বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

বাল্যবিবাহের ছোবলে ব্যাহত নারীর অগ্রযাত্রা

  • লীনা পারভীন   
  • ২১ জুন, ২০২১ ০৯:২৪

বাল্যবিবাহ রোধ করতে গেলে আমাদের ভাবতে হবে সেসব পরিবারগুলোর আর্থিক সক্ষমতা আনার দিকেও। কোন কোন কারণে বাল্যবিবাহের সংখ্যা বাড়ছে, সে কারণগুলো খুঁজে বের করে সঠিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে এর প্রতিকারে সঠিক ও সময়োপযোগী কর্মপরিকল্পনা নিতে হবে এখনই। মূলত দারিদ্র্য, সামাজিক নিরাপত্তার অভাব, যৌন হয়রানি, অশিক্ষা এসব কারণেই বাল্যবিবাহের মতো ঘটনা বেড়ে যাচ্ছে।

আধুনিক সভ্যতার এ সময়ে এসেও বাংলাদেশের আনাচকানাচ থেকে বাল্যবিবাহের খবর পাওয়া যায়। সম্প্রতি বরিশালের আগৈলঝড়ায় অষ্টম শ্রেণির এক ছাত্রীর বিবাহ বন্ধ করে দিয়েছে স্থানীয় ভ্রাম্যমাণ আদালত। ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশ হবার স্বপ্ন নিয়ে চলা বাংলাদেশে এমন সংবাদ বড্ড বেমানান। বাল্যবিবাহ এমন একটি প্রথা, যা দীর্ঘদিন নারীকে কেন্দ্র করে সমাজে চলমান মূল্যবোধ ও অসমতাকে প্রকাশ করে চলেছে; যদিও বাল্যবিবাহ কেবল নারীর একার জন্য প্রযোজ্য নয়। এর অন্তর্ভুক্ত আছে পুরুষরাও। তবে যেহেতু সংখ্যায় কম তাই আমরা পুরুষদের বাল্যবিবাহের চেয়ে নারীর ক্ষেত্রে ঘটে যাওয়া ঘটনাকেই প্রাধান্য দিই বেশি। বাংলাদেশের সামাজিক বাস্তবতায় পরিবারগুলো তাদের কন্যাসন্তানকে পারিবারিক বোঝা হিসেবেই গণ্য করে থাকে। জাতিসংঘের হিসাব বলে বাংলাদেশে ৫০ ভাগ নারীর বিবাহ হয় ১৮ বছরের আগে যদিও বিগত বছরগুলোতে পরিস্থিতি কিছুটা উন্নত হয়েছে।

বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৭ অনুযায়ী, পুরুষের ক্ষেত্রে বিবাহের বয়স বলা হয়েছে ২১ এবং নারীর ক্ষেত্রে তা ১৮। জানা যায়, বাল্যবিবাহ বন্ধে যে সফলতা পেয়েছিল বাংলাদেশ সেটি এখন হুমকির সম্মুখীন।

বাংলাদেশ বর্তমানে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড সুবিধার আওতায় আছে, যেখানে মোট জনসংখ্যার প্রায় ৬৫ ভাগ তরুণ। এই তরুণদের ওপর নির্ভর করেই নেয়া হচ্ছে বেশির ভাগ উন্নয়ন পরিকল্পনা। ৬৫ ভাগ জনসংখ্যার অর্ধেক হচ্ছে নারী। তাই জাতীয় উন্নয়নের হিসাবের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত আছে এই নারীসমাজের উন্নয়নও। ইতোমধ্যেই বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়ন, শিশুমৃত্যুহার হ্রাসসহ আরও কিছু মানব উন্নয়ন সূচকে বিশ্বের দরবারে উদাহরণ তৈরি করেছে। কিন্তু বিপদের কথা হচ্ছে করোনা কেড়ে নিয়ে যাচ্ছে এমন অনেক অর্জন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ আজ প্রায় দেড় বছর। পরিবারের আয় কমেছে অনেকের। সমাজে বিরাজমান নারী নির্যাতনের হার বেড়েছে কয়েক গুণ।

প্রায় প্রতিদিন আমরা ধর্ষণসহ নানা রকম নারী নির্যাতনের সংবাদ পাই। ক্রমবর্ধমান নারী নির্যাতন থেকে তৈরি হচ্ছে সামাজিক নিরাপত্তার অভাব। এমনিতেই আমাদের সমাজে নারীর নিরাপত্তা নিয়ে সব সময় শঙ্কায় থাকে তার মধ্যে প্রতিনিয়ত তৈরি হওয়া সামাজিক অস্থিরতাও বাল্যবিবাহের পেছনে কারণ হিসেবে কাজ করছে। সংসারের বোঝা মনে করা কন্যাসন্তান একটু বড় হলেই তাকে নিয়ে বেড়ে যায় ভাবনাচিন্তা। সদ্যযৌবনা কন্যাসন্তানটিকে কেমন করে আগলে রাখবে এ নিয়ে দুশ্চিন্তা বেড়ে যায়। এই বাস্তবতাকে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।

সাম্প্রতিক এক পরিসংখ্যান বলছে করোনাকালে যত বিবাহ হয়েছে, এর প্রায় ৭০ ভাগ বিবাহ হয়েছে বাল্যবিবাহ। এই পরিসংখ্যান যদি সঠিক চিত্র তুলে ধরে তাহলে আগামীর বাংলাদেশের চিত্র হবে ভয়াবহ। কারণ, বাল্যবিবাহ নারীর স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে, অপ্রাপ্ত বয়সে বিবাহর ফলে নারীরা অপুষ্টিজনিত সমস্যায় ভোগে। কেবল নারী নয়, তার গর্ভে জন্ম নেয়া শিশুটিও অপুষ্টির শিকার হচ্ছে। এতে করে নারী ও শিশুমৃত্যুর হার বেড়ে যাবার সম্ভাবনা বেড়ে যাচ্ছে। আর এর প্রভাব সরাসরি পড়বে আমাদের উন্নত দেশ হবার স্বপ্নের মাঝে কারণ টেকসই উন্নয়নের অন্যতম শর্ত হচ্ছে বাল্যবিবাহ রোধ ও শিশু নির্যাতন রোধ। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, করোনাকালে বাল্যবিবাহের কারণে নারীর স্বাস্থ্যের অবনতি হয়েছে ১ দশমিক ৬ শতাংশ। করোনাকালে আয় উপার্জনহীন হয়েছে বহু পরিবার। মধ্যবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত অনেক পরিবার আজ আর্থিকভাবে চরম অনিশ্চয়তার মাঝে বাস করছে।

বাল্যবিবাহ রোধ করতে গেলে আমাদেরকে ভাবতে হবে সেসব পরিবারগুলোর আর্থিক সক্ষমতা আনার দিকেও। কোন কোন কারণে বাল্যবিবাহের সংখ্যা বাড়ছে সে কারণগুলো খুঁজে বের করে সঠিক বিশ্লেষণ করে এর প্রতিকারে সঠিক ও সময়োপযোগী কর্মপরিকল্পনা নিতে হবে এখনি। মূলত দারিদ্র্য, সামাজিক নিরাপত্তার অভাব, যৌন হয়রানি, অশিক্ষা এসব কারণেই বাল্যবিবাহর মতো ঘটনা বেড়ে যাচ্ছে।

করোনাকালে বন্ধ রয়েছে শিশুদের টিকা প্রদান কার্যক্রম। পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রমের অগ্রগতি সম্পর্কেও কোনো তথ্য নেই। গ্রামে গ্রামে যে ধরনের সচেতনতামূলক কর্মসূচি প্রচলিত ছিল করোনার কারণে সেগুলো সবই বন্ধ আছে। স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো ব্যস্ত আছে করোনা মোকাবিলায় সরকারের গৃহীত বিভিন্ন কর্মসূচির সঠিক বাস্তবায়নে। এমতাবস্থায় বেড়ে যাচ্ছে বিভিন্ন প্রকার হয়রানিমূলক কার্যক্রম।

বাল্যবিবাহ রোধে সবচেয়ে বেশি যে কর্মপরিকল্পনা দরকার সেটি হচ্ছে সামাজিক সচেতনতাকে জাগিয়ে তোলা। কন্যাসন্তান সংসারে বোঝা নয়, সেও পারে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিয়ে সংসারের হাল ধরতে এই বিশ্বাসকে জাগ্রত করতে হবে। নারী নির্যাতনের মতো ঘটনাগুলোর বিচার নিশ্চিত করতে হবে দ্রুত। নারীর সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় সরকারকে ভাবতে হবে আরও নানাদিক দিয়ে। স্থানীয় প্রশাসনকে সচল করে এলাকায় এলাকায় নারী হয়রানিকে মোকাবিলা করতে হবে যাতে করে পরিবারগুলো তাদের কন্যাসন্তানকে নিয়ে ভয়ে না থাকে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ বলেই মেয়েকে বিবাহ দিয়ে বোঝা হালকা করতে হবে এমন ধারণাকে দূর করতে নারী শিক্ষার গুরুত্বকে সামনে আনতে হবে। বাল্যবিবাহ নিরোধে যে আইন করা হয়েছে সেটি নিয়েও প্রচারণা বাড়াতে হবে আরও অনেক। বর্তমানে বেশিরভাগ পরিবারের অভিভাবকরাই আইনের দিকটি সম্পর্কে সচেতন নয়, যে কারণে বাল্যবিবাহ দিতে ভয় পাচ্ছে না।

স্থানীয় প্রশাসনের মাঝেও আনতে হবে সচেতনতা। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে আরও অনেক বেশি কার্যকর ভূমিকা রাখতে এগিয়ে আসতে হবে। স্থানীয়ভাবে যেসব সংগঠন কাজ করছে তাদের সবার সঙ্গে মিলে একটি জাতীয় পরিকল্পনা ঘোষণা করার এখনি সময়। সেই পরিকল্পনাকে অগ্রাধিকার দিয়ে কাজে নেমে না পড়লে সামনে কী হবে তা বলা মুশকিল।

লেখক: প্রাবন্ধিক, কলাম লেখক

এ বিভাগের আরো খবর