স্থানীয় কর্তৃপক্ষ লকডাউন ঘোষণা করেছে। নানা ধরনের বিধিনিষেধ জারি করেছে।
সরকারি ঘোষণা অনুযায়ী স্বাস্থ্যবিধি মানার শর্তে সব অফিস খুলে দেয়া হয়েছে। আগামী ১৫ জুলাই পর্যন্ত এই বিধিনিষেধ বলবৎ থাকবে।
সরকার কর্তৃক এ প্রসঙ্গে জারি করা প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী এখন থেকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি অফিস খোলা থাকবে। এতদিন শুধু জরুরি সেবাসংশ্লিষ্ট অফিসগুলো খোলা রাখতে বলা হয়েছিল।
এ ছাড়াও হোটল-রেস্তোরাঁ বাজার-বিপণি প্রভৃতি নির্দিষ্ট সময়ানুযায়ী খোলা থাকবে। গণপরিবহনও স্বাস্থ্যবিধি মেনে সর্বত্র চালু থাকবে।
সরকারের হাতে বর্তমানে যে চীনা টিকা আছে তা দিয়ে টিকাদান কার্যক্রম ১৯ জুন থেকে শুরু করা হলেও তার মোট ডোজ পরিমাণ হলো মাত্র ১১ লাখ ৯১ হাজার যা দিয়ে সাড়ে ছয় লাখের মতো মানুষকে দেয়া যাবে। এই মজুত ফুরিয়ে যেতে বেশি দিন লাগবে না কিন্তু ফুরানোর আগেই যদি নতুন সংগ্রহ না এসে পৌঁছায় তবে এ ক্ষেত্রে আবারও অচলাবস্থার সৃষ্টি হবে।
দেশের চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা আগেই ডবল ডোজ টিকা পেয়েছেন। কিন্তু দেশে নতুন চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ করোনা মোকাবিলার ক্ষেত্রে অপরিহার্য। তাই দেশের সব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজসমূহে শিক্ষাদানরত শিক্ষক-শিক্ষিকা ও শিক্ষার্থীদের নির্বিঘ্নে তাদের শিক্ষাকার্যক্রম অক্ষুণ্ন রাখতে টিকাদান দ্রুত করা প্রয়োজন। প্রশিক্ষণরত নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীর ক্ষেত্রেও দ্রুত টিকাদান প্রযোজ্য।
দেশে করোনা সংক্রমণ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়লেও করোনা পরীক্ষার ব্যাপারে প্রস্তুতি নেহায়েতই অপ্রতুল। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই রোগী চিহ্নিত করা হয় লক্ষণ দেখে। কিন্তু কেউ যদি লক্ষণ উপলব্ধি করতে সক্ষম না হন এবং কাউকে সে সম্পর্কে না জানান সে ক্ষেত্রে তো তাকে বা তাদেরকে হিসাবের আওতাতেই আনা সম্ভব হবে না এবং হচ্ছেও না।
ফলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর দৈনন্দিন সংক্রমণ ও মৃত্যুর যে বিবরণ প্রকাশ করছে তা প্রশ্নাতীত নয়। সংক্রমণ ও মৃতের সংখ্যা প্রকৃত প্রস্তাবে আরও যথেষ্ট পরিমাণে বেশি হতে পারে যদি ব্যাপকভাবে করোনা পরীক্ষা নিশ্চিত করা যায় সর্বত্র।
গুরুতর আক্রান্তের সংখ্যা যেমন বাড়ছে, অক্সিজেন সংকট, বেড-আইসিইউ-এর প্রয়োজনীয়তাও তেমনই বাড়ছে। কিন্তু মাস দেড়েক আগে হাসপাতাল, বেড, আইসিইউ প্রভৃতি বিগত এক বছরে যে পরিমাণে বাড়ার হিসাব প্রকাশ করেছে তা আদৌ চাহিদা পূরণ করতে পারছে না। দ্রুত এগুলোর সংখ্যা বাড়ানো প্রয়োজন।
সরকারি সিদ্ধান্ত হলো ৪০ বছরের ঊর্ধ্বে যারা, তাদের প্রথমে টিকা দেয়া হবে। এই কার্যক্রম অন্তত দু-আড়াই মাস স্থগিত থাকার পর ১৯ জুন থেকে তা আবার শুরু হলেও এই বয়ঃসীমার আওতাধীন নারী-পুরুষদের টিকাদান শেষ হতে আরও সময় লাগবে।
এ বিষয়টি ত্বরান্বিত করা প্রয়োজন। সেই সঙ্গে কত দ্রুত ওই বয়ঃসীমা অন্তত ১৮ বছর পর্যন্ত বিস্তৃত করা যায় তা গুরুত্ব সহকারে ভেবে সেই অনুযায়ী বহুমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার। করোনা বৃদ্ধদের জন্য অধিকতর বিপজ্জনক হলেও ভাইরাসটি এখন ক্রমশ শিশু-কিশোর-যুবক-যুবতী সবাইকেই সংক্রমিত করছে।
একদিকে যেমন প্রয়োজন ব্যাপকভাবে করোনা পরীক্ষার ব্যবস্থা, তেমনই আবার প্রয়োজন দ্রুততম সময়ের মধ্যে প্রয়োজনমতো করোনার টিকা নানা উৎস থেকে সংগ্রহ করা, বিষয়টিকে আরও ত্বরান্বিত করা এবং চিকিৎসা ব্যবস্থার দ্রুত সম্প্রসারণ করা।
একই সঙ্গে গণপরিবহন পুরোপুরি বন্ধ রাখা, অফিস-আদালত, কল-কারখানা বন্ধ রাখা অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাজার-বিপণি, হোটেলসমূহ, পর্যটনকেন্দ্র প্রভৃতিও বন্ধ রাখা (কমপক্ষে তিন সপ্তাহের জন্যে) রাখা যেতে পারে।
এতে আর্থিক ক্ষেত্রেও বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। তবু উপায় নেই। মানুষের জীবন বাঁচানোর চাইতে বড় কোনো কাজ নেই। অবশ্য ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের আর্থিক সহায়তা দিতে হবে।
গণমাধ্যমগুলো বারবার জানাচ্ছে ভারত তৃতীয় ঢেউয়ের আশঙ্কায়। ওখানকার বিশেষজ্ঞরা বলছেন অক্টোবরের মধ্যেই করোনার তৃতীয় ঢেউ ভারতকে গ্রাস করতে পারে। ওই ঢেউ এলে বাংলাদেশও পার পাবে না, যতই সীমান্ত সিল করা হোক না কেন। ইতিমধ্যেই সীমান্ত বন্ধ থাকা সত্ত্বেও ব্ল্যাক ফাঙ্গাস এ দেশে কয়েকজনের দেহে ধরা পড়েছে।
জুলাইতে এসে যাচ্ছে ঈদুল আজহা। এই ঈদে অগণিত মানুষ নিজ নিজ এলাকার দিকে ছুটবেন। সৌদি আরব বিদেশিদের জন্য পরপর দুই বছর হজে অংশগ্রহণ বিরত রেখেছে করোনার কারণে। আমরা কি পারব ঈদযাত্রা ঠেকাতে পরিবহন ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করতে?
লেখক: রাজনীতিক, একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক।