বিশ্ব শরণার্থী দিবস আজ। এবারের বিশ্ব শরণার্থী দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে- ‘একসঙ্গে আরোগ্য হব, একসঙ্গে শিখব ও একসঙ্গে দীপ্ত হব (টুগেদার উই হিল, লার্ন অ্যান্ড শাইন)।’ দুনিয়াজুড়ে দিবসটি পালনের জন্য জাতিসংঘের একটি শরণার্থী সংস্থা রয়েছে- ইউএনএইচসিআর।
২০০০ সালের ৪ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ২০০১ সালের জুনের ২০ তারিখ থেকে প্রতিবছর আন্তর্জাতিক শরণার্থী দিবস হিসেবে পালন করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। দিনটি বেছে নেয়ার ঐতিহাসিক পটভূমি আছে।
১৯৫১ সালে শরণার্থীদের অবস্থান নির্ণয়বিষয়ক একটি কনভেনশনের ৫০ বছর পূর্তি হয় ২০০১ সালে। যদিও ২০০০ সাল পর্যন্ত আফ্রিকান শরণার্থী দিবস নামে একটি দিবস কয়েকটি দেশে পালিত হতো। সেটিই এখন জাতিসংঘের মাধ্যমে বিশ্ব শরণার্থী দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে বিশ্বজুড়ে।
এ প্রশ্নটি স্বাভাবিকভাবেই সামনে এসে যায়, শরণার্থী কারা? ১৯৫১ সালে জাতিসংঘের শরণার্থী মর্যাদাবিষয়ক সম্মেলনে অনুচ্ছেদ-১-এ-তে শরণার্থীর সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে। কাউকে জাতিগত সহিংসতা, ধর্মীয় উন্মাদনা, জাতীয়তাবোধ, রাজনৈতিক আদর্শ, সমাজবদ্ধ জনগোষ্ঠীর সদস্য হওয়ায় নিজদেশের নাগরিক অধিকার থেকে সরিয়ে দেয়া হয়, ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করা হয় এবং রাষ্ট্র তাকে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হলেই সে শরণার্থী হিসেবে বিবেচিত হবে। এরপর ১৯৬৭ সালের সম্মেলনের খসড়া দলিলে শরণার্থীর এই সংজ্ঞাকে আরেকটু বিস্তৃত করা হয়।
আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকায় অনুষ্ঠিত আঞ্চলিক সম্মেলনে যুদ্ধ ও অন্যান্য সহিংসতায় আক্রান্ত ব্যক্তির নিজ দেশ ত্যাগ করাকেও শরণার্থী হিসেবে অভিহিত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
বিশ্বের মাথাব্যথার অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে শরণার্থী। পৃথিবীতে এখন শরণার্থীর সংখ্যা ৮ কোটি ২০ লাখের বেশি। তার মানে বিশ্বের প্রতি ৯৫ জন নাগরিকের বিপরীতে একজন মানুষ শরণার্থী। করোনা মহামারির এই ক্রান্তিকালে মানুষের সীমিত চলাফেরার মধ্যেও গত এক বছরে বাস্তুচ্যুত হয়েছে ১ কোটি ১২ লাখ মানুষ।
এ হিসাব দিয়েছে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর। এর মধ্যে অর্ধেকের বেশি অর্থাৎ ৪ কোটি ৮০ লাখ মানুষ অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়েছে। করোনাভাইরাসের বিধিনিষেধ শিথিল হয়ে গেলে পৃথিবীজুড়ে সংঘাত আরও বেড়ে যেতে পারে। ইউএনএইচসিআর আশঙ্কা প্রকাশ করেছে, বিশ্বের শরণার্থী মানুষের সংখ্যা ১০ কোটি ছাড়িয়ে যাওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র।
বর্তমানে বিশ্বের শরণার্থী সংখ্যা আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে। এই বিশাল শরণার্থী জনগোষ্ঠীর অর্ধেকই শিশু। তবে উন্নত দেশগুলোতে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় পাওয়া মানুষের সংখ্যা কম। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বিশ্বের প্রায় শতকরা ৮৫ ভাগ শরণার্থীর আশ্রয় মিলেছে উন্নয়নশীল দেশে।
স্বদেশ হারিয়ে দুই-তৃতীয়াংশই শরণার্থী হয়েছে মাত্র পাঁচটি দেশ থেকে। এর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে সিরিয়া। বিগত ১০ বছরের গৃহযুদ্ধে দেশটির ১ কোটি ৩৫ লাখ মানুষ ঘরছাড়া। যা দেশটির মোট জনসংখ্যার অর্ধেক। বাকি চারটি দেশ হচ্ছে ভেনেজুয়েলা, আফগানিস্তান, দক্ষিণ সুদান ও মিয়ানমার। তবে এত সব নিরাশার মধ্যেও রয়েছে কিছু আশার কথা। ইউএনএইচসিআরের প্রতিবেদন অনুসারে জানা যায়, কিছু দেশ এই শরণার্থীদের আশ্রয় দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র এ বছর ৬২ হাজার ৫০০ এবং ২০২২ সালে সোয়া লাখ শরণার্থীকে আশ্রয় দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। কলম্বিয়া জানিয়েছে, ভেনেজুয়েলার ১০ লাখের বেশি শরণার্থীকে স্থায়ী মর্যাদা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দেশটি।
শরণার্থী সংকট থেকে মুক্ত নয় বাংলাদেশও। বেশ কয়েক বছর ধরে রোহিঙ্গা শরণার্থী নিয়ে বেশ বিপাকেই আছি আমরা। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর সহিংস হামলা চালায় সে দেশের সেনারা। গ্রামের পর গ্রাম ধ্বংস করে দেয়। সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয় নির্যাতিত রোহিঙ্গারা।
এই জনগোষ্ঠীর ওপর হামলার প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রেখেছিল বাংলাদেশ। দেশের সীমান্ত খুলে দিয়ে কক্সবাজারে আশ্রয় দেয়া হয় মিয়ানমারের নির্যাতিত এই জনগোষ্ঠীকে। এ দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওই বছরের ১২ সেপ্টেম্বর নিজের চোখে দুর্দশাগ্রস্ত রোহিঙ্গাদের দেখতে কক্সবাজার যান। তাদের প্রতি সমবেদনা জানান এবং বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহায়তা দেয়ার আশ্বাস দেন। শুধু তা-ই নয়, বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া শরণার্থীদের জন্য যা কিছু প্রয়োজন, তাৎক্ষণিকভাবে তাদের জন্য খাদ্য, বাসস্থান, চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করেন।
আগ্রহী বিদেশি সাহায্য সংস্থাগুলোকেও রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কাজ করার সুযোগ দেন। প্রধানমন্ত্রীর এই তাৎক্ষণিক মানবিক সিদ্ধান্ত পুরো বিশ্বের নজর কাড়ে এবং বিপুল প্রশংসিত হয়। তবে এখানেই থেমে থাকেননি প্রধানমন্ত্রী।
২০১৭ সালের ২২ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭২তম অধিবেশনে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে তিনি পাঁচ দফা প্রস্তাবও করেন। তার এই প্রস্তাবনাগুলো ছিল অনতিবিলম্বে ও চিরতরে মিয়ানমারের সহিংসতা এবং জাতিগত নিধন নিঃশর্তে বন্ধ করা, দ্রুত মিয়ানমারে জাতিসংঘ মহাসচিবের নিজস্ব অনুসন্ধানী দল পাঠানো, জাতি-ধর্মনির্বিশেষে সব নাগরিকের নিরাপত্তা বিধানের লক্ষ্যে মিয়ানমারের ভেতর জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে সুরক্ষাবলয় গড়ে তোলা, রাখাইন রাজ্য থেকে জোর করে তাড়িয়ে দেয়া সব রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে তাদের নিজেদের বাড়িতে প্রত্যাবর্তন ও পুনর্বাসন নিশ্চিত করা এবং কফি আনান কমিশনের সুপারিশমালা নিঃশর্ত, পূর্ণ এবং দ্রুত বাস্তাবায়ন নিশ্চিত করা।
এরপর মিয়ানমারে রোহিঙ্গাসহ অন্যান্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুর ওপর মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য ২০১৯ সালের ২৭ ডিসেম্বর নিন্দা প্রস্তাব পাস করে জাতিসংঘ। তবে জাতিসংঘে প্রস্তাব উত্থাপন করেই বসে থাকেনি বাংলাদেশ। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে থাকে।
রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর নিপীড়নমূলক আচরণ বন্ধে ২০১৯ সালের ১১ নভেম্বর গাম্বিয়ার মামলার পরিপ্রেক্ষিতে ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস (আইসিজে) ২৩ জানুয়ারি ২০২০ সালে একটি জরুরি ‘সামরিক পদক্ষেপ’ ঘোষণা দেয়। সব মিলিয়ে গত চার বছর ধরে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে সফলতার সঙ্গে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া ১২ লাখের বেশি রোহিঙ্গা মানবিক সহায়তা পেয়ে আসছে।
রোহিঙ্গাদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে দুটি তারিখ ঘোষণা হলেও সেটা ব্যর্থ হয়। রাখাইন প্রদেশে প্রত্যাবাসন সহায়ক পরিবেশ তৈরিতে মিয়ানমার ব্যর্থ হওয়ায় রোহিঙ্গারা ফেরত যেতে অস্বীকৃতি জানায়। এর মধ্যেই করোনা মহামারির কবলে পড়ে যায় দুনিয়া। মিয়ানমারের রাজনৈতিক পরিবেশও বদলে যায়। নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে সামরিক সরকার এখন ক্ষমতায়। তবু থেমে নেই বাংলাদেশ। দেশের ভেতরে ও বাইরে সমানভাবে শরণার্থী রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যেই রোহিঙ্গাদের জন্য আরও উন্নত আবাসস্থল তৈরি করা হয়েছে ভাসানচরে। কিছু রোহিঙ্গাকে সেখানে স্থানান্তরও করা হয়েছে। প্রথমদিকে কেউ কেউ এ স্থানান্তরে আপত্তি জানালেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে এই স্থানান্তর প্রশংসিত হয়েছে। হবেই তো।
যেখানে সুদানের শতকরা প্রায় ৮০ ভাগ শরণার্থীই দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে। খাদ্য আর বাসস্থানের মতো অতি জরুরি দুটি মৌলিক অধিকার থেকেও তারা বঞ্চিত। ওদিকে সিরিয়া, ইরাকসহ কয়েকটি দেশ থেকে ইউরোপের ২৭টি উন্নত দেশও ১০ লাখ শরণার্থীর ঢল সামলাতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে। সেখানে বিপুল ঘনবসতির বাংলাদেশ ১২ লাখ শরণার্থীর খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান জুগিয়ে অনবরত চিকিৎসা ও শিক্ষাসেবা দিয়ে যাচ্ছে। সুপরিকল্পিত ও যোগ্য নেতৃত্ব ছাড়া এই অসাধ্য সাধন অসম্ভব। পাশাপাশি রোহিঙ্গা সংকটের স্থায়ী সমাধানে কূটনৈতিক তৎপরতাও চালিয়ে যেতে হচ্ছে দেশকে। তবে বাংলাদেশ কেবল রোহিঙ্গা নয়, বিশ্বের অন্যান্য শরণার্থী সমস্যার সমাধানও চায়।
লেখক: শিশুসাহিত্যিক, কলাম লেখক।