১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আম্রকাননে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়েছিল। এর ঠিক ১৯২ বছর পর বাংলার মানুষের মুক্তি আর অধিকার আদায়ের জন্য ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন পুরান ঢাকার কে এম দাস লেনের রোজ গার্ডেনে আত্মপ্রকাশ ঘটে বাংলার গৌরবগাঁথা ঐতিহ্যবাহী দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও তৎকালীন ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগে’র ।
আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতারা দলের আত্মপ্রকাশের দিন হিসেবে ইতিহাস থেকে ২৩ জুন তারিখটি বেছে নিয়েছিলেন বাঙালির পরাজয়ের সে গ্লানিকে চিরতরে ম্লান করে দেবার জন্যে। আওয়ামী লীগ নামটির সঙ্গেই আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রয়েছে এক মহাপুরুষের নাম। সেই মহানায়ক হাজার বছরের অগ্নিপুরুষ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
ইতিহাসের স্বর্ণালি সন্ধিক্ষণে বাঙালি জাতির জন্য মঙ্গল প্রদীপ জ্বালিয়ে আজও শোষিত বঞ্চিত নিপীড়িত নিষ্পেষিত শৃঙ্খলিত মানুষের বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, যার শিরদাঁড়া স্থাপন করেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ৭২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পার করল। ১৯৫৫ সালে ধর্মনিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সংগঠনটি ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ’ থেকে হয়ে ওঠে দলমত-নির্বিশেষে সবার ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ’।
১৯৫২ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই দিগ্বিজয়ী সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান। ঠিক তার পরের বছরই বঙ্গবন্ধুর উপরে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব ন্যস্ত করা হয় ।
১৯৬৬ সাল পর্যন্ত প্রায় ১৩ বছর সদর্পে কর্মবীরের ভূমিকায় বঙ্গবন্ধু সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। এরপর ১৯৬৬ সালের কাউন্সিলে দলের সভাপতি পদে নির্বাচিত হন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
আওয়ামী লীগের জন্মলাভের পর ৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৬২’র ছাত্র আন্দোলন, ৬৬’র ছয় দফা ও ৬৯’র গণ-অভ্যুত্থান, ৭০’র যুগান্তকারী নির্বাচন সবই হয়েছে আওয়ামী লীগের হাত ধরে। এদেশের প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে আওয়ামী লীগের ভূমিকা প্রত্যুজ্বল। পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক অবিস্মরণীয় নাম।
বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের দুরভিসন্ধিমূলক ষড়যন্ত্র উপলব্ধি করতে পেরে দীর্ঘ ধারাবাহিক ও নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের পর অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। ৭ মার্চ উত্তাল গণসমাবেশে ১৮ মিনিটের এক ঐতিহাসিক ভাষণের মাধ্যমে বাঙালিদের মাঝে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার সঞ্জীবনী শক্তির সঞ্চার করেন। বজ্রনিনাদিত কণ্ঠে ও দ্রোহের স্ফুরণের সম্মেলনের সেই ভাষণ পাকিস্তানিদের অন্তরে কাঁপন ধরিয়ে দেয়।
পরবর্তী সময়ে বাঙালি সেই স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে, মুক্তির ঘোর অমানিশায় প্রদীপ্ত থেকে বাঙালির মহত্তম মহাযজ্ঞ মুক্তিযুদ্ধে শামিল হয়। দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তবন্যার ফল হিসেবে বাংলাদেশ বিজয়ের স্বাদ গ্রহণ করে ও স্বাধীনতা লাভ করে। পাকিস্তানের সূচনালগ্ন থেকে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের প্রতিটি নবসূর্যের আভায় বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নাম অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।
জাতির মঙ্গলের জন্য যখন যা প্রয়োজন সেটিই বাস্তবায়ন করেছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। স্বাধীনতা-উত্তর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার জনকল্যাণধর্মী ও বঞ্চিত মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে নেয়া দূরদর্শী উন্নয়ন কৌশলের নৈতিক ভিত্তি খুঁজে পাওয়া যায় ১৯৭২ সালে গৃহীত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের মাধ্যমে।
‘রাষ্ট্রীয় মৌলনীতি’র অংশ হিসেবে অর্থনীতি ও সমাজে সাম্য নিশ্চিত করা, গ্রামীণ অর্থনীতিকে উজ্জীবিত করা, খাদ্য-বস্ত্র, চিকিৎসা ও বাসস্থানের মতো মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা, নারীর ক্ষমতায়ন ও পরিবেশ সংরক্ষণের মতো অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন লক্ষ্যসমূহ এই সংবিধানে স্থান করে নেয়।
সময়ের প্রয়োজনে শুরুতে রাষ্ট্রীয় খাতকে প্রাধান্য দিলেও ধীরে ধীরে সমবায় ও ব্যক্তিখাতের বিকাশের জন্যে উপযুক্ত নীতি সংস্কারেও তিনি হাত দিয়েছিলেন। স্বাধীনতা-উত্তর বঙ্গবন্ধু সরকার গণমুখী শিক্ষার বিষয়কে শুধু সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিয়েই থেমে থাকেননি, বরং নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এ লক্ষ্যে বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।
গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে যেতে থাকা একটি নবীন জাতি যেন হঠাৎই বাকরুদ্ধ আর স্তব্ধ হয়ে যায় এক কালো রাতের ভয়াল নৃশংসতায়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট একটি সদ্যজাত জাতিকে তার পিতার লাশ বহন করতে হয়। হন্তারকরা বঙ্গবন্ধুকে নারকীয়ভাবে হত্যা করলেও তার রেখে যাওয়া জীবনাদর্শকে মুছে ফেলতে পারেনি। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ এখন লালন করে কোটি কোটি বাঙালি।
৭৫ পরবর্তী বাঙালি জাতির বুকে নেমে আসে এক কৃষ্ণবিবর। ৭৫- পরবর্তী নানা আন্দোলন সংগ্রামে যখন আওয়ামী লীগকে মুছে দেয়ার জন্য বার বার চেষ্টা করা হয়েছে তখন আওয়ামী লীগ কর্মীদের রক্তের স্রোতের মাধ্যমে সেই অপচেষ্টাকে প্রতিহত করা হয়েছে। অস্বীকার করার উপায় নেই, আজকের আওয়ামী লীগ দাঁড়িয়ে আছে অসংখ্য নেতা কর্মীর আত্মত্যাগের ওপর। আওয়ামী লীগের চলার পথ মসৃণ হয়েছে অসংখ্য কর্মীর শরীর থেকে ঝরা রক্ত দিয়ে।
১৯৮১ সালে শেখ হাসিনা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের হাল ধরলে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের অন্তরের ভেতরে উদ্বেলিত বারুদ আবারও ফুঁসে ওঠে। জনমানুষের হয়ে আগের চেয়েও দ্বিগুণ শক্তি নিয়ে বঙ্গবন্ধু তনয়া দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ আবারও সুসংগঠিত হয়।
স্বৈরাচার, অগণতন্ত্রের বিরুদ্ধে হাজারও সংগ্রাম সাধনার পর ১৯৯৬ সালের আবারও সেই ২৩ জুনেই আওয়ামী লীগ সরকার পুনরায় রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। দেশের অভ্যন্তরীণ অবকাঠামোগত সব উন্নয়নের কর্মপ্রক্রিয়া বাস্তবায়নের রোডম্যাপ সে সময়ে আওয়ামী লীগ সরকারের মাধ্যমেই সম্পাদন করা হয়।
কিন্তু বরাবরই শস্যের ভেতরে ভূত হয়ে আসে পাকিস্তানি প্রেতাত্মাদের দোসর ও তাদের উত্তরসূরিরা। স্বাধীনতাবিরোধী চক্র জগদ্দল পাথরের মতো জাতির ঘাড়ে চেপে বসে জাতির সব অর্জনকে ভূলুন্ঠিত করবার পাঁয়তারা করেছে।
২০০১ থেকে ২০০৮ সাল ছিল নৈরাজ্য, দুঃশাসন, দুর্নীতি আর জাতির কপালে কালিমা লেপনের এক অন্ধকারতম অধ্যায়। বাঙালির ভাগ্যাকাশে নিগৃহীত এই কলঙ্কময় অধ্যায় জাতির অর্জনকে নিমেষেই জলে ভাসিয়ে দিয়েছিল। দেশজুড়ে অরাজকতা ও সন্ত্রাসের কালো ছায়ায় বাংলাদেশ যেন বিপন্নপ্রায়। বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনাকে বারংবার হত্যাচেষ্টায় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ঢাল হয়ে সব অপঘাতকে রুখে দিয়েছে। এ যাবৎ বঙ্গবন্ধু তনয়া দেশরত্ন শেখ হাসিনাকে প্রায় ১৯ বার হত্যা করবার অপচেষ্টা করা হয়। প্রতিবারই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো জ্বলে উঠে প্রতিরোধ করেছে।
দেশে রাজনৈতিক সংকটের পর ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে পুনরায় সরকার গঠন করে। ২০০৯ সাল থেকে টানা তিন মেয়াদে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগের টানা এক যুগের শাসনামলে দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন দেশ-বিদেশে আলোচিত হয়েছে। মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়েছে। বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। মহাকাশে নিজস্ব স্যাটেলাইট প্রেরণ করা হয়েছে। কৃষি ও খাদ্য উৎপাদনে সাফল্য এসেছে। জঙ্গি দমনে সাফল্য সারা বিশ্বে আলোচিত।
এদেশে আওয়ামী লীগই একমাত্র দল যেটি দেশের স্বাধিকার ও স্বাধীনতা আন্দোলনে নিরবিচ্ছিন্ন ভূমিকা রেখেছে। দেশের বিভিন্ন সংকট ও দুর্যোগে অন্যদলগুলো যখন নানা নাটকীয়তায় সিদ্ধান্ত গ্রহণে সময়ক্ষেপণ করেছে, আওয়ামী লীগ তখন তার অবস্থানে অটল থেকে জনগণকে সংগঠিত করেছে। অন্যদলগুলো যখন ইতিহাসের সাক্ষী হওয়া নিয়ে অহংকারে ব্যস্ত, আওয়ামী লীগ তখন নির্মাণ করছে নতুন ইতিহাস।
লড়াই সংগ্রামে অটল অবিচল ও দ্যুতি সঞ্চারে বাঙালির লালিত স্বপ্ন সাহসের সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। বাঙালির স্বাধীনচেতা অগ্নিগর্ভে দ্রোহের স্ফুরণ ঘটেছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের হাত ধরেই। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই যেমন সব দৌরাত্ম্যের দোটানাকে দমন করে দুর্বার গতিতে দুর্দমনীয় হয়ে এগিয়েছে, ঠিক তেমনি সব ষড়যন্ত্রের বিষদাঁত ভেঙে দিয়ে জাতিকে মুক্তির আলোকবার্তা উপহার দিয়েছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। যুগে যুগে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের এই আলোর পথে অভিযাত্রা অব্যাহত থাকুক।
লেখক: শিক্ষার্থী, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়