প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস বিশ্ব অর্থনীতির জন্য বড় ধরনের ধাক্কা। পরিস্থিতি সামাল দিতে শক্তিশালী দেশগুলো রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে। সংকটের ঢেউ সমানতালে লেগেছে বাংলাদেশেও। বিশেষ করে নিম্নবিত্ত আর নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর মধ্যে আর্থিক টানাপোড়েন সবচেয়ে বেশি।
সমাজের কিছু ঘটনাপ্রবাহ আর্থিক সংকটের চিত্র একেবারেই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। একটু খেয়াল করে চললেই তা স্পষ্ট বোঝা যায়। অভাব আছে। কিন্তু প্রকাশ্যে হাত পাতা সম্ভব হচ্ছে না এমন লোকজনও সরকারি জরুরি সেবায় ফোন করে রাতে চাল-ডালসহ নিত্যপণ্য নিতে বাধ্য হচ্ছেন।
করোনা পরিস্থিতি শুরুর পর থেকে রাজধানী ঢাকায় বেড়েছে হাত পাতা মানুষের সংখ্যা। প্রতিদিনই এ সংখ্যা বাড়ছে। অলিগলি থেকে শুরু করে রাজপথ পর্যন্ত সবখানেই এখন টাকা চাওয়ার নতুন মুখ। কোথাও ১০ মিনিট দাঁড়ালে অন্তত চারজন এসে টাকা চান! কেউ সরাসরি আর্থিক সহযোগিতা চান। কেউবা মেয়ে বিয়ে, সন্তানের চিকিৎসা, ওষুধ কেনাসহ নানা সংকটের কথা বলে টাকা দাবি করেন।
অনেকে হয়তো বলবেন বিচিত্র এই রাজধানী শহরে কবে হাত পাতা মানুষ ছিল না! এর জবাব হলো, ছিল। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তা বেড়েছে। এতে কোনো সন্দেহ নেই। নিয়মিত ভিক্ষাবৃত্তিতে নাম লেখাচ্ছেন অসহায় মানুষ। বিশেষ করে হাত পাতা নারীর সংখ্যা বেড়েছে বেশি।
রাজধানীর নিউ ইস্কাটন এলাকায় একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করা যাক। এইচপিআরসি হাসপাতালের ঠিক বিপরীতে পদ্মা স্টুডিও ও মিকাডো রেস্টুরেন্টের সামনে প্রতিদিন বিকাল থেকে রাত অবধি একজন নারী তার দুটি শিশু বাচ্চাকে নিয়ে আসেন।
ফুটপাতে ফিডার মুখে চটের ওপর শিশু দুটিকে শুইয়ে রাখেন মা। ফিডারে দুধ থাকে না। পানি। সামান্য কাপড় দিয়ে শিশু দুটির গা ঢাকা থাকে। পাশে বসে মা মানুষের কাছে হাত পাতেন। টাকার জন্য সবার কাছে আকুতি-মিনতি জানাতে থাকেন। কখনও কখনও কান্নায় ভেঙে পড়েন। স্বাভাবিকভাবেই দৃশ্যটি খুবই করুণ। বেদনাদায়ক। সমাজের সব বিবেকবান মানুষের হৃদয়ে এই দৃশ্যটি খুবই নাড়া দেয়। এটাই স্বাভাবিক। করোনা পরিস্থিতির আগে কিন্তু এই স্থানে এমন ভিক্ষাবৃত্তি দেখা যায়নি।
শহরের অভিজাত এলাকা হিসেবে পরিচিত গুলশানে সম্প্রতি এক নারীকে ফুটপাতে তার শিশুসন্তানকে নিয়ে মানুষের কাছে হাত পাততে দেখা গেছে। যা বিভিন্ন গণমাধ্যমে এসেছে। হাত পাতা এই নারীর বক্তব্য হলো- তিনি বাড্ডা এলাকায় একটি গার্মেন্টসে কাজ করতেন। সম্প্রতি তাকে কর্মস্থল থেকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। পরিস্থিতির শিকার হয়ে স্বামী পরিত্যক্তা এই নারী বাঁচার প্রয়োজনে হাত পাততে বাধ্য হয়েছেন।
আরেকটি ঘটনার কথা বলি, রাজধানীর অনেক সিগন্যালে একদল শিশুকে মানুষের কাছে টাকা চাইতে দেখা যায়। এ রকম চিত্র আগেও দেখা গেছে। এখন যেসব কচি মুখের শিশু খালি গায়ে হাত পাতছে, এদের বেশির ভাগ নতুন মুখ। শিশুরা বলছে, সম্প্রতি তারা পরিবারের সঙ্গে ঢাকায় আশ্রয় নিয়েছে। সংসারের চাকা সচল রাখতেই বাবা-মায়ের পরামর্শে তারা রাস্তায় এসেছে! বিষয়টি খুবই উদ্বেগজনক। একদিকে কোমলমতি শিশুদের দিয়ে ভিক্ষাবৃত্তি কোনোভাবেই আইনসিদ্ধ নয়, অপরদিকে এ কাজে নিয়োজিত করায় শিশুদের মনোজগতে বিরূপ প্রভাব পড়বে জীবনের শুরু থেকেই। শিক্ষার মাধ্যমে আলোর পথ সে কখনোই দেখার সুযোগ পাবে না। টাকা চেয়ে বেঁচে থাকা যায় এ বিষয়টি মনের মধ্যে আরও বেশি শেকড় ছড়াবে।
যদি এ পথ থেকে আগামী প্রজন্মের সম্ভবনাময় মুখগুলোকে ফেরানো সম্ভব না হয়, তবে এসব শিশুর স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠার পথ একেবারেই অনিশ্চিত। আস্তে আস্তে এ শিশুদের বিপথে পা বাড়ানোর আশঙ্কা খুবই প্রবল। এমন তো হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। তাদের সুন্দর পরিবেশে বেড়ে ওঠার সুযোগ নিশ্চিত করা গেলে এখান থেকে বেরিয়ে আসতে পারে অনেক মেধাবী মুখ। হয়ে উঠতে পারে আলোকিত মানুষ। সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব করতে পারে অনায়াসে।
বড় কথা হলো, এসব হাত পাতা অসহায় মানুষকে ঘরে ফেরানো রাষ্ট্রের দায়িত্ব। সরকারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সামান্য উদ্যোগেই এসব অসহায় মানুষের আর্থিকভাবে পুনর্বাসন করা যায়। প্রতিটি পরিবারের সমস্যার কথা চিহ্নিত করে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব। তেমনি আর্থিক সংকটের কারণে যেসব এলাকা থেকে এসব ভাসমান মানুষের আসা, সেখানেই তাদের ফেরত পাঠানো যেতে পারে। নিজ এলাকায় ফিরিয়ে এ পরিবারগুলোর জীবন চলা নিশ্চিত করতে খুব বেশি টাকা খরচের প্রয়োজন হয় না।
সবার আগে থাকার জায়গাটি নিশ্চিত করতে হবে। একটি অটো বা ভ্যান, সেলাই মেশিন, দোকান বা পশু পালনের ব্যবস্থা করা গেলেই জীবনের অসহায়ত্ব কেটে যাবে সময়ের এই অসহায় মানুষদের। তবে প্রতিটি পরিবারের শিশুদের শিক্ষার ব্যবস্থা একেবারেই নিশ্চিত করা বাধ্যতামূলক। যেন এসব শিশুকে কোনোভাবেই আর পথে নামতে না হয়। প্রয়োজনে অসহায় ছেলে শিশুদেরও শিক্ষা থেকে ঝরে পড়া কমাতে পরিবারকে বিশেষ প্রণোদনার ব্যবস্থা করতে হবে।
যেসব শিশু বা বয়স্ক ব্যক্তির কোনো অভিভাবক নেই, তাদের সরকারি পরিচর্যা কেন্দ্রে পাঠানো যায়। সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে নগরীর অনেক সড়ক ভিক্ষুকমুক্ত সাইনবোর্ড ঝুলছে ঠিক, কিন্তু বাস্তবতার সঙ্গে সাইনবোর্ডের মিল নেই। তাই সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষকেও এ নিয়ে ভাবতে হবে।
আরেকটি বড় বিষয় হলো, কোভিড পরিস্থিতির কারণে বাংলাদেশে বিদেশি অতিথিদের আনাগোনা তো আছেই। নানা কারণে তারা দেশে আসছেন।
বিদেশিদের সামনে রাস্তায় হাত পাতা মানুষ মানেই- একটি দেশের জন্য কখনোই সুখকর হতে পারে না। কথা হলো- রাস্তায় নতুন এমন মানুষের সংখ্যা সর্বোচ্চ কত হতে পারে? হয়তো ১০ হাজার। আন্তর্জাতিক বিশ্বে রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল রাখতে এই ১০ হাজার মানুষকে রাস্তা থেকে ঘরে ফেরানোর উদ্যোগ নেয়া এখন সময়ের দাবি।
আরেকটি বিষয় মনে রাখা দরকার, মহামারির শুরুর দিকে যে পরিমাণ সাহায্য-সহযোগিতা অসহায় মানুষ পেত, এখন তা একেবারেই কমে গেছে। অর্থাৎ ভিক্ষায় স্বাভাবিক জীবন চলাও অনিশ্চিত। এর মধ্য দিয়ে সমাজের একটি অংশ মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়ার পাশাপাশি পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর তালিকায় নাম লেখাবে। তেমনি অপুষ্টির শিকার চেহারাগুলো সামনের দিনে হয়তো রাস্তাঘাটে আরও বেশি চোখে পড়বে।
ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট এবং পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) যৌথভাবে দরিদ্র মানুষের ওপর করোনাভাইরাসের প্রভাব নিয়ে একটি জরিপ করেছে। গত ৪ থেকে ১২ এপ্রিল পর্যন্ত টেলিফোনে এ জরিপ করা হয়। জরিপে অংশ নেন ৫ হাজার ৪৭১ জন। এতে বলা হয়েছে, গৃহকর্মীদের ৫৭ শতাংশেরই কোনো কাজ নেই।
এই গৃহকর্মীদের ৭৬ শতাংশের আয় কমেছে। ফলে নিম্ন আয়ের অন্যান্য পেশার সঙ্গে যুক্তদের পরিবারের যে ভোগান্তি, একই ভোগান্তি হচ্ছে গৃহকর্মী ও তার পরিবারগুলোর। সরকারি পর্যায়ে অসহায় এসব মানুষের জন্য ছোটখাটো কর্মসংস্থানের সুযোগ নিশ্চিত করা গেলে তারা হয়তো রাস্তায় হাত পাততে আসত না।
লেখক: সাংবাদিক