এই কিছুদিন আগের ঘটনা, যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসের একটি বাড়ি থেকে ছয় বাংলাদেশির লাশ উদ্ধার করার কথা জেনে অনেকেই স্তব্ধ হয়ে যায়। ‘বিষণ্নতা থেকেই’ পরিবারটির দুই ভাই তাদের মা-বাবা, নানি ও একমাত্র বোনকে হত্যার পর নিজেরাও আত্মহত্যা করেছে বলে পুলিশের ধারণা। ১৯ বছরের যমজ দুই ভাই পরিকল্পনা করে পরিবারের সবাইকে হত্যা করেন।
আমাদের রাজধানীর কদমতলীতে মা-বাবা ও বোনকে হত্যার দায় স্বীকার করেছেন পরিবারটির আরেক মেয়ে মেহজাবিন ইসলাম। ৯৯৯-এ ফোন করে মেহজাবিন বলেন, ‘তিনজনকে খুন করেছি। এখনই পুলিশ পাঠান।
‘যদি পুলিশ না আসে, তবে আরও দুজনকে খুন করব।’ পুলিশ জানায়, পরিবারের সদস্যদের প্রতি প্রচণ্ড ক্ষোভ ছিল তার। স্বামী আর মেয়েকেও ঘুমের ওষুধ দিয়ে অচেতন করেছিলেন। যত ঘৃণা বা রাগ থাকুক, পবিবারের সবাইকে হত্যা করা এবং এরপর নিজেই পুলিশকে ফোন করা কোনোভাবেই স্বাভাবিক নয়।
এর আগেও আমরা দেখেছি মা তার সন্তানকে হত্যা করে নিজে আত্মহত্যা করেছেন। বাবা পরিবারের সবাইকে হত্যা করে নিজেও মারা গেছেন। এগুলো অস্বাভাবিক ঘটনা। মানুষ যখন সবাইকে হত্যা করে নিজে ‘মৃত্যুকে বরণ করে’ নেয়ার জন্য তৈরি হয়, তখন ধরেই নিতে হবে, তিনি মানসিকভাবে অসুস্থ বা ভয়াবহ রকমের ডিপ্রেশনের শিকার। পরিবেশ-পরিস্থিতি, মানসিক অসুস্থতা তাকে এমন আসুরিক শক্তি দেয় যে, সে পরিবারের প্রিয় সদস্যদের বিনা দ্বিধায় হত্যা করার মতো জঘন্য অপরাধ ঘটিয়ে ফেলতে পারে।
সম্প্রতি পত্রিকায় অনেক ঘটনা উঠে আসছে, যেখানে কেউ হত্যা করছে এমন সব কাছের মানুষদের, যাদের সঙ্গে তাদের যেকোনো কারণে বিবাদ বাধছে। হত্যা নতুন কিছু নয় এবং মানবসমাজে হত্যা সব সময়ে হয়েছে এবং কমবেশি সব সমাজেই বিদ্যমান। কিন্তু বর্তমানে যেটা বিশেষভাবে চোখে পড়ছে, সেটা হলো তুচ্ছ করণে হত্যাকাণ্ড এবং বিশেষ করে নিকটজনদের হত্যা করা।
কদমতলীর এই হত্যাকাণ্ড মানুষের আকস্মিক ক্ষোভের থেকে ঘটিয়ে ফেলা ঘটনা ছিল না। ছয় মাস আগে থেকে পরিকল্পনা করে এই ত্রয়ী হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে।
পত্রিকায় দেখলাম অভিযুক্ত অপরাধী বলেছে সে ‘ক্রাইম পেট্রোল’ দেখে হত্যা করার এই উপায় বের করেছে। এর মানে হচ্ছে, অপরাধী মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিল যে, সে হত্যা করবে, কিন্তু কীভাবে করবে সেই উপায়টা খুঁজে বের করেছে এই সিরিজ দেখে। অপরাধজগতের ওপর নির্মিত এই সিরিজের অনেক দর্শক। অনেক ভাষায় এর ডাবিং হয়।
অনেকেই বলেন, এই সিরিজ দেখলে বোঝা যায় অপরাধের গতিপ্রকৃতি এবং পুলিশ কতভাবে বা কৌশল করে অপরাধী ধরতে পারে। অথচ আমাদের আলোচ্য অভিযুক্ত অপরাধী তার মনোজগতের অস্থিরতা থেকে হত্যার উপায় অনুসন্ধান করেছেন। কাজেই একটি পরিবারের সন্তান, বাবা-মা, ভাইবোন এমনকি পরিবারে নিযুক্ত সাপোর্ট স্টাফের মন কীভাবে কাজ করছে, সেটাই আমাদের লক্ষ রাখতে হবে।
এই ধরনের কয়েকটি ঘটনা ঘটার পরও আশ্চর্যজনক দিক হচ্ছে বাবা, মা ও বোন হত্যার এই ঘটনার যে ভয়াবহতা, সেটা বোঝার ক্ষমতা যেন আমাদের সমাজ হারিয়ে ফেলেছে। অনেকে এই হত্যাকে জাস্টিফাই করার চেষ্টা করছে এই বলে যে পরকীয়াই এই হত্যাকাণ্ডের কারণ এবং এ কথাও লেখা হচ্ছে যে, ভিকটিমের মা মন্দ নারী ছিল, সে রাজনৈতিক নেতাদের নারী সরবরাহ করত এবং বাবা আরেকটা বিয়ে করেছে।
এত ভয়ংকর হত্যাকাণ্ডের পেছনে এসব কারণ খোঁজা মানে, অপরাধীর মানসিক অবস্থাকে বিচারে না আনা। একই পরিস্থিতিতে ভিন্ন ভিন্ন অপরাধীর দৃষ্টিভঙ্গি, চিন্তা ও আচরণ ভিন্ন রকম হবে। কোনো অপরাধী থাকে সাইকোপ্যাথ, অন্য অপরাধীরা সেটা না-ও হতে পারে।
সমাজে অপরাধ থাকবে, কিছু মানুষ মন্দ কাজ করবে কিন্তু সমাজের শিক্ষিত ও নেতৃত্বে যারা আছেন, তাদের বুঝতে হবে কেন এ ধরনের ঘটনা ঘটেই যাচ্ছে? বাবা-মা, বোন হত্যার পেছনে পরকীয়ার যুক্তি খোঁজার চেষ্টা না করে, অপরাধী কেন এ রকম একটি ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড ঘটাল, সেটা খুঁজে বের করা উচিত। পারিবারিক হিংসা, পারিবারিক বন্ধন নষ্ট হয়ে যাওয়া, উগ্র জীবনযাপন, মাদক-অসৎ সঙ্গ, ভালোবাসাহীনতা নাকি মনোবৈকল্য?
২০১৭ সালের নারায়ণগঞ্জ হত্যাকাণ্ডের রায়ে ফাঁসি ঘোষণা হওয়ার পরও ‘আসামিরা নির্বিকার ও পরিপাটি’ ছিল। খবরের বর্ণনায় বলা হয়েছে, ২৬ আসামির মধ্যে মাত্র দুজন রায় শুনে কেঁদেছেন। বাকিদের চেহারা ছিল ভাবলেশহীন। আদালতকক্ষে আসার সময় তাদের কারও কারও মুখে চাপাহাসিও ছিল। কীভাবে সম্ভব মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়ার পরও মুখে হাসি টেনে রাখা।
এদের সংশ্লিষ্টতার খবর যতই প্রকাশ পাচ্ছিল, ততই মনে হচ্ছিল এরা তো কেউ দাগী অপরাধী, খুনি বা ডাকাত নয়। অপরাধী ধরাই এদের কাজ, অপরাধ করা নয়। তাহলে কীভাবে এতটা পৈশাচিক উপায়ে এই কাজ তারা করল? কোনো মানুষ হঠাৎ করে এই ধরনের অপরাধ ঘটাতে পারে না।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানাচ্ছে, ২০৩০ সাল নাগাদ পৃথিবীতে রোগের বোঝার হিসাবের বা ডিজিজ বার্ডেনের এক নম্বর কারণ হবে বিষণ্নতা। আর সে সময় বছরে প্রায় ১৫ লাখ মানুষ আত্মহত্যাজনিত কারণে মৃত্যুর শিকার হবে। আধুনিক পৃথিবীর জন্য এ এক ভয়ংকর ভবিষ্যদ্বাণী।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কয়েক যুগ আগে ‘স্বাস্থ্য’-এর সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছিল ‘কেবল নীরোগ থাকাটাই স্বাস্থ্য নয় বরং শারীরিক, মানসিক, আত্মিক ও সামাজিকভাবে ভালো থাকার নামই স্বাস্থ্য।’ আমাদের অসচেতনতার ফলে ‘স্বাস্থ্য’ শব্দটি সীমাবদ্ধ হয়ে আছে শুধু ‘শারীরিক’ অংশটুকুর মধ্যে। আর তাই বাংলাদেশসহ অনেক দেশেই মানসিক সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে।
২০১৫ সালে ঐশী নামে ১৭ বছরের একটি মেয়ে তার বাবা-মাকে হত্যা করে দুই দিন লাশ ফেলে রেখেছিল। কারণ, ঐশীর পুলিশ কর্মকর্তা বাবা মেয়ের হাত থেকে মোবাইল কেড়ে নিয়ে তাকে ঘরবন্দি করেছিল, কারণ মেয়ে অসৎসঙ্গে পড়ে মাদক ধরেছিল। এই রাগে সে বাবা-মাকে হত্যা করে।
জীবনের চাপ-অত্যাচার, নিপীড়ন-অন্যায়, অবিচার-ব্যর্থতা সব মানুষ সমানভাবে গ্রহণ করতে পারে না। বিশেষ করে শিশুদের ওপর ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজের নেতিবাচক প্রভাব, তাদের ডিপ্রেশন বা হতাশার মুখে এনে দাঁড় করিয়ে দেয়। এমনকি কোনো কোনো সময় এই অবস্থার জের শিশুকে সারা জীবন বয়ে বেড়াতে হয়।
যেমন কোনো মা যদি সন্তান ধারণকালে ক্ষতিকর মানসিক চাপ থেকে বিষণ্নতা বা উদ্বেগে ভুগে থাকেন, তাহলে তার যে শিশু জন্ম নেবে সে জিনগতভাবে বিষণ্নতা বা উদ্বেগে আক্রান্ত হবার ঝুঁকি নিয়ে জন্ম নিতে পারে। তার মানে ওই শিশুর ক্ষেত্রে পুরো জীবন ও তার পরবর্তী প্রজন্মকে পাল্টে দেবে।
আমাদের এই সমাজ এখন এতটাই অস্থির, এতটাই ছলচাতুরীপূর্ণ, লোভ-লালসা ও শঠতাপূর্ণ যে অনেক মানুষ ঠিকমতো বুঝতেই পারে না যে, কোন চিন্তা, কোন আচরণ সুস্থ আর কোন চিন্তা, কোন আচরণ অসুস্থ। আর সেই কারণে পরিবারের শিশুরাও কোনটা শিখবে আর কোনটা বর্জন করবে সেই মূল্যবোধ তৈরি করাতে পারছেন না অভিভাবক।
ফলে মানসিক অসুস্থতার ভয়াবহ পরিবেশ তৈরি হচ্ছে এবং সেটা থেকে মুক্ত হওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে যাচ্ছে। মনোবিকারগ্রস্ত সমাজ এমন একটা সমাজ যা মানুষকে, পরিবার ও সমাজ এমনকি দেশের উন্নয়নকে বিলীন করে দিতে পারে।
সাধারণত নিজের মধ্যে ঘটে যাওয়া অস্বস্তি বা অসহ্যতা কাটানোর জন্য স্বাভাবিক মানুষ চিন্তা করে, পড়াশোনা করে, গবেষণা করে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ আনার চেষ্টা করে।
আবার অস্থির সমাজে এমনও দেখা যায় এগুলোকে উপেক্ষা করে বিভিন্ন বিকৃত পথেও মানুষ অস্বস্তি বা অসহ্যতা থেকে মুক্ত হওয়ার উপায় খোঁজে। কিন্তু এই বিকৃত পথগুলো অনুসরণের ফল হলো বাস্তবতা, সামাজিক সহাবস্থান, পারিবারিক বন্ধন থেকে ক্রমেই সরে আসা। তখন মানুষ যেকোনো ধরনের অপরাধ করে, মাদক গ্রহণ করে মনের অস্বস্তি দূর করার চেষ্টা করে। সবকিছুই তাদের মনে হয় হালকা ধারণা। জীবন তাদের কাছে হয়ে যায় এমন কাল্পনিক, যেখানে সবকিছুই সম্ভব কিন্তু কোনো কিছুই যেন বাস্তব বা নিরেট নয়।
বর্তমানে আমাদের অনেকের মধ্যেই এমন একটা অক্ষমতা ভর করেছে যে, আমরা আবেগপ্রবণ, জ্ঞানহীন, গোঁয়ার ও ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছি। লোভী, স্বার্থপর, ইন্দ্রিয়পরায়ণ ও অপরিচ্ছন্ন চিন্তার এই সমাজ এমন এক মানসিক পরিবেশ তৈরি করছে, যেখানে একটি শিশু বেড়ে উঠছে বিকৃত পথে, অসুস্থ পারিবারিক পরিবেশে। একজন অপরাধী কেন অপরাধ করছে, সেটা তার বর্তমান অবস্থা দিয়ে নয়, বিচার করতে হয় তার শিশু ও কৈশোরকালীন পরিবেশ ও শিক্ষা দিয়ে।
শিশু যদি নিয়মিত খেলাধুলা বা শরীরচর্চা না করে, বাবা-মায়ের মনোযোগ না পায়, পড়াশোনা করার সুযোগ না পায় এবং সামাজিক ও বুদ্ধিগত বিষয়ে অংশগ্রহণ না করে বা তার আশেপাশের পরিবেশ নিয়ে না ভাবে অথবা সামাজিক চিন্তায় যথেষ্ট পরিমাণে জড়িত না থাকে, তাহলে শিশু-কিশোরের মনোজগত নষ্ট হতে বাধ্য। এখন আমাদের সমাজে তাই ঘটছে। এর সঙ্গে জ্ঞান বুদ্ধি কল্যাণ ও সততা থেকে দূরে থেকে হীনতা, স্বার্থপরতা, লোভ আর কূপমণ্ডূকতার পারিবারিক সংস্কৃতিও জিনগতভাবে অক্ষম প্রজন্ম তৈরি করছে।
মানসিক স্বাস্থ্য অর্থ কেবল মানসিক রোগ নয়, বরং মনের যত্ন নেয়া, নিজের সক্ষমতা আর দুর্বলতা বুঝতে পারা। মনকে বাদ দিয়ে শরীর নয়। সবাইকে সচেষ্ট হতে হবে মানসিক স্বাস্থ্য চাঙা রাখার জন্য ও মনে কোনো রোগ না হলেও মনের যত্ন নেয়ার জন্য। তা না হলে এধরনের হত্যা ও আত্মহত্যামূলক ঘটনা বাড়তেই থাকবে।
লেখক: যোগাযোগকর্মী, সিনিয়র কো-অর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন