সংগ্রামকে ধারণ করে মুক্তির প্রয়াসে ঐতিহাসিক এক সন্ধিক্ষণে পৌঁছায় শত বছরের নিষ্পেষিত বাঙালি জাতি৷ দিনটি ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন পুরান ঢাকার টিকাটুলির কে এম দাস লেনের রোজ গার্ডেন, ক্ষমতাসীন অগণতান্ত্রিক মুসলিম লীগকে প্রত্যাখ্যান করে জন্ম নেয় ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’। কেক কেটে নয় বরং গণমানুষকে শোষণ থেকে মুক্তির অঙ্গীকার নিয়েই যাত্রা শুরু বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরোনো ও ঐতিহাসিক এই বৃহৎ গণসংগঠন।
নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে পথচলা, বাংলাদেশকে স্বাধীনতার প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ করা, মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশকেন্দ্রিক চেতনার দূরদর্শী বাস্তবায়নে যে দলটি সর্বদা অগ্রগামী ছিল তা হলো এখনকার বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। ১৯৭৫-এর কালো অধ্যায়ের পর এই সংগঠনকে টুকরো টুকরো করে ফেলার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়েও সফল হতে পারেনি স্বার্থানেষী শাসকবর্গ৷
মানুষের ভালোবাসা ও ভালো লাগায় টিকে ছিল এই সংগঠন। এই সংগঠন দমে যায়নি, ফিরেছে পাহাড়ের মতো শক্ত হয়ে, গণমানুষের স্বপ্ন পূরণের অঙ্গীকার বাস্তবায়নের স্বপ্ন নিয়ে। ধারাবাহিকতাময় সেই পথচলা আজও বহমান৷ যদিও সামনে দীর্ঘপথ!
জন্মলগ্ন থেকেই ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের অবৈধ, বেপরোয়া কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় আওয়ামী মুসলিম লীগ৷ এরপর ভাষা আন্দোলন, ৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগকে ধরাশায়ী করে পাকিস্তানের রাজনৈতিক অঙ্গনে এক প্রকার নতুন মোড়ের জন্ম দেয় সংগঠনটি।
যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে ৩০৯ আসনের বিপরীতে ২২৩টিতে জিতে সাংগঠনিক দৃঢ়তা এবং জনগণের ভালোবাসার প্রমাণ পায় দলটি। স্বভাবতই সব ধর্ম-বর্ণ বা গোত্রের মানুষের কাছে এক আশ্রয়স্থল হয়ে ওঠে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ।
ফলে, ১৯৫৫ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে নামকরণ করা হয় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ। পরবর্তী সময়ে এই অসাম্প্রদায়িক মনোভাব ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পথে জোগায় নিরন্তর প্রেরণা।
ধারাবাহিক এই প্রবহমান সংগ্রামের ফলে যোগ্য নেতৃত্বের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়৷ স্বভাবতই গণমানুষের প্রত্যাশা ও ভালোবাসায় বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠতে থাকেন বাঙালির একজন অবিসংবাদিত নেতা৷ পরের অধ্যায়টা শুধুই তাই বঙ্গবন্ধুময় এবং আওয়ামী লীগময়৷ যার পিছনে শক্তি হিসেবে ছিল আপামর জনতার ঐক্যবদ্ধ অংশগ্রহণ, জীবন বিলিয়ে দেয়ার মতো প্রতিশ্রুতি।
বঙ্গবন্ধু দূরদর্শীতায়, নিপুণতায় ছিলেন বরাবর যোগ্য, সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নেয়ার মতো রাজনৈতিক দক্ষতা ছিল তার অস্তিত্বের বড় উদাহরণ। বঙ্গবন্ধু ১৯৬৬ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি নানা ঘটনা প্রবাহের পর ঘোষণা করেন ঐতিহাসিক ৬ দফা৷ যাকে বাঙালির মুক্তির সনদ হিসেবে অভিহিত করা হয়৷ বাঙালির বঞ্চিত ও অপ্রাপ্ত অধিকারগুলো আদায়ের লক্ষ্যে একটি সামগ্রিক পদক্ষেপ ছিল ৬ দফা।
সব অবস্থা এবং কোন কোন খাতে কী পদক্ষেপ দরকার তা উল্লেখ ছিল সুস্পষ্টভাবে।
সরকার ব্যবস্থা, মুদ্রাব্যবস্থা, কেন্দ্র সরকার ও অঙ্গরাজ্যগুলোর মধ্যে ক্ষমতার সম্পর্ক এমনকি অঙ্গরাজ্যেগুলোর সুদৃঢ় নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য প্যারা মিলিশিয়া বা আধা-সামরিক বাহিনী গড়ে তোলার দাবিও ছিল ছয় দফার অন্তর্ভুক্ত।
যা বাঙালিকে অধিকার আদায়ের প্রেরণা জুগিয়েছে পাশাপাশি স্বপ্ন দেখিয়েছে স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেবার পথে অগ্রসর হতে। ছয় দফার ফলে স্বাধীনতা সংগ্রামের পরবর্তী ঘটনা প্রবাহের জন্ম হয়েছে। ছয় দফা মানতে নারাজ হওয়াতেই পাকিস্তান সরকার বাধ্য হয় মুখ থুবড়ে পড়তে এমনটা বললে বাড়িয়ে বলা হবে না।।
কেননা, ছয় দফা স্বাধীনতা সংগ্রাম বা বাঙালির মুক্তির লড়াইয়ে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দুঃসাহসিক এই সিদ্ধান্ত বাঙালির জাত চেনানোর পথের বিরাট মাইলফলক। হয়তোবা ছয় দফার মতো সময়োপযোগী রচনা জাতির পিতার ভাবনায় না এলে সৃষ্টি হতো না বাংলাদেশ৷ তাই ছয় দফা বাঙালির রাজনৈতিক মুক্তির ইতিহাসে এক অসামান্য তথা অনন্য দলিল। অতঃপর, আগরতলা মামলা, ১৯৭০-এর নির্বাচনে ক্ষমতা হস্তান্তর না করেও গদি রক্ষা করতে পারেনি পাকিস্তানি সরকার।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসামান্য রাজনৈতিক দূরদর্শিতা, বাঙালির স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে মুক্তি লাভের প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয় সশস্ত্র সংগ্রাম৷ সেই সংগ্রামের পথপরিক্রমাকে বেগবান করতে বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ দেন৷ বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ার সরাসরি নির্দেশ দেন তিনি৷ ৭ মার্চে সরাসরি স্বাধীনতা না ঘোষণা করে বঙ্গবন্ধু দেখান তার দৃঢ়তা বা দক্ষতা কতটা সুপার ক্লাসিক্যাল
কেননা, বঙ্গবন্ধু জানতেন এতে করে পাকিস্তানি সরকার বিশ্বের বুকে তাকে বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা হিসেবে অভিহিত করবেন। কোনোভাবেই বঙ্গবন্ধু এটি চাননি কেননা, তিনি ভালো করেই জানতেন এ রকম হুট করে নেয়া সিদ্ধান্তে থমকে যেতে পারে বাঙালির মুক্তির যাত্রা।
২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার পর পাকিস্তানের রাজনৈতিক অঙ্গন মোড় নেয় নতুন দিকে। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা দেয়ার কারণে গ্রেপ্তার হন৷ তার দেখানো পথে ঝাঁপ দিতে বাঙালি বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেনি বরং লড়েছে আপন মহিমায়৷ আওয়ামী লীগের অন্য নেতারা বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথে আস্থা রেখে শুরু করে দেয় অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক সংগ্রাম৷
মুজিবনগর সরকার এই দুইয়ের সমন্বয় সাধনের জন্য ছিল এক বিরাট স্তম্ভ।
ভারতীয় সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের তৎকালীন বাস্তবতা তুলে ধরতে তারা অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। যুবকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয় মুজিবনগর সরকারের ব্যবস্থাপনায়। পরবর্তী সময়ে তারা বাংলাদেশের মাটিতে এসে যুদ্ধ ঝাঁপিয়ে পড়েন। দল হিসেবে এক্ষেত্রে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরাসরি সামনে থেকে নেতৃত্ব নেয়।
অনেক রক্তের বিনিময়ে অবশেষে বাংলাদেশ। তারপর অনেক উত্থান-পতন।
পৌরাণিক ফিনিক্সের মতো অপরাজিত জননেত্রী শেখ হাসিনা বদলাতে থাকেন বাংলার সার্বিক দৃশ্যপট৷ সর্বপ্রথম দেশকে কলঙ্কমুক্ত করার প্রয়াস থেকে যুদ্ধাপরাধী, মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি করান, পিতা মুজিবের খুনিদের বিচার হয় বাংলার মাটিতে।
শিক্ষা খাতকে আগামীদিনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার প্রধান হাতিয়ার ধরে প্রাথমিক শিক্ষাকে করা হয় শতভাগ অবৈতনিক এবং উপবৃত্তির হার করা হয় শতভাগ।
ইউনেস্কোর মতে, বাংলাদেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যতজন শিক্ষার্থী রয়েছে পৃথিবীর অধিকাংশ দেশের জনসংখ্যা তার চেয়ে কম। যুগোপযোগী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আইটি সেক্টরকে আনা হয়েছে বিশেষ প্রণোদনার আওতায়৷ আজ সবার ঘরে মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট সংযোগ এবং উচ্চগতির পরিষেবা নিশ্চিত করা হয়েছে।
পাশাপাশি জনগণের মৌলিক চাহিদার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকল ক্ষেত্রই পাচ্ছে বিশেষ গুরুত্ব। শক্ত অর্থনৈতিক কাঠামো, সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত জননেত্রী যে পিতা মুজিবের আদর্শিক ধারাবাহিকতা রক্তে ধারণ করেন তা প্রতিনিয়তই স্পষ্ট হচ্ছে বাংলাদেশের অগ্রগতির সূচক বা বাস্তব চিত্রগুলোর মাধ্যমে।
এমনকি করোনাকালীন দুঃসময়ে ও বাংলাদেশের কোনো মানুষ খাদ্যর অভাবে মৃত্যুর মুখোমুখি হয়নি। আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনগুলো সর্বদা থেকেছে মানুষের পাশে, মানবিকতা বোধে উদ্ভাসিত হয়ে। দুরাবস্থা সৃষ্টি না হওয়ার বড় কারণ খাদ্য ভাণ্ডার ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ চোখ ধাঁধানো। পাশাপাশি মানুষের দুর্দশা লাঘবে বাস্তবায়ন করা হয়েছে নানা প্রনোদনা প্যাকেজের। ফলে মাথাপিছু আয়ে বাংলাদেশ সাম্প্রতিককালে ভারতে কেউ পিছনে ফেলেছে৷ মৌলিক চাহিদা কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের মতো পূরণ করার পাশাপাশি অবকাঠামো খাতে শেখ হাসিনা দিয়েছেন বিশেষ নজর৷
প্রবহমান পদ্মার বুকে নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত সেতু প্রমাণ করে বাংলাদেশ আজ ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ নয় বরং আগামী দিনের এক শক্তি।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশকে মানা হয় দক্ষিণ এশিয়ার ইমারজিং টাইগার হিসেবে৷ যার পিছনে নিঃসন্দেহে রয়েছে শেখ হাসিনার সদূরপ্রসারী নেতৃত্ব এবং জনগণের আকুণ্ঠ সমর্থন।
দেশ, জাতির উন্নয়ন, অগ্রযাত্রায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে জননেত্রী শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ এটা দেশের বেশিরভাগ মানুষ বিশ্বাস করে। তবে, খুব ভালোর মাঝে একটু হলেও যেন থাকে নেতিবাচকতার ছোঁয়া। অর্থলোভী, সুযোগ সন্ধানীরা থাকে অপেক্ষায় নিজ আখের গোছানোর প্রয়োজনে।
ক্ষমতাকালীন সবচেয়ে দুরাবস্থা আওয়ামী লীগের জন্য অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব। তৃণমূল থেকে শুরু করে প্রায় সবখানেই এ নেতিবাচকতা বিরাজমান। সহযোগী সংগঠনগুলোতেও ছড়িয়ে পড়েছে এ দুরাবস্থার ছাপ। কারণ হিসেবে বলা যায়, হাজারো সুসময়ের কোকিল নিজের স্বার্থে যোগ দিয়েছে বাংলাদেশ বির্নিমাণের সাংগঠনিক কারিগর আওয়ামী লীগের পতাকাতলে।
এসব অনুপ্রবেশকারীরা সুকৌশলে তৈরি করছে ‘মাই ম্যান সংস্কৃতি’। সাংগঠনিক কমিটিগুলোতে অপেশাদার, সাংগঠনিক নিয়ম-শৃঙ্খলা বহির্ভূত কাজে জড়িত লোকজনকে স্থান দেয়া হচ্ছে। যারা প্রতিনিয়ত অনৈতিক কাজ করে চলছে এবং প্রশ্নবিদ্ধ করছে জননেত্রী শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগকে।
এছাড়া, কমিটিগুলোর গতিশীলতা অনেক ক্ষেত্রে থাকছে না। নিয়মিত কমিটি তৈরি করার কথা থাকলেও মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটিগুলোকে দেয়া হচ্ছে পুনরায় অনুমোদন। আমাদের সৌভাগ্য যে জননেত্রী শেখ হাসিনা এসব কাজকর্ম দিনে দিনে কঠোর হাতে দমন করছেন৷ নিজদলের কাউকে ছাড় দেয়া হচ্ছে না অনৈতিকতার প্রশ্নে। যার ফলে ভিন্নধর্মী এক রাজনৈতিক সংস্কৃতি তৈরি হচ্ছে এদেশের মাটিতে। যা আগে কখনও হয়নি।
বাংলাদেশ বিনির্মাণের সাংগঠনিক কারিগর, মুখ থুবড়ে পড়া দেশকে নতুন করে পথ দেখানো এক সময়োপযোগী দিকনির্দেশক বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ। যখনই স্বৈরাচারের দুঃশাসনে অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়েছে এদেশ তখনই আলো দেখিয়েছে আওয়ামী লীগ।
ধারাবাহিক সংগ্রামের এ আদর্শিক যাত্রা অব্যাহত রাখুক লাখো মানুষের ভালোবাসার স্পন্দন জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ। বঙ্গবন্ধু মানেই বাংলাদেশ, আওয়ামী লীগ মানেই পথ দেখানোর শক্তি। এগিয়ে যাক প্রিয় মাতৃভূমি। জন্মলগ্নে অনেক শুভেচ্ছা ও হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা।
লেখক: শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।