বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

বজ্রপাতে আর অসহায় ভাবার সুযোগ নেই

  • ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ   
  • ২০ জুন, ২০২১ ১৭:২৫

বাংলাদেশে বজ্রপাতের ওপর তেমন কোনো গবেষণা নেই। তবে ইউরোপ, জাপান ও আমেরিকায় এ বিষয়টি নিয়ে বড় গবেষণা চলছে। আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, অন্য যেকোনো দুর্যোগের চেয়ে বজ্রপাতে মানুষের মৃত্যুহার দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। সরকার বজ্রপাতকে দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা করলেও এর ঝুঁকি কমাতে দৃশ্যমান উদ্যোগ কম। বজ্রপাতের ঝুঁকি মোকাবিলায় প্রাথমিক পর্যায়ে সারা দেশে তালগাছের ৫০ লাখ চারা রোপণের উদ্যোগ নিলেও এটি খুব একটি কার্যকর নয় বলে ধারণা করা হচ্ছে।

সম্প্রতি বাংলাদেশসহ পৃথিবীজুড়ে বজ্রপাতে প্রাণহানির সংখ্যা বেড়েছে। বাংলাদেশে প্রতি বর্গকিলোমিটারে অন্তত ৪০টি বজ্রপাত হয় বলে আন্তর্জাতিক গবেষণায় উঠে এসেছে। পৃথিবীর বজ্রপাতপ্রবণ অঞ্চলের একটি বাংলাদেশ।

এই অস্বাভাবিকতার কারণ হচ্ছে, বায়ুমণ্ডলে কালো মেঘ বেড়ে যাওয়া। কালো মেঘ সৃষ্টির পেছনে বাতাসে নাইট্রোজেন ও সালফারের পরিমাণ বাড়াকেই দায়ী করছেন বিজ্ঞানীরা। জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পৃথিবীতে প্রতি মিনিটে ৮০ লাখ বজ্রপাত সৃষ্টি হয়। উন্নত দেশগুলোতেও একসময় বজ্রপাতে অনেক মানুষের মৃত্যু হতো। কিন্তু তারা বজ্রনিরোধক খুঁটি বা পোল স্থাপন করা, মানুষকে সচেতন করার মধ্য দিয়ে ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে এনেছে। তবে তার আগে বৈজ্ঞানিক তথ্যভিত্তিক ব্যবস্থাপনা ও ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাভিত্তিক সচেতনতা সৃষ্টি করেছে উন্নত দেশগুলো।

এতে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপের দেশগুলোসহ পূর্ব এশিয়ায় বজ্রপাতে হতাহতের সংখ্যা বহুলাংশে কমেছে। যদিও বজ্রপাত সম্পর্কে অনেক কল্পকাহিনি প্রচলিত, বিজ্ঞানের কল্যাণে বজ্রপাতের কারণ পরিষ্কার হয়েছে। সহজ ভাষায় বায়ুমণ্ডলে ধনাত্মক ও ঋণাত্মক বৈদ্যুতিক চার্জের গঠন ও পৃথকীকরণে বজ্রপাত সংঘটিত হয়। সারা বছরের হিসাবে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত সংঘটিত হয় ভেনেজুয়েলার মারাকাইবো হ্র্রদে। অপরদিকে আফ্রিকার কঙ্গো অববাহিকার অবস্থান দ্বিতীয়।

বজ্রপাত একটি স্বাভাবিক প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলেও বর্তমানে এর ব্যাপকতা জনজীবনকে ভাবিয়ে তুলছে এবং ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে এখন তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ কিংবা ডাটাবেইজ সৃষ্টিতে কর্তৃপক্ষ তৎপর। সরকারি পর্যায়ে ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়, বিভিন্ন এনজিও, গণমাধ্যম কর্তৃক প্রদত্ত তথ্যে দেখা যায়, বিগত পাঁচ বছরে সারা দেশে বজ্রপাতে প্রায় তিন হাজারের বেশি মানুষের প্রাণ গেছে এবং ২০১১ সালের পর থেকে এর প্রবণতা ক্রমাগতভাবেই বেড়ে চলছে।

যেমন, ২০১৫ সালে ৯৯ জন, ২০১৬ সালে ৩৫১ জন ও ২০১৭ সালে ২৬২ আর ২০১৮ এপ্রিল পর্যন্ত ৫৭ জনের মৃত্যু, ২০২১ সালের মে পর্যন্ত ১৬ জনের মৃত্যু ও চার শতাধিক আহত হওয়ার খবর রয়েছে; যা গ্রামাঞ্চলে ফসলের মাঠ, পুকুরের পাড় ও হাওরে বেশি সংঘটিত হচ্ছে। বজ্রপাতে বাংলাদেশে প্রতিবছর গড়ে প্রায় ২৫০ জনের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর, বুয়েট, দুর্যোগ ফোরাম, গণমাধ্যমসহ একাধিক তথ্যমতে, বজ্রপাতে ২০১০ থেকে ২০১৯ সালের ৮ এপ্রিল পর্যন্ত ২ হাজারের বেশি মানুষ মারা গেছে। এত বেশি মৃত্যুহারের জন্য মানুষের অসচেতনতাকেই দায়ী করছেন বিশ্লেষকরা।

তারা বলছেন, বজ্রপাত সম্পর্কে দেশের প্রান্তিক ও নিরক্ষর জনসাধারণের সঠিক ধারণা না থাকার দরুন মৃত্যুহার বেশি। ঝড়-বৃষ্টি, বজ্রপাতের সময়ও এ দেশের লোকজন খোলা জায়গায় কাজ করে। বিশেষ করে হাওরাঞ্চলের কৃষক ও জেলে সম্প্রদায়।

দেশি-বিদেশি গবেষণা বলছে, দেশে গত কয়েক বছরে কালবৈশাখীর পাশাপাশি বজ্রপাত বেড়েছে। বজ্রপাতে মৃত্যু নিয়ে একক কোনো কারণ চিহ্নিত করতে পারছেন না বিশেষজ্ঞরা। অনেকটাই ধারণানির্ভর তথ্যে তারা মনে করছেন, তাপমাত্রা ও বাতাসে সিসার পরিমাণ বৃদ্ধি, জনজীবনে ধাতব পদার্থের ব্যবহারের আধিক্য, মোবাইল ফোন ব্যবহার ও এর টাওয়ারের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া, বনভূমি বা গ্রামাঞ্চলে উঁচু গাছের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে হ্রাস, জলাভূমি ভরাট ও নদী শুকিয়ে যাওয়া ইত্যাদি বজ্রপাত বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। আর এসবের সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তন ও উষ্ণায়নের সম্পর্ক আছে।

বিশ্বখ্যাত সায়েন্স পত্রিকার নিবন্ধে ১ ডিগ্রি তাপমাত্রা বেড়ে গেলে বজ্রপাতের আশঙ্কা ১২ শতাংশ বেড়ে যায় বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আবহাওয়া-সম্পর্কিত দ্বিতীয় বৃহত্তম ঘাতক হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে বজ্রপাত। প্রযুক্তির ব্যবহার করে বজ্রপাতে মৃত্যু কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আনা যেতে পারে, তবে সচেতনতা এবং সতর্কতার কোনো বিকল্প নেই। এখনই এই দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ প্রয়োজন।

বজ্রপাতের প্রকোপ থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় হিসেবে প্রথমত, দেশের বজ্রপাতপ্রবণ এলাকাগুলো শনাক্ত করতে হবে আবহাওয়া জরিপের ভিত্তিতে। দ্বিতীয়ত, বর্তমানে গণমাধ্যমের বদৌলতে আমরা যেসব তথ্য পাই তা থেকে দেখা যায়, দেশের ১৪টি জেলা বজ্রপাতের ঝুঁকির আওতায় রয়েছে, এর মধ্যে সুনামগঞ্জের নাম ওপরের দিকে রয়েছে।

তাই এলাকার মানুষকে এই বার্তাটি দেয়ার দায়িত্ব কার? অবশ্যই সরকারের; তবে স্থানীয়ভাবে কর্মরত সামাজিক সংগঠনগুলোর দায়িত্বও কম নয়। যেহেতু মার্চ থেকে মে পর্যন্ত এই বজ্রপাতের প্রকোপ বেশি, তাই বিভিন্নভাবে প্রচার, সতর্কীকরণ, সামাজিক সভা ও মাইকিং করা যেতে পারে।

যেসব বিষয় এতে স্থান পাবে তা হলো, বজ্রপাতের সময় পাকা ভবনের নিচে আশ্রয় নেয়া, উঁচু গাছপালা ও বিদ্যুতের খুঁটি থেকে দূরে থাকা, বাড়ির জানালা থেকে দূরে থাকা, ধাতব বস্তু স্পর্শ না করা, বিদ্যুৎ-চালিত যন্ত্র থেকে দূরে থাকা, গাড়ির ভেতরে না থাকা, পানি থেকে দূরে থাকা, বজ্রপাতের আশঙ্কা দেখা দিলে নিচু হয়ে বসা, রাবারের জুতা ব্যবহার করা, বজ্রপাতজনিত আহত ব্যক্তিদের দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা ইত্যাদি।

জলবায়ু পরিবর্তন, বনভূমির পরিমাণ হ্রাস, বড় গাছ কাটা ও বৈদ্যুতিক বিভিন্ন যন্ত্রপাতির ব্যবহার বাড়ার কারণে বজ্রপাত ও ক্ষয়ক্ষতি দুটিই বেড়েছে। একটি দেশের আয়তনের এক-চতুর্থাংশ বনভূমি থাকা প্রয়োজন, কিন্তু আমাদের দেশে সামাজিক বনভূমির পরিমাণ হিসাবে আনলেও তা কোনোভাবেই ২৫ শতাংশ হয় না। তাই প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বনভূমির পরিমাণ বাড়াতে হবে এবং প্রকৃতির সঙ্গে সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে সখ্য গড়ে তুলতে হবে।

যুক্তরাষ্ট্রে বজ্রপাতে আগে বছরে ৪০০ থেকে ৪৫০ জন নিহত হতো, সেখানে এখন মারা যায় ২০ থেকে ৪০ জন। গত বছর নিহত হয়েছে মাত্র ১৬ জন।

গবেষকরা বলছেন, নগরায়ণের কারণে এটা সম্ভব হয়েছে। আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন অনেক বেশি মানুষ নগরে থাকছে। বিদ্যুতের লম্বা খুঁটি মানুষের উচ্চতার অনেক ওপরে থাকায় আর খুঁটির সঙ্গে আর্থিংয়ের ব্যবস্থা বজ্রপাত থেকে মানুষের জীবনহানি রোধ করে।

ক্ষয়ক্ষতি হয় বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতির। বড় গাছ ধ্বংস করে ফেলার কারণে আমাদের গ্রামাঞ্চল অরক্ষিত হয়ে পড়ছে। গ্রামে আগের জমিদার বাড়ির ছাদে, মন্দিরের চূড়ায় কিংবা মসজিদের মিনারে যে ত্রিশূল বা চাঁদ-তারা দিয়ে আর্থিং করা থাকত, সেটাও বজ্রপাতের প্রাণহানি থেকে মানুষকে রক্ষা করত।

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, বাংলাদেশের হাওরাঞ্চল (সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া), সাতক্ষীরা-যশোরের বিল অঞ্চল আর উত্তরের চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও দিনাজপুর অঞ্চলে বজ্রপাতে প্রাণহানির ঘটনা বেশি ঘটে। আর গত বছর প্রায় ৫৭ শতাংশ মানুষই মারা যান মাঠে অথবা জলাধারে (নদী-খাল, বিল) কাজ করার সময়। এসব অঞ্চলে মুঠোফোনের টাওয়ার লাইটেনিং এরস্টোর লাগিয়ে বজ্রপাতের ঝুঁকি কমানো যায়। মুঠোফোন কোম্পানিগুলো তাদের দায়িত্বের অংশ হিসেবে কাজটি করতে পারে। পল্লী বিদ্যুৎ ও সীমান্তরক্ষীদের সব স্থাপনায় কমবেশি এটি ব্যবহৃত হচ্ছে।

বজ্রপাত থেকে বাঁচতে সচেতনতার বিকল্প নেই। সতর্ক হলে মৃত্যুর সংখ্যা কমানো যেতে পারে। দুঃখজনক সত্যটি হলো, বাংলাদেশে বজ্রপাতের ওপর তেমন কোনো গবেষণা নেই। তবে ইউরোপ, জাপান ও আমেরিকায় এ বিষয়টি নিয়ে বড় গবেষণা চলছে।

আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, অন্য যেকোনো দুর্যোগের চেয়ে বজ্রপাতে মানুষের মৃত্যুহার দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। সরকার বজ্রপাতকে দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা করলেও এর ঝুঁকি কমাতে দৃশ্যমান উদ্যোগ কম। বজ্রপাতের ঝুঁকি মোকাবিলায় প্রাথমিক পর্যায়ে সারা দেশে তালগাছের ৫০ লাখ চারা রোপণের উদ্যোগ নিলেও এটিও খুব একটি কার্যকর নয় বলে ধারণা করা হচ্ছে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর, বুয়েট, দুর্যোগ ফোরাম, গণমাধ্যমের তথ্য ও একাধিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার হিসাবমতে, গত ছয় বছরে সারা দেশে বজ্রপাতে সাড়ে ৩ হাজারেরও বেশি মানুষ মারা গেছে। বজ্রপাতের এমন প্রবণতাই বলে দিচ্ছে প্রকৃতি কতটা রুষ্ট হয়ে উঠছে। মানুষের অধিক চাহিদা আর লোভে প্রাকৃতিক পরিবেশ বিনষ্টের খেসারত হিসেবে প্রকৃতির প্রতিশোধ কি বজ্রপাত? সে বিষয় নিয়ে এখন ভেবে দেখার সময় এসেছে।

লেখক: গবেষক, কলাম লেখক ও সাবেক উপমহাপরিচালক, বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি

এ বিভাগের আরো খবর