রাজধানীর পঙ্গু হাসপাতালের সামনে থেকে বাসে উঠলাম। নামব গুলশান ১ নম্বর গোলচত্বরে। আগে ভাড়া ছিল ২০ টাকা। কন্ডাকটর নিলেন ৩০ টাকা। কারণ ভাড়া বেড়েছে দেড় গুণ। কিন্তু যে যুক্তিতে দেড় গুণ ভাড়া বাড়ানো হয়েছে, সেটি দৃশ্যমান নয়। অর্থাৎ প্রতি সিটে একজন যাত্রী বসবেন, কেউ দাঁড়িয়ে যাবেন না— এমন যুক্তিতে দেড় গুণ ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু প্রতি সিটেই যাত্রী বসেছেন। অনেকে দাঁড়িয়েও যাচ্ছেন। তাহলে ভাড়া কেন দ্বিগুণ? সদুত্তর নেই।
বাস্তবতা হলো, রাজধানীর অনেক রুটেই মানুষের চাহিদার তুলনায় পাবলিক বাসের সংখ্যা কম। ফলে বাসের হেলপাররা যাত্রী তুলতে না চাইলেও বা এক সিটে একজনের বেশি যাত্রী বসাতে না চাইলেও যাত্রীরা সেটি মানতে চান না। কারণ সবারই তাড়া আছে। সময়মতো গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য তারা অনেক সময় হেলপারকে ঠেলেই বাসে উঠে যান।
করোনা কিংবা স্বাস্থ্যবিধি অধিকাংশ যাত্রীর কাছেই মুখ্য নয়। সুতরাং, যাত্রীরাই যেখানে শারীরিক দূরত্ব মানতে চাইছেন না বা এক সিটে একজনের বেশি বসানো যাবে না বা দাঁড়িয়ে লোক নেয়া যাবে না— এই সিদ্ধান্ত কার্যকর রাখা যাচ্ছে না, তখন আর বাড়তি ভাড়া কেন? গণমাধ্যমের খবর বলছে, বেসরকারি কোম্পানিগুলোর পাশাপাশি সরকারি প্রতিষ্ঠান বিআরটিসির বাসেও নিয়মের কোনো বালাই নেই। অর্থাৎ যাত্রী বহন করা হচ্ছে স্বাভাবিক সময়ের মতো। কিন্তু বর্ধিত ভাড়ায়। এ নিয়ে যাত্রীদের সঙ্গে কন্ডাকটরদের বাহাস এখন নিত্য ঘটনায় পরিণত হয়েছে।
আবার শুধু বেসরকারি মালিকানাধীন বাস, লঞ্চ, সিএনজি অটোরিকশা বা লেগুনা-ই নয়, দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও এই নৈরাজ্য থেকে মুক্ত নন।
১৮ জুন নিউজপোর্টাল নিউজবাংলার একটি খবরে বলা হয়েছে, করোনার কারণে দেড় বছর ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন ব্যবস্থা বন্ধ থাকলেও শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নেয়া হচ্ছে পরিবহন ফি। এমনকি বন্ধ হলের ‘সিট ভাড়া’ হিসেবে দুই বছরের ফি জমা দিতেও বলা হয়েছে শিক্ষার্থীদের। গাড়িতে না চড়েও ভাড়া গোনার বিষয় নিয়ে জানতে চাইলে রেগে যান বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক মমতাজ উদ্দীন। তিনি বলেন, ‘বিআরটিসির ভাড়া কে দেবে, তুমি দিবা?’
যদিও কোষাধ্যক্ষের বক্তব্যের সঙ্গে মিল নেই বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন ম্যানেজার আতাউর রহমানের বক্তব্যে। তিনি জানান, বিআরটিসির সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চুক্তি বাস হিসেবে নয়, বরং ট্রিপ হিসেবে। অর্থাৎ যত ট্রিপ বাস চলবে, সে অনুযায়ী টাকা। ট্রিপ না দিলে টাকা নেই। তার মানে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের কারণে যেহেতু বাসের ট্রিপ বন্ধ, সেহেতু শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে পরিবহন ফি আদায় করাটা অন্যায়। টাকার অঙ্ক যা-ই হোক, এটি অন্যায্য এবং বড় পরিসরে দেখলে এটিও একধরনের নৈরাজ্য।
গণপরিবহন নিয়ে প্রতিদিন মানুষের যত অভিযোগ, ক্ষোভ আর সীমাহীন দুর্ভোগের কথা গণমাধ্যমে আসে; যেভাবে প্রশাসনের নাকের ডগায় বসে পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা বেপরোয়া আচরণ করেন, তাতে বোঝাই যায় যে, তাদের শেকড় কত গভীরে। সড়কের নিরাপত্তায় আইন কঠোর করা হলে তারা পুরো দেশ অচল করে দেন।
বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে মানুষ হত্যার অভিযোগে কোনো বাসের চালক গ্রেপ্তার হলে বা তার শাস্তি হলে পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা খোদ রাষ্ট্রকেই চ্যালেঞ্জ করেন। তারা এটা করতে পারেন কারণ তাদের সেই ক্ষমতা রয়েছে অথবা তা দেয়া হয়েছে।
কারণ বিভিন্ন সময়ে এই পরিবহন শ্রমিকদেরই কাজে লাগানোর প্রয়োজন পড়ে। সুতরাং, কোনো একটি গোষ্ঠী কীভাবে ক্ষমতাবান হয় এবং তাদের কেন শক্তিশালী করা হয়— সেই প্রশ্নের উত্তরও আমাদের জানা থাকতে হবে। অন্যথায় গণপরিবহনের নৈরাজ্য নিয়ে কথা বলা বৃথা।
রাজধানীর পাবলিক বাসে অতিরিক্ত ভাড়া এবং যাত্রী হয়রানির বাইরেও এই খাতে নৈরাজ্যের একটি বড় কারণ একই রুটে বিভিন্ন কোম্পানির গাড়ির মধ্যে এমনকি একই রুটে অভিন্ন কোম্পানির গাড়ির মধ্যেও ভয়াবহ প্রতিযোগিতা। ওভারটেকিং শুধু নয়, বরং গাড়ির ভেতরে অনেক যাত্রী থাকা সত্ত্বেও দ্রুতগতিতে গিয়ে সচেতনভাবে অন্য বাসের পাশে লাগিয়ে দেয়া; ঝরঝর করে জানালার কাচ ভেঙে পড়ার মতো দৃশ্যও এখন নিয়মিত।
চালকরা যখন এ রকম রেসে নামেন, তখন তাদের বিবেচনায় হয়তো একটিবারের জন্যও এটি আসে না যে, গাড়ির ভেতরে বসে বা দাঁড়িয়ে অন্তত ৫০ জন মানুষ, যাদের মধ্যে বৃদ্ধ, নারী, শিশু এমনকি অসুস্থ মানুষও থাকতে পারেন। এই ঘটনাগুলো যে মানুষের মধ্যে একধরনের ট্রমার জন্ম দিতে পারে, জানালার কাচ ভেঙে যে মানুষ গুরুতরভাবে আহত হতে পারে, সেই বিবেচনাবোধটুকুও তাদের মধ্যে কাজ করে না।
প্রশ্ন হলো, অনেক সংগঠন যাত্রী নিরাপত্তার কথা বলে বিভিন্ন মানববন্ধন বা আন্দোলন-সংগ্রাম অথবা সংবাদ সম্মেলন করলেও গণপরিবহনের শ্রমিকদের তারা কি কখনও মানবিক করার উদ্যোগ নিয়েছে? তারা কি কখনও চালকদের এই বার্তাটি দিয়েছে যে, আপনার সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করছে গাড়ির ভেতরে থাকা এতগুলো মানুষের জীবন?
আপনি যদি অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নামেন, তাহলে এতগুলো লোকের প্রাণসংহার হতে পারে? আপনার কোনো বন্ধু বা আত্মীয়ই হয়তো অন্য কোনো গাড়িতে থাকতে পারেন এবং এ রকম অসুস্থ প্রতিযোগিতার কারণে তিনিও নিহত বা আহত হতে পারেন? রাষ্ট্র কি কখনও এই চালক-হেলপার বা সুপারভাইজারদের মোটিভেট করার উদ্যোগ নিয়েছে? কোটি কোটি টাকা খরচ করে ফ্লাইওভার, চার লেন, আট লেনের সড়ক নির্মাণে রাষ্ট্রের যত আগ্রহ, তার সিকিভাগও কি গণপরিবহনের চালকদের মানবিক করার কাজে আছে?
অনুসন্ধানে দেখা যাবে, সড়কে মৃত্যুর যে মিছিল এর পেছনে প্রধানত দায়ী চালকদের অসুস্থ প্রতিযোগিতা এবং সেই প্রতিযোগিতার কারণে তাদের মধ্যে ক্রিয়াশীল অমানবিকতা। কেন তাদেরকে অন্য বাসের সঙ্গে এ রকম প্রতিযোগিতায় নামতে হয়; কেন তাদের জন্য মাসিক বেতন নির্ধারণ করা যায় না; কেন মালিকদের সঙ্গে তাদের সম্পর্কটি আস্থা ও বিশ্বাসের ওপরে দাঁড়ায় না— এসব প্রশ্নের সদুত্তর পাওয়া না গেলে গণপরিবহনের নৈরাজ্য নিয়ে কথা বলা বৃথা।
সড়কপথে চাঁদাবাজিরও ভিকটিম সাধারণ মানুষ। কারণ বাসমালিক-শ্রমিকদের ঘাটে ঘাটে চাঁদা দিতে হয়। সেই চাঁদার টাকা তারা যাত্রীদের মাধ্যমেই উশুল করেন। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, তখন সেই দলের নেতারাই মূলত পরিবহন খাতের চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করে। তবে অনেক সময় শোনা যায়, পরিবহন খাতের চাঁদার ভাগবাঁটোয়ারা শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও ক্ষমতাসীন দলের নেতা ও চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের মধ্যেই নয়, বরং অন্য অনেক দলের মধ্যেও বণ্টন করা হয়। অর্থাৎ এখানে একটি সর্বজনীন ঐক্য রয়েছে।
কারা এই চাঁদাবাজি করে? গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, একশ্রেণির পরিবহনশ্রমিক, চিহ্নিত সন্ত্রাসী, পুলিশ ও ক্ষমতাসীন মহলের আশীর্বাদপুষ্টদের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে এই চক্র। এতদিন পরিবহন সেক্টরে গাড়ির মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের নামে সিংহভাগ চাঁদাবাজি হলেও এখন সড়ক, মহাসড়ক, টার্মিনাল ও স্ট্যান্ডে নানা নামে বিভিন্ন সন্ত্রাসী গ্রুপও প্রকাশ্যে চাঁদাবাজি করছে। এ ছাড়া হাইওয়ে পুলিশ, ট্রাফিক বিভাগ ও থানা পুলিশের একাংশও চাঁদাবাজিতে জড়িত বলে অভিযোগ আছে।
সড়কপথে সবচেয়ে বেশি চাঁদাবাজির শিকার হয় পণ্যবাহী ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান। ফসলের দাম কৃষকের পর্যায় থেকে খুচরা বাজার পর্যন্ত যে কয়েক গুণ বেড়ে যায়, তারও মূল কারণ এই চাঁদাবাজি। কারণ যে পটল কৃষকের কাছ থেকে কেনা হয়েছে ১০ টাকা কেজি, খুচরা বাজারে গিয়ে তার দাম ৪০ থেকে ৫০ টাকা। মাঝখানের এই ৩০ থেকে ৪০ টাকা মূলত চাঁদা এবং অন্যান্য খরচ। তার মানে সড়ক পরিবহনে এই চাঁদাবাজি না থাকলে নিত্যপণ্যের দাম অনেক কম হতো।
গণপরিবহনে নৈরাজ্য ও অমানবিকতার আরেকটি বড় অনুষঙ্গ সিটিং সার্ভিস এবং মহিলা সিট—যার প্রধান ভিকটিম নারীরা। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় দেখা যাবে, সকালে এবং সন্ধ্যায় কাঙ্ক্ষিত বাসে উঠতে নারীদের দীর্ঘ সময়ের অপেক্ষা। মহিলা সিট নামে যে কটি আসন নির্ধারিত, অনেক সময় তাও খালি থাকে না। পুরুষেরাই বসে থাকেন। অনেক পুরুষ অন্য যাত্রীদের দ্বারা ভর্ৎসনার শিকার হলেও মহিলা সিটে নির্লজ্জের মতো বসে থাকেন।
বরং পাল্টা প্রশ্ন করেন, পুরুষের সিটে কেন নারীরা বসেন? আবার মহিলা সিট নামে যে অত্যন্ত অসম্মানজনক আসনগুলো রাখা হয় চালকের বাঁ পাশে একটি বেঞ্চের মতো জায়গায়, এর সামনেই থাকে ইঞ্জিন এবং ইঞ্জিন থেকে অনবরত বের হতে থাকে গরম বাষ্প। ফলে নারীদের শুধু বাসে ওঠা কিংবা আসন খালি থাকাই নয়, বরং মহিলা সিট নামে এই অদ্ভুত আইডিয়াটি এত বছর পরেও কীভাবে টিকে আছে, তা নিয়েও প্রশ্ন তোলা দরকার।
নারী-শিশু-বৃদ্ধ এবং প্রতিবন্ধী মানুষদের জন্য গণপরিবহনে কিছু আসন নির্ধারিত রাখাটাই যৌক্তিক— কিন্তু সেই আসনগুলো ইঞ্জিনের পাশে যেখান থেকে গরম বাষ্প বের হয়, সেখানে একটা বেঞ্চি তৈরি করে কেন বানাতে হবে এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এসে আমরা যখন নানা সূচকে নারীর অগ্রযাত্রার গল্প বলি, তখন কী করে এরকম একটি অসম্মানজনক ব্যবস্থা টিকে থাকে— সেই প্রশ্নটি এখন শুধু পরিবহন মালিকদের কাছেই নয়, বরং রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের কাছেও করার সময় এসেছে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক