একটি রাজনৈতিক দল জনসমর্থন নিয়ে টিকে থাকে এর আদর্শিক অবস্থান বজায় রেখে। মাটি ও মানুষের মধ্য থেকে গড়ে ও বেড়ে উঠলে এবং নানা যুগপর্বে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ঘটনার সঙ্গে যুক্ত থাকলে, ভূমিকা রাখলে একে ঐতিহ্যিক দল হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। এই সূত্রে আওয়ামী লীগ একটি ঐতিহ্যবাহী দল। এমন দলের জন্মকাল থেকেই আদর্শ ও দর্শন থাকে। এ ধারার রাজনৈতিক দল যতকাল এই আদর্শ ও দর্শন ধারণ করতে পারে, ততদিন রাজনীতির মাঠে এবং জনগণের আস্থায় সম্মানজনক অবস্থানে টিকে থাকে।
এই অর্থে মুসলিম লীগও একটি ঐতিহ্যবাহী দল। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের সূত্রে দলটির জন্ম। বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হলে অনুন্নত মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ববঙ্গ লাভবান হবে বিবেচনার ঢাকার নবাবদের নেতৃত্বে বঙ্গভঙ্গকে সমর্থন জানানো হয়।
অপরদিকে কলকাতাকেন্দ্রিক শিক্ষিত হিন্দু সম্প্রদায় ইংরেজদের কূটচাল বিবেচনা করে বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করতে থাকে। ভারতীয়দের একমাত্র রাজনৈতিক সংগঠন সর্বভারতীয় কংগ্রেস অসাম্প্রদায়িক দল হিসেবেই আত্মপ্রকাশ করেছিল। কিন্তু যখন কংগ্রেসের নেতারা মুসলমান নেতাদের সঙ্গে কোনো পরামর্শ ছাড়াই বঙ্গভঙ্গের বিরোধী অবস্থানে দাঁড়ালেন, তখন পূর্ববঙ্গের মুসলমান নেতারা কংগ্রেসের ওপর আস্থা রাখতে পারলেন না।
নবাব স্যার সলিমুল্লাহর নেতৃত্বে তারা সংঘবদ্ধ হলেন। বুঝতে পারলেন নিজ সম্প্রদায়ের দাবি আদায়ের জন্য মুসলমানদের রাজনৈতিক দল থাকা চাই। এই লক্ষ্যেই ঢাকায় ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ গঠিত হলো।
ভারত বিভাগ ও পাকিস্তান আন্দোলনে মুসলিম লীগ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানের শাসনক্ষমতা চলে যায় পশ্চিম পাকিস্তানি নেতাদের হাতে। সরকারি পক্ষের রাজনৈতিক দল হয় মুসলিম লীগ। মুসলিম লীগের সমকক্ষ রাজনৈতিক দল পাকিস্তানের প্রথম পর্বে আর ছিল না। বাংলার অধিকাংশ নেতাই মুসলিম লীগের সদস্য ছিলেন।
একপর্যায়ে বাঙালি নেতাদের মোহভঙ্গ হয়। ভাষার প্রশ্নে যখন পাকিস্তানি শাসকদের হিংস্র মনোভাব স্পষ্ট হলো, সংঘটিত হয়ে গেল ভাষা আন্দোলন তখনই মুসলিম লীগে বেজে উঠল পতনের সুর। এই অবধারিত সত্যটি স্পষ্ট হলো। আদর্শচ্যুত হয়ে মুসলিম লীগের মতো বড় ও ঐতিহ্যবাহী দলকেও মুখ থুবড়ে পড়তে হয়েছিল।
ভাষা প্রশ্নে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বৈরী মনোভাব এবং ভাষাসূত্রে পূর্ববাংলায় সংঘটিত ভাষা আন্দোলন এ দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক জীবনে প্রবল আলোড়নের সৃষ্টি করে। এ দেশের রাজনীতিবিদদের কাছে স্পষ্ট হয়ে পড়েছিল যে, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীকে বিশ্বাস করার কোনো ভিত্তি নেই। শাসকগোষ্ঠীর অগণতান্ত্রিক চিন্তাভাবনা, সরকারি নীতিতে পক্ষপাতিত্ব এবং মুসলিম লীগের রাজনীতিতে পাকিস্তান সরকারের পক্ষে শোষণনীতি ইত্যাদি ক্রমেই প্রকাশ্যে চলে আসে।
সুতরাং তারা বুঝতে পেরেছিল এ দেশের জনগণের অধিকারের কথা বলার জন্য নিজেদের রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তোলা প্রয়োজন। এই চিন্তার ফসল হিসেবে ১৯৪৯ সালের জুন মাসে ঢাকায় আত্মপ্রকাশ করে ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ নামের রাজনৈতিক সংগঠন। এই নতুন দলের সভাপতি মনোনীত হন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং সাধারণ সম্পাদক মনোনীত হন শামসুল হক।
আওয়ামী মুসলিম লীগের রাজনীতির মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল পূর্ববাংলার স্বায়ত্তশাসন অর্জন। এই লক্ষ্যেই তারা একটি গঠনতন্ত্র প্রণয়ন করেন। এতে পাকিস্তানের আঞ্চলিক ইউনিটগুলোকে আত্মনিয়ন্ত্রণের পূর্ণ অধিকার দেয়ার প্রস্তাব রাখা হয়। গঠনতন্ত্রে বাংলার নিজস্ব পদাতিক, নৌ ও বিমানবাহিনী রাখার বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
মুসলিম লীগের প্রতি ইতোমধ্যেই পূর্ববাংলার মানুষের আস্থা কমে গিয়েছিল। ফলে অধিকাংশ মানুষই আওয়ামী মুসলিম লীগের নেতৃত্ব মেনে নিতে থাকে। পরবর্তী পর্যায়ে সময়ের দাবিতে এবং বিশেষ করে সাম্প্রদায়িকতার ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে আওয়ামী মুসলিম লীগ ‘আওয়ামী লীগ’-এ রূপান্তরিত হয়।
আওয়ামী লীগ নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত হন। তার নেতৃত্বে সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনে দাপটের সঙ্গে এগিয়ে যায় বাঙালি। ১৯৭০-এর নির্বাচনে অভ্রভেদী জয় পায় আওয়ামী লীগ। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বে ছিল আওয়ামী লীগ।
তাহলে দেখা যাচ্ছে জন্মলগ্ন থেকেই আওয়ামী লীগ গণতন্ত্র ও অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির আদর্শ নিয়ে বেড়ে উঠেছিল। জনপ্রিয়তার শীর্ষে চলে আসতে থাকে দলটি। ষাটের দশকজুড়ে এই ঐতিহ্যবাহী দলটি আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে নিজ আদর্শ সমুন্নত রেখেছিল। এই সমুদয় পর্বে আওয়ামী লীগ তার আদর্শ থেকে সরে আসেনি।
স্বাধীনতা-উত্তরকালেও আওয়ামী লীগ তার আদর্শ ধরে রাখার চেষ্টা করেছে। বঙ্গবন্ধু আদর্শ দুর্বল করতে দেননি। তার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গণতন্ত্রের যাত্রাপথকে শক্তিশালী করে। মন্ত্রিপরিষদ-শাসিত সরকারব্যবস্থার প্রবর্তন করেন বঙ্গবন্ধু। পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম ১৯৪৭ সালে হলেও সংবিধান পাস হয়েছিল ১৯৫৬ সালে। প্রায় ১০ বছর লেগে যায়।
অপরদিকে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার কয়েক মাসের মধ্যেই ১৯৭২ সালে সংবিধান প্রণয়ন করতে পেরেছিলেন। এই সংবিধানে আওয়ামী লীগের আদর্শের প্রতিফলন ঘটিয়েছিলেন। গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও প্রগতিশীলতা জড়িয়ে ছিল সংবিধানে।
বঙ্গবন্ধু জীবদ্দশায় তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে গেছেন। দল ও প্রশাসনে দুর্নীতি থাকলে সব অর্জনই ধ্বংস হয়ে যায়। যতই আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র থাক না কেন, ১৯৭৪-এর দুর্ভিক্ষের পেছনে আকাশচুম্বী দুর্নীতির ভূমিকা কিছু মাত্রায় কম ছিল না। ‘চোরের দল’, ‘চাটার দল’ বলে বঙ্গবন্ধুকে শুধু আক্ষেপ করতে দেখেছি। সময়ের বাস্তবতায় এবং একটি শুভ ইচ্ছা সামনে রেখে সাময়িক রাজনৈতিক ব্যবস্থা হিসেবে সব দল নিষিদ্ধ করে বঙ্গবন্ধুকে বাকশাল ঘোষণা করতে হয়।
যতই শুভ ইচ্ছা থাক, মানতে হবে এই ব্যবস্থা আওয়ামী লীগের অদর্শকে ধারণ করেনি। তাই শেষ পর্যন্ত একটি কঠিন দুর্ভোগের মুখোমুখি হতে হয়েছিল আওয়ামী লীগকে, দেশবাসীকেও। এখনও সমালোচনা থেকে রক্ষা পাচ্ছে না ঐতিহ্যবাহী দল আওয়ামী লীগ।
বঙ্গবন্ধু-উত্তর আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে থেকে বা সরকার গঠন করে সততা ও দলীয় আদর্শ সামনে রেখে যেভাবে এগিয়ে যাওয়ার কথা ছিল, সে পথে সব সময় হাঁটতে পারেনি। সাধারণ মানুষের সঙ্গে দূরত্ব বেড়ে যায়। এই দুর্বলতার সুযোগে প্রকৃত প্রস্তাবে কোনো আদর্শ ধারণ না করা ভুঁইফোঁড় দল বিএনপি জেঁকে বসতে পেরেছিল।
জিয়াউর রহমান আওয়ামী লীগ নেতাদের দুর্বলতা ও গণবিচ্ছিন্ন আচরণকে পর্যবেক্ষণ করে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে যেতে পেরেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের মাত্র চার বছর অতিক্রান্ত না হতেই গণতান্ত্রিক ধারা বিচ্ছিন্ন সেনাছাউনি থেকে বেরিয়ে আসা একটি দল রাজনীতির মাঠে শক্ত ভিত্তি পেয়ে যায় শুধু আওয়ামী লীগ নেতাদের দলীয় আদর্শ থেকে বেরিয়ে এসে একটি বিভ্রান্ত দশায় নিপতিত হওয়ার কারণে।
শেখ হাসিনা দুর্দশাগ্রস্ত দলের হাল ধরলেও দৃঢ় পায়ে দাঁড়ানো সম্ভব হয়নি। রাজনৈতিক সুবিধার কথা বিবেচনা করে দলীয় আদর্শকে বিসর্জন দিয়ে জামায়াতসহ অন্যান্য মৌলবাদী দলের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করতে হয়েছে। যে ধারা থেকে এখনও বের হওয়া সম্ভব হয়নি।
ক্ষমতার রাজনীতিতে অমন দৃষ্টিভঙ্গি হয়তো সাময়িক লাভ নিয়ে আসে কিন্তু দলীয় আদর্শচ্যুতি আখেরে ক্ষতি করে দেয় দলকে। আওয়ামী লীগ তার গৌরবের সময় জনগণের দল ছিল। কিন্তু গণশক্তির ওপর শেষ পর্যন্ত ভরসা রাখতে পারেনি। তাই ক্রমে দলবৃত্তে আটকে যাচ্ছে কঠিনভাবে।
সব ক্ষেত্রে এবং সব প্রতিষ্ঠানে যখন দলীয়করণ কঠিনভাবে জায়গা করে নেয়, তখন স্বাভাবিকভাবে বিতৃষ্ণ হয়ে পড়ে সাধারণ মানুষ। একটি ঐতিহ্যবাহী দল এভাবেই জনবিচ্ছিন্ন হতে থাকে। ক্ষমতার মদে মত্ত থাকায় কঠিন বাস্তবতাকে অনুধাবন করতে চায় না।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত দিক থেকে অনেকটা এগিয়েছে। কিন্তু আওয়ামী লীগের অভিজ্ঞ রাজনীতিকরা জানেন এসব উন্ননের বাস্তবতা সব সময় সাধারণ মানুষকে স্বস্তিতে রাখতে পারে না।
মানুষ তার যাপিত জীবনে যখন প্রতিদিন দলীয় পৃষ্ঠপোষকতায় দুর্নীতি দেখে। সন্ত্রাসের শিকার হয়। অসাম্প্রদায়িকতার আদর্শ থেকে সরে আসতে দেখে। দলীয়করণের ঘেরাটোপে যখন যোগ্য, মেধাবী মানুষদের মূল্যায়ন হয় না, তখন মানুষ ১৯৪৯ সালে গড়ে ওঠা আওয়ামী লীগের সঙ্গে এ সময়ের আওয়ামী লীগের অনেক তফাত দেখতে পায়। এভাবে সাধারণ মানুষের সঙ্গে যদি আওয়ামী লীগের আস্থার সংকট তৈরি হয়, তবে বড় ক্ষতি হয়ে যাবে এই ঐতিহ্যবাহী দলটির।
এই সুযোগটি ভালোভাবেই গ্রহণ করতে চাইবে ভুঁইফোঁড় দল আর মৌলবাদী গোষ্ঠী। এতে আওয়ামী লীগই শুধু ক্ষতিগ্রস্ত হবে না; ক্ষতিগ্রস্ত হবে গণতন্ত্রপ্রত্যাশী এ দেশের কোটি কোটি মানুষ।
আজ আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী সামনে রেখে আমাদের অনুরোধ থাকবে এই দলের নেতারা যাতে আত্মসমালোচনার মাধ্যমে ঘুরে দাঁড়ান। এ দেশে শক্ত বিকল্প গণতান্ত্রিক দলের অস্তিত্ব থাকলে মানুষকে এতটা হতাশ হতে হতো না। বাস্তবতা হচ্ছে এই যে চলমান রাজনীতিতে বিকল্প নেই বলে আওয়ামী লীগকেই এ দেশের কাণ্ডারি হতে হবে।
ক্ষমতার দম্ভে থেকে সাধারণ মানুষকে আমলে না আনা একটি ঐতিহ্যবাহী দলের ‘দর্শন’ হতে পারে না। এই সত্যটি আওয়ামী লীগ নেতারা যত দ্রুত বুঝবেন, তত উপকার হবে দলের আর এ দেশের অধিকাংশ মানুষের।
আমরা প্রত্যাশা করব, ক্ষমতা আর অর্থবিত্ত নয়, আওয়ামী লীগ নেতারা শক্তভাবে দলীয় আদর্শকে সমুন্নত রাখার মধ্য দিয়ে দলীয় অবয়বে যতটা ক্লেদ জমেছে তা ধুয়েমুছে স্বচ্ছ করে দেবেন। মানুষ কিন্তু আওয়ামী লীগের কাছ থেকে এই স্বচ্ছতার রাজনীতিই দেখতে চায়।
লেখক: অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়