বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার শাসনকালে মুদ্রিত (২০১৬ সালে) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের প্রথম ভাগে রাষ্ট্রধর্ম অংশে বলা হয়েছে- ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টানসহ অন্যান্য ধর্ম পালনে রাষ্ট্র সমমর্যাদা ও সমঅধিকার নিশ্চিত করিবেন।’
অপরদিকে দ্বিতীয় ভাগের রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতির ১২ অনুচ্ছেদে ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা অংশে লেখা আছে- ‘ধর্ম নিরপেক্ষতা নীতি বাস্তবায়নের জন্য- (ক) সর্ব প্রকার সাম্প্রদায়িকতা, (খ) রাষ্ট্র কর্তৃক কোন ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদা দান, (গ) রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মীয় অপব্যবহার, (ঘ) কোন বিশেষ ধর্ম পালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা তাহার উপর নিপীড়ন,- বিলোপ করা হইবে।’ রাষ্ট্রের এই চরিত্র অক্ষুণ্ন রাখার জন্য জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে সংবিধান প্রণয়নের সময় থেকেই সচেতন ছিলেন।
ধর্মের নামে রাজনীতি নিষিদ্ধ করার জন্য ৩৮ অনুচ্ছেদ সংযুক্ত করা হয় সেসময়। যা ২০২০ সালের ‘মুজিববর্ষে’ বর্তমান সরকারের সময়ও বহাল রয়েছে। এই অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, যেকোনো ব্যক্তি সংগঠন বা সংঘ করতে পারবেন কিন্তু তা যদি নাগরিকদের মধ্যে ধর্মীয়, সামাজিক এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করে কিংবা ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষ, জন্মস্থান বা ভাষার ক্ষেত্রে নাগরিকদের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি করে তাহলে উক্ত সংগঠন, সংঘ বা দল সংবিধানের পরিপন্থী বলে গণ্য হবে। এটি ধর্ম নিয়ে রাজনীতিচর্চাকে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করার বিধি।
প্রকৃতপক্ষে বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন রাজনীতির সঙ্গে ধর্মের সংযোগ ছিন্ন করার একটা বিধান। এজন্য ১২ অনুচ্ছেদের সঙ্গে ৩৮ অনুচ্ছেদের শর্ত জুড়ে দিয়ে বিষয়টি স্পষ্ট করা হয়। তিনি কখনও বাংলাদেশকে একটি ধর্মীয় রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চাননি। পাকিস্তান আমলে ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় ধর্মের নামে যে নির্যাতন পাকসেনারা করেছিল সেই অভিজ্ঞতা থেকে বঙ্গবন্ধু ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শকে সাংবিধানিক কাঠামোয় উপস্থাপন করেছিলেন।
তাছাড়া কলকাতার শিক্ষাজীবনে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা প্রতিরোধে তার ভূমিকার কথা আমরা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে পড়েছি। আর আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর সেই দলের নীতিনির্ধারকের দায়িত্ব পেয়ে ধর্মবর্ণনির্বিশেষ মানুষের রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম হিসেবে গণ্য করার জন্য আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকা ‘মুসলিম’ শব্দটি বর্জন করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
অপরদিকে ১৯৭২ সালের ৪ অক্টোবর খসড়া সংবিধানের ওপর আলোচনার জন্য আয়োজিত সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু নির্ভীক কণ্ঠে ঘোষণা করেন- ‘ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্ম-কর্ম করার স্ব-স্ব অধিকার অব্যাহত থাকবে। ...ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা চলবে না। যদি কেউ বলে যে, ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়েছে, আমি বলব, ধর্মীয় অধিকার রক্ষা করার ব্যবস্থা করা হয়েছে।’
১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’ গঠিত হয় এবং জেলে থাকা অবস্থায় শেখ মুজিবুর রহমান এ দলের যুগ্ম-সম্পাদক নির্বাচিত হন। জুলাই মাসের শেষের দিকে তিনি মুক্তিলাভ করেন। এরপর ১৯৫৩ সালের ৯ জুলাই দলের কাউন্সিলে বঙ্গবন্ধু সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫৫ সালের ২১ অক্টোবর কাউন্সিল অধিবেশনে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তিনি দলের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি প্রত্যাহারের প্রস্তাব পেশ করলে আওয়ামী লীগ অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়। ওই কাউন্সিল অধিবেশনে তিনি পুনরায় সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
১৯৫৭ সালের ৭ ও ৮ ফেব্রুয়ারিতে আওয়ামী লীগ কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয় কাগমারিতে এবং একইসঙ্গে অনুষ্ঠিত হয় এক বিশাল সাংস্কৃতিক সম্মেলন। ৩০ মে দলে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, একই ব্যক্তি এক সঙ্গে সরকার ও সংগঠনের দুটো পদে থাকতে পারবেন না। শেখ মুজিব দলকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন।
অপরদিকে মওলানা ভাসানী পদত্যাগ করায় ১৯৬৪ সালে মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ ও শেখ মুজিবুর রহমান যথাক্রমে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ছয় দফা উপস্থাপনের বছর ১৯৬৬ সালের ১৮ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। এর পর তিনি ছয় দফার পক্ষে জনমত সৃষ্টির উদ্দেশ্যে সারা পূর্ব বাংলায় গণসংযোগ সফর শুরু করেন। ১৯৭০ সালের ৬ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পুনরায় আওয়ামী লীগ সভাপতি নির্বাচিত হন।
৭ ডিসেম্বর সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। আওয়ামী লীগ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে জাতীয় পরিষদের মহিলাসহ ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন এবং প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৮৮টি আসনে জয়লাভ করে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করলেও ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন হলে তিনি রাষ্ট্রপতির দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।
২৪ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে জাতীয় দল ‘বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ’ গঠন করেন। বঙ্গবন্ধু জাতীয় দলের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের জন্মলগ্ন থেকে বাকশাল গঠন পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু নিজের ওপর অর্পিত দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে এদেশের মানুষের জীবনে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছিলেন। এর মধ্যে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ছিল বিশ্ববাসীর কাছে বিস্ময়। আরও বিস্ময় ছিল দল হিসেবে আওয়ামী লীগের ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চার ইতিহাসের ঔজ্জ্বল্য।
একইভাবে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হয়ে ১৯৮১ সালের ১৭ মে স্বদেশ প্রত্যার্বতনের পর দীর্ঘ ৪০ বছর দলের দায়িত্বে থেকে শেখ হাসিনা এদেশকে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় ও উন্নয়নের ধারায় উন্নত রাষ্ট্রের মহিমা অর্জনে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। আওয়ামী লীগের ইতিহাস যেমন বাংলাদেশের ইতিহাস তেমনি আওয়ামী লীগের ইতিহাস বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনা যুগের ধর্মনিরপেক্ষতা এবং উন্নয়ন ও অগ্রগতির ইতিহাস।
মূলত জাতির পিতার যোগ্য উত্তরসূরি শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে দেশকে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন। কেবল নির্বাচনি ইশতেহার ঘোষণা কিংবা ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের সময় নয়; শেখ হাসিনা যেকোনো দলীয় সভায় বলে থাকেন, এদেশ সবার।
দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ কখনই ধর্মের বিভাজনে বিশ্বাস করে না। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ যেন নিজেরাই নিজেদের অবহেলিত মনে না করেন, সে ব্যাপারে সচেতন থাকতে বলেছেন তিনি। এদিক থেকে বঙ্গবন্ধুর মতো তিনিও আওয়ামী লীগের ভেতর ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চায় বিশ্বাসী। কারণ বিষয়টি সংবিধানেও পরিষ্কারভাবে উপস্থাপিত হয়েছে।
লেখক: অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, নির্বাহী কমিটির সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদশ।