বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

নারীর মর্যাদা সুরক্ষায় প্রত্যাশা

  • শাহনাজ পলি   
  • ২০ জুন, ২০২১ ১৩:৫৮

উঠতি বয়সী মেয়েরা দ্রুত জনপ্রিয় হতে গিয়ে অপরাধের শিকার হচ্ছে। যেমন টিকটক, লাইকির মতো ভিডিও বা লাইভ অ্যাপে দ্রুত তারকা হওয়ার ইচ্ছা থাকে কম বয়সী অনেক ছেলেমেয়ের। লাখ লাখ ফলোয়ার বা লাইকের আশায় অনেকেই এসব মাধ্যমে মগ্ন হয়ে পড়ে। আর এর সুযোগ নেয় অপরাধীরা। প্রযুক্তি ব্যবহার করে আমরা নারীদের স্বাবলম্বী দেখতে চাচ্ছি কিন্তু তাদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করতে বেগ পেতে হচ্ছে।

পরিবারে মেয়ে মানেই ঝামেলা; মেয়ে মানেই দুশ্চিন্তা- এমন ধারণা পরিবার এবং সমাজে বহুকাল ধরেই প্রচলিত। মা, দাদি, চাচি ,ফুফু, মামিদের প্রতি একরকম নেতিবাচক মন্তব্য শুনতে শুনতে বড় হয় একটি কন্যাশিশু। তার মনেও ‘মেয়েছেলে’ বা ‘মেয়েমানুষ’-এর প্রতি এবং একই সঙ্গে মেয়ে হিসেবে নিজের প্রতি হীনম্মন্যতা বোধ জন্ম নেয়। নারীর প্রতি সম্মানের একটা ‘মানদণ্ড’ তৈরি হয়ে যায়। তাছাড়া পরিবারে ছেলেসন্তানের তুলনায় কন্যা হিসেবে নিত্যদিনের বৈষম্যমূলক আচরণে একরকম ভবিতব্য বলেই ধারণা বদ্ধমূল হয়ে যায়।

ছোট থেকেই এটা করবে না, সেটা করা বারণ, কারণ তুমি মেয়ে- এ রকম বিধিনিষেধের বেড়াজালে কঠোর পরিবেশে বড় হতে হয় একটি মেয়েশিশুকে। প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে তাদের জানা বা বোঝার সুযোগ খুব সীমিত। তবে পরিবার বা আশপাশের পরিবেশে থেকে সামাজিক বিভিন্ন ঘটনাবলি থেকে মেয়েশিশুদের মধ্যে মানুষ সম্পর্কে একটা সহজাত ধারণা জন্মলাভ করে।

অল্প বয়সেই সে বুঝতে পারে কে তার প্রতি স্নেহের দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে, কে তার প্রতি কু দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। কে তাকে ভালোবাসে আর কে তাকে হিংসা করে। এভাবেই কোনটা ভালো বা কোনটা খারাপ সেসব বিষয়ে তার মনে একটা নিজস্ব ধারণা জন্ম নেয়। অনেক ক্ষেত্রে সেটা পরিপূর্ণ না-ও হতে পারে।

নারীকে ইতিবাচকভাবে দেখতে চাইলে শিক্ষা বা কর্মক্ষেত্রে তাদের সংখ্যা বাড়াতে হবে এবং ঠিকভাবে গড়ে উঠতে দিতে হবে। পরিবারের উচিত তার শিশুকে ছোট থেকেই নানান বিষয় নিয়ে আলোচনা ও পরিবারের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে কিছু বিষয়ে শিশু বা নারীর মতামতকে গুরুত্ব দেয়া। পরিবার, সমাজ বা রাষ্ট্রীয় ভালোমন্দ বিষয়গুলো বয়সভেদে বোঝানোর দায়িত্ব পরিবারের। নয়তো নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে আটকে রাখা মেয়েরা যখন হঠাৎ হাতে প্রযুক্তি পায়, স্বাধীনভাবে চলাফেরার সুযোগ পায় তখন ভালোমন্দ না বুঝেই নানা ধরনের ফাঁদে পড়ে, তৈরি হয় জটিল পরিস্থিতি।

অনিরাপত্তা নারীর জীবনের উন্নতিতে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

বাড়িতে, চলতি পথে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, অফিসে এমনকি অনলাইনে নারীরা নানানভাবে নির্যাতিত বা প্রতারণার শিকার হয়। এখন নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতার অন্যতম মাধ্যম হয়েছে ইন্টারনেট দুনিয়া। অনলাইন জগৎ যেমন দূরকে হাতের মুঠোয় এনেছে, তেমনি এর মাধ্যমে অপরাধও বেড়েছে অনেক। এর ফাঁদে পড়ে কিশোরী বা উঠতি বয়সী মেয়েরা দ্রুত জনপ্রিয় হতে গিয়ে অপরাধের শিকার হচ্ছে।

যেমন টিকটক, লাইকির মতো ভিডিও বা লাইভ অ্যাপে দ্রুত তারকা হওয়ার ইচ্ছা থাকে কম বয়সী অনেক ছেলেমেয়ের। লাখ লাখ ফলোয়ার বা লাইকের আশায় অনেকেই এসব মাধ্যমে মগ্ন হয়ে পড়ে। আর এর সুযোগ নেয় অপরাধীরা। প্রযুক্তি ব্যবহার করে আমরা নারীদের স্বাবলম্বী দেখতে চাচ্ছি কিন্তু তাদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করতে বেগ পেতে হচ্ছে।

প্রায় প্রতিদিনই গণমাধ্যমে নানা প্রান্ত থেকে ধর্ষণ আর নারী নিগ্রহের খবর আসছে। ধর্ষণ, নির্যাতন বা হয়রানি, যে রকমই হোক না কেন, নারীদের প্রতি এই আচরণ সরাসরি মানবিক মর্যাদার লঙ্ঘন। যা ব্যক্তিগত আঘাত বা যন্ত্রণা সহ্য করে বেঁচে থাকতে হয়। সম্প্রতি কিছু নারী ধর্ষণ ও নিগ্রহের ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় অভিযুক্ত অপরাধীদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, আবার তনু হত্যার মতো ঘটনায় তাদের নিষ্ক্রিয়তা মানুষকে হতাশ করেছে।

ইউনিসেফের এক জরিপে জানা যায়, বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ১০ থেকে ১৭ বছর বয়সীদের ৩২ শতাংশ শিশু অনলাইন সহিংসতা, অনলাইনে ভয়ভীতি প্রদর্শন ও ডিজিটাল উৎপীড়নের শিকার হওয়ার মতো বিপদের মুখে রয়েছে। সেখানে ৬৩ শতাংশ ছেলে এবং ৪৮ শতাংশ মেয়ে ইন্টারনেট ব্যবহার করে। এ ছাড়া বলা হয়, ব্যবহারকারীদের মধ্যে ৭০ শতাংশ ছেলে ও ৪৪ শতাংশ মেয়ে অনলাইনে অপরিচিত মানুষের বন্ধুত্বের অনুরোধ গ্রহণ করে।

কোভিড-১৯ আমাদের জন্য এক বড় চ্যালেঞ্জ। দেশের স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, বেকারত্ব, বিশৃঙ্খলা, নারী-শিশু নির্যাতন, বাল্যবিবাহ সব ক্ষেত্রেই একটা অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। যদিও গত বছর বিশ্ব জনসংখ্যা দিবসের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারণ করা হয় ‘কোভিড-১৯ প্রতিরোধ করি: নারী ও কিশোরীদের সুস্বাস্থ্যের অধিকার নিশ্চিত করি’।

স্থানীয় পর্যায়ে কীভাবে নারী ও কিশোরীদের অধিকতর সুরক্ষা দেয়া যায়, তা নিয়ে ভাবনা ও যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া হয়। কিন্তু বর্তমানে যেসব ঘটনা ঘটছে তাতে কি মনে হয় আদৌ এটা আমরা নিশ্চিত করতে পেরেছি? সামাজিক প্রেক্ষাপটে যে ধরনের খবর পাওয়া যাচ্ছে তাতে নারী ও কিশোরীরা রয়েছে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে।

টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টে পৌঁছানো এবং আন্তর্জাতিক জনসংখ্যা ও উন্নয়ন সম্মেলনের (আইসিপিডি) প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের ভিত্তিমূলে তিনটি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এগুলো হলো অধিকার ও পছন্দ, সমতা ও জীবনের গুণগত উন্নয়ন।

এগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলো মাতৃমৃত্যুর হার, যৌন সহিংসতা, নারী নির্যাতন ও বাল্যবিবাহের হার কমিয়ে শূন্যে নামানো। যদিও বাস্তবে এর চিত্র অন্যরকম। করোনাকালে বাল্যবিবাহের হার বেড়ে গেছে। আর এর অন্যতম কারণ অর্থনৈতিক টানাপোড়েনের সময়ে মেয়েশিশুকে বাড়তি বোঝা মনে করে অনেক পরিবার।

এদিকে, জাতিসংঘে এ বছরে নারী দিবসের স্লোগান ছিল ‘করোনা বিশ্বে নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ করি, সমতা অর্জনে নারী নেতৃত্ব নিশ্চিত করি’। এই স্লোগানের সঙ্গে মিল রেখে বাংলাদেশ সরকার ‘করোনাকালে নারী নেতৃত্ব, গড়বে নতুন সমতার বিশ্ব’ এই প্রতিপাদ্য নিয়ে দিবসটি পালন করে।

নারীর প্রতি সমতার চ্যালেঞ্জ এখন সবখানেই। পরিবার-সমাজ, সম্পদ-দক্ষতা, উচ্চশিক্ষা-জীবিকা, রাজনৈতিক ক্ষমতা, অবস্থানগত ক্ষেত্রগুলোতে বাংলাদেশের নারীরা অনেকটাই এগিয়েছে। তবে পুরুষের তুলনায় এ সংখ্যা বেশ পিছিয়ে। নারী-পুরুষের সমান সুযোগ, অধিকার ও মর্যাদা নিশ্চিত করা এখনও সমাজের বড় চ্যালেঞ্জ।

নারীদের শিক্ষায় অগ্রগতি অস্বীকার করার সুযোগ নেই। সরকারের শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৯ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রাথমিক শিক্ষায় মোট শিক্ষার্থীর মধ্যে ছাত্রীর হার প্রায় ৫১ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকেও প্রায় অর্ধেক শিক্ষার্থী ছাত্রী। তবে উচ্চশিক্ষায় এখনও ঝরে পড়ার হার বেশি।

সমাজ বা রাষ্ট্রে দু-চার জায়গায় নারীদের ভালো অবস্থান হয়নি তা বলা যাবে না। নারীরা কিন্তু এগিয়ে আসছেন, নেতৃত্ব দিচ্ছেন। যদিও নারীর উন্নয়ন, নারীর ক্ষমতায়ন, নারীর সম-অধিকার-সমমর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য সরকার বিভিন্ন আইন-নীতি, কৌশল প্রণয়ন করেছে এবং তা বাস্তবায়ন করছে।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক

এ বিভাগের আরো খবর