পত্রিকার পাতা খুললেই চোখে পড়ে কিশোর অপরাধের নানান খবর। সেভেন স্টার, ফাইভ স্টার, মাফিয়া গ্যাং, রক কিং গ্যাং, ০০৭, রবিনহুড, মাইরালা, কোপায়া দে, ভালগার গ্রুপ, ডিসকো বয়েস, বিগবস- নানান বাহারি নামের গ্যাং। এগুলো নিছক নাম নয়, ভয়ংকর সব গ্রুপ। এসব গ্রুপের সদস্যরা বেশিরভাগেরই বয়স ১২ থেকে ১৮।
ইভটিজিং, মাদক ব্যবহার, মাদক ব্যবসা, ছিনতাই, অপহরণ, ধর্ষণ, এমনকি খুন- সব ধরনের অপরাধেই এরা জড়িয়ে যাচ্ছে। পুলিশের তালিকা অনুযায়ী রাজধানীতে এখন ৭৮টি কিশোর গ্যাং সক্রিয় রয়েছে, যার সদস্য সংখ্যা দুই হাজারেরও বেশি।
আর সারা দেশে কিশোর গ্যাংয়ের তালিকা হিসাব করলে সংখ্যাটা ভয়ংকর হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশের এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের নাম এই কিশোর গ্যাং। কারণ কিশোর অপরাধীদের দমন করার জন্য আইনের স্বাভাবিক প্রয়োগ করা যায় না।
মানুষের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা সৃষ্টির আদিকাল থেকেই আছে। কিশোর অপরাধ আগেও ছিল, এখনও আছে, চেষ্টা করলে হয়ত কমানো যাবে, তবে ভবিষ্যতেও কিশোর অপরাধ থাকবে। বাংলাদেশে নতুন করে কিশোর অপরাধ বিষয়টি আলোচনায় আসে ২০১৭ সালে উত্তরায় আদনান হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে। আর ২০১৯ সালে বরগুনায় নয়ন বন্ডের নেতৃত্বাধীন ০০৭ গ্যাং প্রকাশ্যে কুপিয়ে রিফাত শরীফকে হত্যার পর কিশোর অপরাধ নিয়ে নতুন করে ভাবনা শুরু হয়। ইদানীং আবার কিশোর অপরাধের প্রবণতা বেড়েছে।
‘কিশোর’ শব্দটির সঙ্গে ‘অপরাধ’ শব্দটি জুড়ে দিতে গিয়ে আমার নিজেকেই অপরাধী মনে হচ্ছে। শিশুরা তো পৃথিবীতে আসে নিষ্পাপ হিসেবে। তারপর তারা আস্তে আস্তে বেড়ে ওঠে। কেউ আস্তে আস্তে অপরাধে জড়ায়। কিন্তু অন্তত ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত তো তাদের পরিবারের কঠোর অনুশাসনে থাকার কথা। তাহলে তারা কীভাবে অপরাধী হয়ে ওঠে?
একদিনে নিশ্চয়ই তারা খুনি হয়ে যায় না। প্রথমে সিগারেট, তারপর মাদক, তারপর ইভটিজিং, তারপর ছিনতাই- এভাবে ধীরে ধীরে হাত পাকিয়ে তারা বড় অপরাধী হয়ে ওঠে। কিন্তু অপরাধী হয়ে ওঠার এই প্রক্রিয়াটার সময় তার চারপাশের লোকজন কোথায় থাকে? আমার বয়স এখন ৫২।
এখনও আমি কিছু বলতে গেলে বা ফেসবুকে লিখতে গেলে সাবধান থাকি, মুরব্বি কেউ দেখে ফেললো না তো! এখনও গ্রামে গেলে বন্ধুবান্ধবদের পাল্লায় পড়ে কালেভদ্রে সিগারেট খেলে তাই লুকিয়ে খাই। তাহলে এই হাজার হাজার কিশোর অপরাধী হয়ে গেল কীভাবে? তাদের বাবা-মা, বড় ভাই, মুরব্বি বলে কি কেউ নেই? একটি শিশুকে পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার প্রথম দায়িত্ব তার পরিবারের, তারপর সমাজের, তারপর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের, তারপর রাষ্ট্রের। প্রথম কেউ দায়িত্ব পালন না করে পুরো দায় রাষ্ট্রের কাঁধে চাপিয়ে দিলে তো কাজ হবে না।
কদিন আগে একটি কিশোর গ্যাংয়ের পাঁচ সদস্যকে আটক করার পর একটি পত্রিকার পক্ষ থেকে তাদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। সবার পরিবারেরই দাবি, তার ছেলে এমন কাজ করতেই পারে না। এই যে অস্বীকার প্রবণতা, এটাতেই মূল সমস্যা।
আপনার সন্তানকে দেখে রাখার প্রথম দায়িত্ব কিন্তু আপনারই। বাংলাদেশের কিশোর অপরাধীদের বেশিরভাগই নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান। সামাজিক অবস্থানের কারণে নিম্নবিত্ত পরিবারের সদস্যদের মধ্যে এক ধরনের বঞ্চনার বোধ তৈরি হতে পারে। কিন্তু সমাজে বৈষম্য আছে, থাকবে। বঞ্চনার শোধ তো অপরাধ দিয়ে হতে পারে না। তবে সব কিশোর অপরাধী তো নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান নয়।
মধ্যবিত্ত, মধ্য উচ্চ মধ্যবিত্ত, এমনকি উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানরাও অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের অনেকের মোটর সাইকেল, এমনকি গাড়িও রয়েছে। মোটর সাইকেল বা গাড়ি তো নিম্নবিত্তের পরিবারের কারো পক্ষে কেনা সম্ভব নয়। তাহলে কোনো বাবা-মা তার ১৮ বছরের নিচের সন্তানকে গাড়ি বা মোটর সাইকেল কিনে দিয়েছেন এবং তা অবাধে ব্যবহার করে অপরাধ করার সুযোগ দিয়েছেন!
বাবা-মা দুজনেই চাকরি করেন, এমন পরিবার তাদের সন্তানকে নিজেদের অনুপস্থিতির দায় অর্থ দিয়ে পুষিয়ে দিতে চান। কিন্তু আমাদের বুঝতে হবে ভালোবাসার অভাব অর্থ দিয়ে পূরণ করা যায় না। অনেক সময় বাবা-মার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলে সেই পরিবারের সন্তান উচ্ছন্নে যেতে পারে। ছাড়াছাড়ি হলেও বাবা বা মা কাউকে না কাউকে তো সন্তানের দায়িত্ব নিতেই হবে।
১৩ থেকে ১৮ এই বয়সটা খুব বিপজ্জনক। ইংরেজিতে যেটাকে টিনএজ বলে, বাংলায় বলে বয়ঃসন্ধি। এই সময়টা শিশু-কিশোররা স্বপ্নের জগতে বাস করে। তারা অ্যাডভেঞ্চার ভালোবাসে। অনেকসময় শুধু অ্যাডভেঞ্চারের লোভে তারা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। তাই এই সময়টা তাদের প্রতি বাড়তি মনোযোগ দিতে হবে। বাড়তি তো দূরের কথা, আমরা আসলে তাদের প্রতি কোনো মনোযোগই দেই না। আসলে বয়ঃসন্ধিকালটা বিপজ্জনক। এই সময়টা কিশোরররা কিছু না কিছু করার জন্য তড়পাতে থাকে।
সমস্যা হলো এখন আমাদের কিশোরদের সামনে কোনো লক্ষ্য নেই, কোনো রাজনীতি নেই, কোনো সংস্কৃতি নেই। তাই তড়পাতে থাকা কিশোররা হয় জঙ্গি, নয় জড়িয়ে পড়ে অপরাধে। কিছু না কিছু করার জন্য তড়পাতে থাকা কিশোরদের সামনে ভালো কোনো লক্ষ্য দিতে হবে। পারিবারিক মূল্যবোধ, সামাজিক মূল্যবোধ, ধর্মীয় মূল্যবোধকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে হবে। নানারকম সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বা খেলাধুলায় তাদের ব্যস্ত রাখতে হবে। সারাক্ষণ কম্পিউটারে ব্যস্ত থাকলে তারা কোনো না কোনো ফাঁদে পড়ে যেতে পারে।
পরিবার যখন ব্যর্থ হয়, সমাজ যখন ব্যর্থ হয়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যখন ব্যর্থ হয়; তখন দায় চাপে রাষ্ট্রের কাঁধে। কেউ যখন অপরাধী হয়েই যায়, তখন পুলিশের কাজ তাদের আইনের হাতে তুলে দেয়া। কিন্তু কিশোর অপরাধীদের সঙ্গে পুলিশ সাধারণ অপরাধীদের মতো আচরণ করতে পারে না, পারা উচিতও নয়।
কিশোর অপরাধীরা অপরাধ করে বড়দের মতো, কিন্তু তাদের সঙ্গে আচরণ করতে হয় কিশোরদের মতো। তাদের হাতকড়া পরানো যায় না। সাজা হলেও তাদের সাধারণ কারাগারে না রেখে কিশোর সংশোধনাগারে রাখতে হয়। বাংলাদেশে কিশোর সংশোধনাগার আছে তিনটি, এর মধ্যে একটি কিশোরীদের জন্য। কিন্তু এই সংশোধনাগারের পরিবেশ এতই বাজে সেখানে সংশোধনের কোনো সুযোগ নেই। বরং তারা সেখানে কিশোর অপরাধী হিসেবে ঢুকে পাকা অপরাধী হিসেবে বের হয়।
একজন শিশু বা কিশোর যখন অপরাধী হয়, তখন আমি আসলে তাদের অপরাধ দেখি না। আমি দেখি আমাদের দায়, আমাদের সবার দায়। যে শিশু, যে কিশোর জাতির ভবিষ্যৎ, তাকে কেন আমরা অপরাধী হতে দিলাম? সে হয়তো না বুঝে বয়সের আবেগে, অ্যাডভেঞ্চারের লোভে শুরুতে একটা ছোট অপরাধ করেছে। আমরা নজর দেইনি বলে সে অপরাধে জড়িয়েছে। কিশোরদের অপরাধে জড়ানো আমাদের জাতীয় ক্ষতি।
তার যে আগ্রহ, উত্তেজনা সেটা যদি সমাজ বদলানোর কাজে ব্যবহার করা যেত, সামাজিক কাজে, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে, খেলাধুলায় তাদের ব্যস্ত রাখা যেত; তাহলে জাতির লাভ হতো। বড়দের সময় না থাকার দায় ছোটদের ঘাড়ে চাপিয়ে তাদের অপরাধী বানালে সমস্যার সমাধান হবে না। নিজের স্বার্থে, জাতির স্বার্খে; আমার সন্তানকে আমারই দেখে রাখতে হবে; সে যেন জাতির সম্পদ হয়, অপরাধী না হয়।
লেখক: সাংবাদিক, কলাম লেখক