বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

আওয়ামী লীগের প্রয়োজনীয়তা

  •    
  • ২৩ জুন, ২০২১ ১৮:০৯

দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব শেখ হাসিনা আদর্শ ও দৃঢ়তায় পরিচালিত করার কারণে দলের ভেতর ও বাইরে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ব্যক্তি ও গোষ্ঠীসমূহ আওয়ামী লীগকে বঙ্গবন্ধুর রেখে যাওয়া আধুনিক কল্যাণবাদী রাষ্ট্র গঠনের নির্ভরযোগ্য দল হিসেবে বিবেচনা করছে। আওয়ামী লীগের বিকল্প এখনও পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের ধারকবাহক কোনো দল হতে পারেনি। যতদিন বাংলাদেশ রাষ্ট্র পরিপূর্ণভাবে সে রকম একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সফল না হচ্ছে, ততদিন এই দলের ঐতিহাসিক ভূমিকা রাখার আবশ্যকতা শেষ হবার নয়।

ইতিহাসে অনেক রাজনৈতিক দল স্বাধীনতা লাভের মতো ঐতিহাসিক অবদানও রেখেছে। কিন্তু এমন রাজনৈতিক দলও খুব বেশি দিন মানুষের সমর্থন নিয়ে টিকে থাকতে পারেনি। মূল দল ভেঙে একাধিক রাজনৈতিক দল, শাখা-প্রশাখা হয়েছে। আমাদের এই অঞ্চলে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তি লাভে দুটি রাজনৈতিক দল বেশ জনসমর্থন লাভ করে। এক কথায় দুটি দল ভারতবর্ষে দুটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার নেতৃত্ব দিয়েছিল। ভারতের স্বাধীনতা লাভে জাতীয় কংগ্রেস এবং পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় মুসলিম লীগ নেতৃত্ব দেয়।

ইতিহাসের অভিজ্ঞতা হলো- মুসলিম লীগ ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পূর্ববাংলায় অতিদ্রুত জনপ্রিয়তা হারাতে থাকে। ১৯৫৪ সালে পূর্ববাংলার প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে দলটির যে পরাজয় ঘটে তা আর কেটে ওঠা সম্ভব হয়নি। যদিও পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার মুসলিম লীগ এবং মুসলিম লীগের নব-সংস্করণে গঠিত দল নিয়ে সামরিক শাসকরাও রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিলেন। কিন্তু পূর্ববাংলার জনগণের মন থেকে মুসলিম লীগ ১৯৪৭-৪৮ সালেই উঠে যেতে থাকে এবং দলটি এই অঞ্চলে আর কোনোদিন দাঁড়াতে পারেনি।

পশ্চিম পাকিস্তানে এখনও বিভিন্ন ব্র্যাকেটবন্দি নামে থাকলেও মুসলিম লীগের গুরুত্ব পাকিস্তানে অনেকটাই হারিয়ে যেতে বসেছে। ভারতে জাতীয় কংগ্রেস এখনও টিকে থাকলেও গত প্রায় ২৫ বছর ধরে জাতীয় কংগ্রেসের অবস্থান অনেকটাই দুর্বল হতে দেখা যাচ্ছে। এসব অভিজ্ঞতা বিবেচনা করলে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের অভিজ্ঞতা বেশ ভিন্ন।

যদিও এ দেশের অনেক বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবোদ্ধা ১৯৭৫ সালের বিয়োগান্ত মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড এবং ১৯৯১-এর নির্বাচনে পরাজয়ের পর বেশ সদম্ভে উচ্চারণ করেছিলেন যে, আওয়ামী লীগ নিশ্চিতভাবেই মুসলিম লীগের ভাগ্যবরণ করতে যাচ্ছে। কোনো কোনো রাজনৈতিক দল ১৯৭৫-এর পর থেকে দাবি করে আসছিল যে, আওয়ামী লীগ আর কোনো দিন ক্ষমতায় আসতে পারবে না, ক্ষমতায় আসতে দেয়াও হবে না। এই চেষ্টা ২১ আগস্ট তারিখে কিংবা এর আগে এবং পরে অনেকবারই করা হয়েছে, এখনও করা হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরে এসেছে, দেশ শাসন করছে, দেশের উন্নয়ন, অগ্রগতি ও পরিবর্তনে বড় ধরনের ভূমিকাও রাখছে।

এই দল পাকিস্তানকালে স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে আন্দোলন-সংগ্রাম জোরদার করেছে, ছয় দফার আন্দোলনকে এক দফায় রূপান্তরিত করে স্বাধীনতা তথা মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছে। স্বাধীনতার পর দলটি একটি আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার শাসনতন্ত্র, অবকাঠামোগত ভিত্তি, জাতি গঠনের প্রয়োজনীয়তা থেকে শিক্ষায় আমূল পরিবর্তনসহ মৌলিক কর্মসূচি প্রদানের মাধ্যমে অগ্রসর হয়েছিল।

দলের প্রধান, নতুন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা, তার ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহযোগীদের হত্যা, আওয়ামী লীগকে ভেঙে তছনছ করে দেয়া, সাম্প্রদায়িক দল সৃষ্টি করা, নতুন নামে মুসলিম লীগের ভাবাদর্শে রাজনৈতিক দল এবং প্রচার-প্রচারণাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে সমাজের তলদেশ পর্যন্ত ছড়িয়ে দেয়ার মাধ্যমে আওয়ামী লীগের রাজনীতিকে কঠিন করে দেয়া হয়েছিল।

এরপরও শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের পুনর্জীবন ঘটেছে, ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে এবং বাংলাদেশকে আওয়ামী লীগ কী ধরনের রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছে, কেমন আর্থসামাজিক ব্যবস্থা তৈরি করতে চাচ্ছে, সক্ষমতা রাখছে, অন্যান্য রাজনৈতিক দল এর ভিন্নতা, প্রয়োজনীয়তা, দেশে ও বিদেশে উপস্থাপন করছে, স্বীকৃতও হচ্ছে।

আওয়ামী লীগ প্রমাণ করে দিচ্ছে যে এর প্রতিষ্ঠার সময় থেকে যে রাজনৈতিক দর্শন এবং রাষ্ট্রকাঠামো তৈরির জন্য এই দলটি লড়াই সংগ্রাম, রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠার মতো ইতিহাস সৃষ্টি করেছে, রাষ্ট্র গঠনের কাজে হাত দিয়েছে। সেটি নানা ষড়যন্ত্রের কারণে পিছিয়ে গেলেও জনগণের আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির অভীষ্ট লক্ষ্য পূরণে দেশে অন্য কোনো রাজনৈতিক দল নয়, বরং আওয়ামী লীগই নানা সীমাবদ্ধতা, জটিলতা, ত্রুটি-দুর্বলতা ইত্যাদির পরও ইতিহাসের কঠিন দায়িত্ব পালনে মৌলিক অবদান রাখার একমাত্র রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে অবস্থান করছে।

বিষয়টি মন গড়া নয়, অন্ধবিশ্বাসপ্রসূতও নয়। ৭২ বছরের রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের বেড়ে ওঠা প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করার সক্ষমতা রাষ্ট্র ও জনগণকে নতুন চিন্তায় নেতৃত্ব দেয়ার যে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা তৈরি করেছে সেটিকে মূল্যায়ন, পুনর্মূল্যায়ন, পর্যবেক্ষণ এবং তুলনামূলক পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে বস্তুনিষ্ঠ রাজনৈতিক বিচার বিশ্লেষণ আওয়ামী লীগের টিকে থাকার চমকপ্রদ ব্যতিক্রমধর্মী ইতিহাসটি সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো। এর বিস্তার অনেক বড়। সেটি অসংখ্য রাজনৈতিক গ্রন্থ রচনা ও গবেষণার বিষয়। সংক্ষেপে আলোচনাটি তুলে ধরছি।

১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার টিকাটুলীর কে এম দাস লেনের রোজ গার্ডেন প্যালেসে একটি সম্মেলন শেষে নতুন একটি রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করা হলো। দলটির নাম ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’। এর উদ্যোক্তারা হলেন বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের একাংশ তথা মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের পূর্ববাংলাবিরোধী রাজনীতির বিরোধিতাকারী যুব কর্মীরা। এরা প্রথমে যুব কর্মী শিবির নামে সংগঠিত হয়।

মূলত পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আগে থেকেই যাদের মনে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছিল, পূর্ববাংলার জনগণের অধিকার আদায়ের জন্য যারা ছিল একনিষ্ঠ, তারা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই ভাষাকেন্দ্রিক বিরোধ, জাতিগত নিপীড়ন, মুসলিম লীগের শাসন-শোষণ, বাঙালিবিরোধী মনোভাব ইত্যাদি দেখে ক্ষুব্ধ হচ্ছিলেন। প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ করার প্রয়োজন অনুভব করছিলেন এবং ছোট ছোট সামাজিক সাংস্কৃতিক ছাত্র সংগঠন এবং যুব সংগঠন গড়ে তুলে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করতে থাকেন।

এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়েছিলেন যারা, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন শওকত আলী, শামসুল হক, কামরুদ্দীন আহমেদ, শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ, অলি আহাদ, মো. তোয়াহা, আতাউর রহমান খান, শামসুজ্জোহা, আবদুল আউয়াল, মুহম্মদ আলমাস প্রমুখ। কলকাতা থেকে সোহরাওয়ার্দী ঢাকায় এসে শওকত আলীকে একটি বিরোধী রাজনৈতিক দল গড়ে তোলার উপদেশ দিয়েছিলেন। এই প্রক্রিয়া ১৯৪৮-৪৯ সালে জোরদার হতে থাকে। ১৯৪৯ সালের ২৬ এপ্রিল টাঙ্গাইলের উপনির্বাচনে মুসলিম লীগ প্রার্থী খুররম খান পন্নীর বিরুদ্ধে ভাসানী-মুজিবসমর্থিত শামসুল হক বিপুল ভোটে জয়লাভ করার পর নতুন সংগঠন গড়ে তোলার বাস্তবতা দৃশ্যমান হয়। তরুণ নেতা শেখ মুজিব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯ মার্চ পিকেটিং করার সময় ইউ/এস ৫৪ সিআরপিসি ধারাতে কারারুদ্ধ হন।

সেই সময়ে একদিকে যুব কর্মী শিবিরে সংগঠন গড়ে তোলার প্রস্তুতি প্রদেশব্যাপী জোরদার হতে থাকে, অপরদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নারায়ণগঞ্জসহ বিভিন্ন জায়গায় ছাত্র-কর্মচারীদের আন্দোলনও বেগবান হতে থাকে। এর আগে মওলানা ভাসানী আসাম থেকে টাঙ্গাইল এবং টাঙ্গাইল থেকে ঢাকায় আমজাদ হোসেনের বাসায় অবস্থান করছিলেন। শওকত আলীর সঙ্গে তার আলোচনা এখানেই হয়।

২৩ জুন রোজ গার্ডেনে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে প্রায় ২৫০-৩০০ ব্যক্তির উপস্থিতিতে জন্ম নেয় নতুন রাজনৈতিক দল ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’। সভাপতি নির্বাচিত হন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, ভাইস প্রেসিডেন্ট হন আতাউর রহমান খান, আবদুস সালাম খান, আলী আহমেদ খান, আমজাদ আলী খান, সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন শামসুল হক, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হন শেখ মুজিবুর রহমান (তিনি তখন জেলে বন্দি) এবং কোষাধ্যক্ষ নির্বাচিত হন ইয়ার মোহাম্মদ খান।

নতুন এই দলটির অন্যতম দাবি ছিল রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার স্বীকৃতি আদায়, ‘এক ব্যক্তি এক ভোট’, সংবিধান প্রণয়ন, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন, সংসদীয় সরকারব্যবস্থা, পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের মধ্যে বৈষম্য দূরীকরণ ইত্যাদি। পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগ স্বায়ত্ত শাসনের দাবি সংগঠনের অন্যতম প্রধান দাবি হিসেবে গ্রহণ করে।

২৬ জুন শেখ মুজিব জেল থেকে ছাড়া পান। আওয়ামী লীগকে তিনি সাংগঠনিকভাবে প্রদেশব্যাপী গড়ে তোলার জন্য মওলানা ভাসানীসহ নেতাদের সঙ্গে বিভিন্ন জেলা ও মহকুমায় সফর করেন, সংগঠনের কমিটি গড়ে তোলেন। এরপর ভাষা আন্দোলনের সময় আওয়ামী লীগের ওপর পাকিস্তানি শাসক মহলের কঠোর অবস্থানের ফলে মওলানা ভাসানী, শেখ মুজিব, শামসুল হকসহ অনেক নেতা কারারুদ্ধ হন।

৫২ সালের ফেব্রুয়ারির শেষ দিক থেকে কেউ কেউ মুক্তি পেলেও ভাসানীসহ অনেক নেতা কারাগারেই ছিলেন। শেখ মুজিব মুক্ত হওয়ার পর আওয়ামী লীগকে শক্তিশালী করার জন্য সাংগঠনিক কর্মসূচি বাড়ান। শেষ পর্যন্ত সরকার বাধ্য হয় কারারুদ্ধ নেতাদের মুক্তি দিতে। ১৯৫৩ সালের দ্বিতীয় সম্মেলনে শেখ মুজিবুর রহমান দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।

১৯৫৩ সালের ৪ ডিসেম্বর মুসলিম লীগ সরকারের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ, কৃষক শ্রমিক পার্টি, পাকিস্তান গণতন্ত্রী পার্টি এবং নেজামে ইসলাম মিলে যুক্তফ্রন্ট গঠন করা হয়। এই ফ্রন্টের মূল নেতা হিসেবে শেরে বাংলা, সোহরাওয়ার্দী এবং মওলানা ভাসানীর নাম যুক্ত হয়। যুক্তফ্রন্ট ২১ দফা প্রণয়নের মাধ্যমে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে বিপুলভাবে জনসমাবেশ ও প্রচার-প্রচারণা চালানো হয়।

১৯৫৪ সালের ৮-১২ মার্চের এই নির্বাচনে মুসলিম লীগের ভরাডুবি ঘটে। প্রাদেশিক পরিষদে যুক্তফ্রন্ট ২৩৭টি আসনের মধ্যে ২২৩টি আসন লাভ করে। মুসলিম লীগ পায় মাত্র ৯টি, আওয়ামী লীগ এককভাবেই ১৪৩টি আসন লাভ করে। মুসলিম লীগের এই পরাজয় এবং আওয়ামী লীগের এই উত্থান পরবর্তী সময়ে ইতিহাসে মূল রাজনৈতিক গতিধারা হিসেবে দৃশ্যমান হয়।

১৯৫৫ সালে আওয়ামী লীগের তৃতীয় দ্বিবার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে আওয়ামী লীগ অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল হিসেবে সর্বসম্মতভাবে নামকরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ১৯৫৭ সালে মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগ ত্যাগ করে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গঠন করেন। আওয়ামী লীগের এক-তৃতীয়াংশ প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য মওলানা ভাসানীর সঙ্গে ন্যাপে যোগদান করেন। এই সময় প্রদেশে আতাউর রহমানের নেতৃত্বে প্রাদেশিক সরকার ক্ষমতায় ছিলেন। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের নেতৃত্ব দেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী।

দলের সেই কঠিন সময়ে শেখ মুজিবুর রহমান মন্ত্রিত্ব ছেড়ে সাংগঠনিক দায়িত্ব যেমন পালন করেন, একই সঙ্গে প্রাদেশিক ও জাতীয় পরিষদে আগে থেকেই পূর্ববাংলার স্বায়ত্ত শাসন, সংবিধান প্রণয়ন, বাংলা ভাষা, অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণ বিভিন্ন দাবিতে দৃঢ় ভূমিকা পালন করেন। পাকিস্তান সরকার আওয়ামী লীগের প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় সরকার ভেঙে দিয়ে শেষ পর্যন্ত সামরিক শাসন জারি করে। আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ জেল-জুলুম-নির্যাতন সহ্য করে আবার দলকে স্বায়ত্তশাসন ও গণতান্ত্রিক অধিকারের লড়াইয়ে প্রস্তুত করেন।

১৯৬৬ সালে অনুষ্ঠিত দলের সম্মেলনে আওয়ামী লীগ নতুনভাবে নেতৃত্বের নির্বাচন করে। শেখ মুজিবুর রহমান সভাপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলাম দলের সহসভাপতি, তাজউদ্দীন আহমেদ সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এই সম্মেলনে ফেব্রুয়ারি মাসে শেখ মুজিবুর রহমানের উত্থাপিত ছয় দফা গৃহীত হয়। ছয় দফাকে জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য শেখ মুজিব এবং নতুন নেতৃত্ব প্রদেশব্যাপী গণসংযোগ ও প্রচার-প্রচারণা বাড়ান।

ছয় দফার প্রতি অভূতপূর্ব জনসমর্থন লক্ষ করেই পাকিস্তান সরকার ৮ মে গভীর রাতে আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দকে ধরপাকড় শুরু করে। দলের শত শত নেতা-কর্মী কারারুদ্ধ হন। এর প্রতিবাদস্বরূপ ৭ জুন প্রদেশব্যাপী হরতাল ডাকা হয়। হরতালে ব্যাপক জনসমর্থন ঘটে। পুলিশ বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি ছোড়ে। এতে ১১ জন নিহত হন। প্রতিক্রিয়ার বারুদ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। পাকিস্তান সরকার দমন নিপীড়ন বাড়িয়ে দেয়। আওয়ামী লীগকে বিভক্ত করার ষড়যন্ত্র আঁটে। পাকিস্তানের অন্য রাজনৈতিক দল ও ভাসানীসহ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ছয় দফার বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেও আওয়ামী লীগ দমে যায়নি।

পাকিস্তান সরকার শেখ মুজিবকে রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে বিচার করার জন্য মামলা রুজু করে। এর প্রতিক্রিয়ায় শেষ পর্যন্ত ১৯৬৯ সালের ছাত্র গণ-অভ্যুত্থান সংগঠিত হয়। শেখ মুজিবসহ রাজবন্দি নেতারা কারামুক্ত হন, জনতার বিজয় সূচিত হয়, আইয়ুব খানের ষড়যন্ত্র পরাজিত হয়। শেখ মুজিব বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত হন।

৭০-এর নির্বাচনে তিনি নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ এবং জনগণের অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে স্বীকৃত হন। পাকিস্তান সরকার তার হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করার প্রতিক্রিয়া হিসেবে জনগণ স্বাধীনতার একদফা বাস্তবায়নে প্রস্তুতি গ্রহণ করে।

৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু করার প্রেক্ষাপট তৈরি করেন। ২৫ মার্চে পাকিস্তানি বাহিনী গণহত্যা শুরু করলে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেন এবং মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধের বিজয় অর্জিত হয়। দীর্ঘ এই রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ সংগঠিত করে। আওয়ামী লীগের এই অবদান ইতিহাসে অক্ষয় হয়ে থাকবে।

১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনের যাত্রা শুরু হয়। গণতন্ত্র-সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং জাতীয়তাবাদের আদর্শ ধারণ করে সংবিধান প্রণীত হয়, রাষ্ট্রকাঠামো গঠনের নানামাত্রিক উদ্যোগ গৃহীত হতে থাকে, দেশীয় আন্তর্জাতিক নানা সংকট, সমস্যা অতিক্রম করে বাংলাদেশকে তখন চলতে হয়েছিল। তারপরও বঙ্গবন্ধু একটি কল্যাণবাদী রাষ্ট্র নির্মাণে জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলেছিলেন। দেশের অভ্যন্তরে স্থিতিশীলতা ফিরে আসার লক্ষণ দেখা যায়।

বাংলাদেশ ১৯৭৫ সালে স্বল্পোন্নত দেশের মর্যাদা লাভ করে। দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৭.৪ শতাংশ হয়। বাংলাদেশ এই ধারায় পরিচালিত হলে অল্প কয়েক বছরের মধ্যেই উন্নয়নশীল এবং উন্নত দেশের মর্যাদা লাভ করতে পারত। কিন্তু ৭৫ সালের হত্যাকাণ্ড ছিল একটি পশ্চাৎমুখী ষড়যন্ত্র। বাংলাদেশকে ফিরিয়ে নেয়া হয় ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের আদর্শে।

দেশে সামরিক-আধা সামরিক শাসনব্যবস্থা চালু করে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে বাংলাদেশকে ফিরিয়ে আনা জটিল ও কঠিন করে দেয়া হলো। ১৯৮১ সালে শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের হাল ধরেন। দলের পুনরুজ্জীবন ঘটিয়ে ১৯৯৬ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে সরকার গঠনে তিনি সক্ষম হন। এই সময়ে আওয়ামী লীগে ত্যাগী মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে বিশ্বাসী বিভিন্ন দলের অনেক নেতা-কর্মীর সম্মিলন ঘটে, আওয়ামী লীগে নতুন রক্তের সঞ্চালনও ঘটে।

১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা দলীয় আদর্শে মিশ্র অর্থনীতির সংযোজন ঘটান। পরবর্তী সময়ে বেসরকারি অর্থনীতিকে জাতীয় উন্নয়নের অন্যতম ধারা হিসেবে গ্রহণ করেন। এর ফলে জাতীয় অর্থনীতি পরিবর্তিত হওয়ার সুযোগ পায়। তার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনায় বাংলাদেশে আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে যে বিপুল পরিবর্তন ঘটে তার ফলে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে প্রবেশ করে, এ ছাড়া উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি অর্জন করে। বাংলাদেশে বিভিন্ন সূচকে এখন একটি দ্রুত পরিবর্তনশীল রাষ্ট্রের মর্যাদা লাভ করেছে। বাংলাদেশের এই পরিবর্তনের বেশ কিছু সুফল মানুষ ভোগ করছে।

দল হিসেবে আওয়ামী লীগ শক্তিশালী হয়ে উঠলেও দলের ভেতরে আদর্শবাদী, ত্যাগী এবং শিক্ষিত মেধাবী নেতা-কর্মীর অভাব অনস্বীকার্য। তবে দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব শেখ হাসিনা আদর্শ ও দৃঢ়তায় পরিচালিত করার কারণে দলের ভেতর ও বাইরে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ব্যক্তি ও গোষ্ঠীসমূহ আওয়ামী লীগকে বঙ্গবন্ধুর রেখে যাওয়া আধুনিক কল্যাণবাদী রাষ্ট্র গঠনের নির্ভরযোগ্য দল হিসেবে বিবেচনা করছে।

আওয়ামী লীগের বিকল্প এখনও পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের ধারকবাহক কোনো দল হতে পারেনি। যতদিন বাংলাদেশ রাষ্ট্র পরিপূর্ণভাবে সে রকম একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সফল না হচ্ছে, ততদিন এই দলের ঐতিহাসিক ভূমিকা রাখার আবশ্যকতা শেষ হবার নয়। সে জন্য দলের তৃণমূল থেকে শীর্ষ পর্যায় পর্যন্ত দলকে এর ইতিহাস, ঐতিহ্য, আদর্শ এবং সৃজনশীলতাকে ধারণ করতেই হবে। তাহলেই আওয়ামী লীগ শত বছরের রাজনৈতিক দল হিসেবে এর ঐতিহাসিক মর্যাদা বাংলাদেশের জাতীয় ইতিহাসেই শুধু নয়, দক্ষিণ এশিয়ায় একদিন অবশ্যই স্মরণীয় স্থান করে নেবে।

লেখক: অধ্যাপক, গবেষক

এ বিভাগের আরো খবর