বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

আওয়ামী লীগের ৭২ বছর

  • চিররঞ্জন সরকার   
  • ২৪ জুন, ২০২১ ১৩:০৮

দীর্ঘদিনের অপপ্রচারের ফলে দেশে আসলে মৌলবাদীচেতনা দৃঢ় হয়েছে। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত অপপ্রচার চালানো হয়েছে। গোষ্ঠীটি বলেছে, আওয়ামী লীগ ‘মুসলমানবিদ্বেষী, আওয়ামী লীগ হিন্দুদের দল, আওয়ামী লীগ ভারতের দালাল’- এ কুৎসিত মিথ্যাচার মানুষের মননে এবং মগজে ঢোকানোর এক মহাপরিকল্পনার বাস্তবায়ন চলে দীর্ঘ ২১ বছর।

৭২ থেকে ৭৩ বছরে পা দিয়েছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ৷ বয়সের হিসেবে বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরোনো রাজনৈতিক দল। অবশ্য ব্যক্তির ক্ষেত্রে যেমন, কোনো রাজনৈতিক সংগঠনেরও বয়স কোনো গুণ নয়। তাই যদি হতো তাহলে বাংলাদেশের সবচেয়ে বয়স্ক দল মুসলিম লীগ। সেটির আদৌ কোনো অস্তিত্ব নেই। কমিউনিস্ট পার্টিও প্রাচীনতর দল।

১৯৫৭ সালে ভাসানী প্রতিষ্ঠিত ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) কত ভাগে বিভক্ত এবং কোন অংশের সমর্থক কত, তা আমাদের মতো মানুষের পক্ষে বলা সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। নানা উত্থান-পতন, ঘাত-প্রতিঘাতের ভেতর দিয়ে দলটি সাবলীলভাবে অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে।

১৯৭৫ সালে সপরিবার বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর কয়েক বছর দলটি অস্তিত্বসংকটে পড়েছিল। ১৯৭৫-৮১ এই কয়েক বছর বাদ দিলে দলটি সব সময়ই দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। অতীতে অনেকবার দলটি ক্ষমতায় যেমন ছিল, তেমন বিরোধী দলেও ছিল। বিরোধী দলে থাকার সময়ও শক্ত অবস্থানে ছিল।

যে সংগঠন বিরোধী দলে থেকে শক্ত ভূমিকা পালন করতে পারে না, সে দল ভোটে নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় গিয়েও ভালো করতে পারে না। আওয়ামী লীগ অবশ্য ক্ষমতায় থাকার চেয়ে বিরোধী দলে থেকে উজ্জ্বল ভূমিকা পালনের রেকর্ড গড়েছে।

হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শামসুল হকের যৌথ নেতৃত্বে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়৷ জন্মলগ্নে এই দলের নাম ছিল ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’৷

১৯৫৫ সালের কাউন্সিলে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ নীতি গ্রহণের মাধ্যমে অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল হিসেবে ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ’ নামকরণ করা হয়৷ স্বাধীনতার পর নামকরণ হয় ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ’৷ বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফিরে দলের হাল ধরেন বর্তমান সভাপতি শেখ হাসিনা৷ এরপর থেকে, গেল ৪০ বছর দলের সভাপতির দায়িত্বে আছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা, সময়ের হিসাবে যা আওয়ামী লীগের ইতিহাসে অর্ধেকের বেশি৷

১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর ২০০১-২০০৭ পর্যন্ত একটা বিরতি দিয়ে আবার সরকার গঠন করে দলটি৷ এরপর থেকে টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আছে তারা৷ স্বাধীনতার পর সবচেয়ে বেশি সময় ক্ষমতায় থাকার রেকর্ডও এই দলটির।

কিন্তু যে আদর্শ নিয়ে দলটি পথচলা শুরু করেছিল, সেখান থেকে দলটি ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছে। দলটি ক্রমেই ধর্ম ও ব্যবসায়িক-নির্ভর হয়ে পড়েছে। গণতান্ত্রিক আদর্শচর্চার ক্ষেত্রেও ঘাটতি লক্ষ করা যাচ্ছে।

এখন আওয়ামী লীগে তৃণমূল থেকে উঠে আসা রাজনীতিবিদদের চেয়ে ব্যবসায়ী ও আমলাদের প্রভাব বেড়েছে। দলে নিয়মিত কাউন্সিল হয় না। গণতন্ত্রচর্চা হয় না। জাতীয় পর্যায়ে সুষ্ঠু নির্বাচনের আয়োজনের ক্ষেত্রেও দলটির মধ্যে অনীহা সৃষ্টি হয়েছে। অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবর্তে নানা কারসাজির মাধ্যমে জয়ী হওয়া এবং ক্ষমতায় টিকে থাকার ঝোঁক দলটির মধ্যে স্পষ্ট। শুধু তাই নয়, দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে অবৈধভাবে টাকা বানানোর ধান্দা বাড়ছে।

চাঁদাবাজি, ঘুষ, দুর্নীতিতে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছেন দলের কিছু নেতা-কর্মী। বড়লোকরা প্রতিনিয়ত সুবিধা পাচ্ছে। সে তুলনায় গরিব মানুষের জন্য নীতি-কর্মসূচি নেই বললেই চলে। অথচ আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাই হয়েছিল নিপীড়ন রোধ করতে, শোষণ-বঞ্চনা-ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত দেশ গড়তে। একটি গণতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মাণের স্বপ্ন থেকে। সেদিক থেকে বিবেচনা করলে আওয়ামী লীগ অনেকটাই আদর্শবিচ্যুত হয়ে গেছে। বিশেষত ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শচর্চার ক্ষেত্রে।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক দর্শনের মূল ভিত্তিগুলোর মধ্যে অন্যতম অসাম্প্রদায়িক চেতনা। ধর্মান্ধ, মৌলবাদ এবং সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে সারা জীবন লড়াই করে গেছেন বঙ্গবন্ধু।

আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার একটি অন্যতম অনুষঙ্গ হলো অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ। ‘বাংলার হিন্দু, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার খ্রিষ্টান, বাংলার মুসলমান, আমরা সবাই বাঙালি’- এ স্লোগান বুকে ধারণ করেই এ দেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। জীবন উৎসর্গ করেছিল। আজ স্বাধীনতা অর্জনের পঞ্চাশ পর পেছনে ফিরে তাকালে হতাশ হতে হয়। ধর্মনিরপেক্ষ চেতনা থেকে দলটি ক্রমেই যেন দূরে সরে যাচ্ছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্ম-পরিচয় এখন অনেক ক্ষেত্রেই দলটির নীতিনির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে বলে অভিযোগ শোনা যায়।

অথচ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রে এখনও বলা আছে: ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা তথা সকল ধর্মের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ ও অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি এবং সমাজতন্ত্র তথা শোষণমুক্ত সমাজ ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হইবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মূলনীতি।’

কিন্তু ৭২ বছর পর আওয়ামী লীগের দিকে তাকালে মনে হয় দলটি বুঝি তার এই ঘোষিত মূলনীতি থেকে সরে এসেছে! অসাম্প্রদায়িকতার আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য সাংস্কৃতিক লড়াইয়ের পরিবর্তে দলটি ক্রমেই ধর্মীয় চেতনায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে। দল হিসেবে আওয়ামী লীগ আধুনিকতা ও ধর্মনিরপেক্ষ চেতনাকে জনপ্রিয় করার কোনো উদ্যোগ নেয়নি।

বরং একটু একটু করে মৌলবাদীদের সঙ্গে তাল মিলিয়েছে। সংবিধানে এখনও রাষ্ট্রধর্ম বহাল। সবার মধ্যে অসাম্প্রদায়িক মনমানসিকতা সৃষ্টির জন্য উদ্যোগী হওয়া, আধুনিক প্রগতিমুখী যুক্তি ও বিজ্ঞাননির্ভর চেতনা গড়ে তোলার জন্য সামাজিক জাগরণ সৃষ্টি করা, তৃণমূল পর্যায়ে রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ প্রদান ইত্যাদি কাজ করা হয়নি। বরং নানাভাবে ধর্মমুখী চেতনাকেই তালিম দেয়া হয়েছে। ফলে আওয়ামী লীগের অনেক নেতা-কর্মীর মধ্যেই এখন হেফাজতিচেতনা বাসা বেঁধেছে।

আওয়ামী লীগের অনেক নেতা মনে করেন, দীর্ঘদিনের অপপ্রচারের ফলে দেশে আসলে মৌলবাদীচেতনা দৃঢ় হয়েছে। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত অপপ্রচার চালানো হয়েছে। গোষ্ঠীটি বলেছে, আওয়ামী লীগ ‘মুসলমানবিদ্বেষী, আওয়ামী লীগ হিন্দুদের দল, আওয়ামী লীগ ভারতের দালাল’- এ কুৎসিত মিথ্যাচার মানুষের মননে এবং মগজে ঢোকানোর এক মহাপরিকল্পনার বাস্তবায়ন চলে দীর্ঘ ২১ বছর।

’৭৫-এর পর আওয়ামী লীগের নেতারাও এসব ধর্মীয় অপপ্রচারে বিভ্রান্তিতে পড়েন। নিজেদের ‘মুসলমান’ প্রমাণে মরিয়া হয়ে ওঠেন কেউ কেউ। ধর্ম ও রাজনীতির ককটেলে আওয়ামী লীগের অনেক নেতাও আসক্ত হন। বঙ্গবন্ধু যেভাবে দৃঢ়চিত্তে অকপটে ধর্মব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কথা বলতেন, যেভাবে তাদের মুখোশ উন্মোচন করতেন সে পথ থেকে সরে আসে আওয়ামী লীগ।

আওয়ামী লীগের সমর্থক বুদ্ধিজীবীরাও মনে করেন, বর্তমানে রাষ্ট্রধর্ম বাতিল করার মতো পরিস্থিতি আর নেই। সমাজ এখন অনেকটাই ধর্মীয় চেতনায় আচ্ছন্ন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, উনসত্তর, একাত্তর কিংবা স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশ যদি ধর্মবাদী রাজনীতিকে নাকচ করতে পারে, আজকের বাংলাদেশ কেন পারবে না?

আসলে আওয়ামী লীগের ভেতরেই মৌলবাদী গোষ্ঠী বাসা বেঁধেছে। ধর্মের প্রশ্নে দলটি ক্রমেই আপসের পথে হাঁটছে। বিভিন্ন সময়ে মৌলবাদীদের সঙ্গে আঁতাত করার প্রবণতা লক্ষণীয়, আবার তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পদক্ষেপও আমরা দেখি, কখনও পাঠ্যপুস্তক বদল করে, ধর্মীয় শিক্ষাকে সাধারণ শিক্ষার সমমর্যাদায় উন্নীত করে মৌলবাদীদের তুষ্ট করার চেষ্টা করা হয়েছে। নিয়মিত বাজেট বরাদ্দ বাড়িয়ে ধর্মীয় শিক্ষাকেও রাষ্ট্রীয়ভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, রাষ্ট্রধর্মের পক্ষে ধারাবাহিক উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

আসলে একটু একটু করে ক্রমেই পশ্চাৎপদ ধ্যানধারণাকেই যেন জাতীয়ভাবে আঁকড়ে ধরা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগও গড্ডলপ্রবাহে গা ভাসিয়েছে। অথচ বাংলাদেশকে উন্নত করতে হলে সবার আগে দেশের মানুষের মনমানসিকতার উন্নয়ন প্রয়োজন। এ জন্য দরকার মতাদর্শিক লড়াই। মানসম্পন্ন শিক্ষা। প্রয়োজন অসাম্প্রদায়িকতার চর্চা, যুক্তি ও বিজ্ঞানের অুনশীলন বাড়ানো। তা না হলে ফি বছর আমাদের মাথাপিছু আয় হয়ত বাড়বে, কিন্তু এদেশে আবু ত্ব-হা, মামুনুল হক, সাঈদীদের মতাদর্শই বিস্তৃত হবে।

৭২তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর এই লগ্নে আওয়ামী লীগকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তারা কি বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগকে বিকশিত করবে, নাকি বর্তমান প্রবাহ ধরে রাখবে?

লেখক: প্রাবন্ধিক, সাবেক ছাত্রনেতা।

এ বিভাগের আরো খবর