বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

একুশ দফা-ছয় দফা ও স্বাধীনতা

  •    
  • ১৮ জুন, ২০২১ ১৬:০৫

বঙ্গবন্ধুর চিন্তায় ছিল বাঙালির আর্থসামাজিক মুক্তি। তিনি নির্বাচনি প্রচারে ২১ দফা কর্মসূচি বাস্তবায়নের ওপর জোর দিতে থাকেন। তার লক্ষ্য ছিল- এ কর্মসূচিকে জনগণের কর্মসূচিতে পরিণত করতে হবে। আওয়ামী লীগ যদি ক্ষমতায় না-ও থাকে, তাহলেও যেন ২১ দফা কর্মসূচি কেউ অস্বীকার করতে না পারে।

যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন ও ২১ দফা একসঙ্গে উচ্চারিত হয়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ৭ বছরেরও কম সময়ের মধ্যে অনুষ্ঠিত এ নির্বাচনে পাকিস্তান আন্দোলনে মুখ্য ভূমিকা রাখা দল মুসলিম লীগ নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। কয়েকটি দলের যুক্তফ্রন্টকে সে সময় হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর যুক্তফ্রন্ট হিসেবেও অভিহিত করা হতো। শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক ব্রিটিশ আমলে একাধিকবার অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীও এ পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন ১৯৪৬ সালে। এর আগে শেরেবাংলার মন্ত্রিসভাতেও তিনি ছিলেন।

১৯৩৮ সালে দুজনে এসেছিলেন গোপালগঞ্জে, যেখানে ১৮ বছর বয়সী মুজিবকে দেখে মুগ্ধ হন। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন প্রতিষ্ঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রথম সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর টাঙ্গাইলের একটি আসন থেকে পূর্ববঙ্গ আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু মুসলিম লীগ সরকার নানা কূটকৌশল করে তার সদস্যপদ খারিজ করে দেয়। পরে আর কখনও তিনি পার্লামেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হননি। কিন্তু যেকোনো নির্বাচনের প্রচারকাজে তার অংশগ্রহণ অপরিহার্য বিবেচিত হতো। তিনি জনগণকে উদ্বুদ্ধ, অনুপ্রাণিত করতে পারতেন।

যুক্তফ্রন্টের শরিক দলগুলোর প্রার্থীরা প্রত্যেকেই চেয়েছেন এই তিন জনপ্রিয় নেতা তাদের আসনে যেন প্রচারকাজের জন্য যান। সে সময় ৩৪ বছর বয়স্ক শেখ মুজিবকেও তারা চাইতেন নিজ নিজ এলাকায় বক্তা হিসেবে।

১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির ঐতিহাসিক আন্দোলনের পর থেকে মুসলিম লীগের পায়ের নিচে মাটি ছিল না। তারা হয়ে পড়ে জনধিক্কৃত দল। আওয়ামী লীগ তখন দ্রুত শক্তি সঞ্চয় করছে। তরুণ শেখ মুজিব বারবার সভা-সমাবেশ করছেন জেলা ও মহকুমাগুলোতে।

আওয়ামী লীগের কমিটি গঠনের পাশাপাশি ছাত্রলীগের সংগঠন শক্তিশালী করার প্রতিও তার নজর ছিল। ভাষা আন্দোলনের কারণে ছাত্রসমাজের ওপর জনগণের আস্থা ও মর্যাদা ছিল আকাশছোঁয়া। যুক্তফ্রন্টের পক্ষে নির্বাচনের প্রচারে তারা বড় ভূমিকা রাখবে, এটা বোঝা যাচ্ছিল।

মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ, গণতন্ত্রী পার্টি, শেরেবাংলার কৃষক শ্রমিক পার্টি, নেজামে ইসলামী ও কমিউনিস্ট পার্টি প্রভৃতি দল নিয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠনের জনদাবি ছিল। তবে নেজামে ইসলামীর নেতারা কমিউনিস্ট পার্টিকে যুক্তফ্রন্টে নেয়া চলবে না- এ শর্ত দিলেন এবং শেরেবাংলা দৃঢ়ভাবে তাদের পক্ষে দাঁড়ালেন।

মুসলিম লীগ নির্বাচনে হেরে যাবে, জনমনে এ ধারণা ছিল। এ দলের অনেক নেতাও সেটা বুঝতেন। তারা যুক্তফ্রন্টের বিভিন্ন দলে নাম লেখাতে শুরু করেন। বঙ্গবন্ধু আদর্শভিত্তিক ঐক্যের পক্ষে ছিলেন। কেবল মুসলিম লীগকে হারাতে হবে, এর মধ্যেই সীমিত থাকতে চাননি তিনি। অসমাপ্ত আত্মজীবনী গ্রন্থে লিখেছেন-

‘ক্ষমতায় যাওয়া যেতে পারে, তবে জনসাধারণের জন্য কিছু করা সম্ভব হবে না, আর এ ক্ষমতা বেশি দিন থাকবেও না। যেখানে আদর্শের মিল নাই, সেখানে ঐক্যও বেশি দিন থাকে না।’ [পৃষ্ঠা ২৫০]

তিনি আরও লিখেছেন-

‘আমি চেষ্টা করতে লাগলাম যাতে সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে যুক্তফ্রন্ট চলে। দুই দিন না যেতেই খেলা শুরু হল। নামও শুনি নাই এমন দলের আবির্ভাব হল।’ [পৃষ্ঠা ২৫২]

যুক্তফ্রন্টের কর্মসূচি নির্ধারিত হয় ২১ দফা। অসমাপ্ত আত্মজীবনী গ্রন্থে আরও জানাচ্ছেন-

‘আবুল মনসুর আহমদ বিচক্ষণ লোক সন্দেহ নাই। তিনি ব্যাপারটি বুঝতে পারলেন এবং তাড়াতাড়ি কফিলউদ্দিন চৌধুরীর সাহায্যে একুশ দফা প্রোগ্রামে দস্তখত করিয়ে নিলেন হক সাহেবকে দিয়ে। তাতে আওয়ামী লীগের স্বায়ত্তশাসন, বাংলা ভাষা রাষ্ট্রভাষা, রাজবন্দিদের মুক্তি এবং আরও কতকগুলি দাবি মেনে নেওয়া হল। আমরা যারা এ দেশের রাজনীতির সাথে জড়িত আছি তারা জানি, এই দস্তখতের কোনো অর্থ নাই অনেকের কাছে।’ [পৃষ্ঠা ২৫১]

বঙ্গবন্ধু ছাত্রজীবন থেকেই মহৎ কিছু লক্ষ্য সামনে রেখে রাজনৈতিক তৎপরতা পরিচালনা করেছেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাত্র সাড়ে চার মাসের মধ্যে তিনি ছাত্রলীগ গঠন করেন। সে সময় তার বয়স ২৮ বছরও পূর্ণ হয়নি। কিন্তু বুঝতে পারেন, পাকিস্তানের ক্ষমতায় যারা বসেছে তারা পূর্ব বাংলাকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে দমিয়ে রাখতে চাইছে। এমনকি মাতৃভাষার অধিকারও কেড়ে নিতে চায়। উর্দু চাপিয়ে দেয়া হলে চাকরি ও ব্যবসায় বাঙালিরা দারুণভাবে পিছিয়ে পড়বে।

২১ দফায় এসব দাবি স্থান পায়। কিন্তু শেরেবাংলার দল কৃষক শ্রমিক পার্টি এবং নেজামে ইসলামীর মতো দল কেবল ক্ষমতা চাইছিল- মুসলিম লীগের পরিবর্তে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা হলেই তারা খুশি। মন্ত্রী-এমপিরা প্রোটোকল সুবিধা পাবে, ব্যবসা করতে পারবে, লাইসেন্স-পারমিটে অগ্রাধিকার পাবে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর চিন্তায় ছিল বাঙালির আর্থসামাজিক মুক্তি। তিনি নির্বাচনি প্রচারে ২১ দফা কর্মসূচি বাস্তবায়নের ওপর জোর দিতে থাকেন। তার লক্ষ্য ছিল- এ কর্মসূচিকে জনগণের কর্মসূচিতে পরিণত করতে হবে। আওয়ামী লীগ যদি ক্ষমতায় না-ও থাকে, তাহলেও যেন ২১ দফা কর্মসূচি কেউ অস্বীকার করতে না পারে।

তিনি লিখেছেন-

‘কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন দল জানেন পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ স্বায়ত্তশাসনের জন্য জনমত সৃষ্টি করেছে। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে যে অর্থনৈতিক বৈষম্য দিন দিন বেড়ে চলেছে- চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য ও মিলিটারিতে বাঙালিদের স্থান দেওয়া হচ্ছে না- এ সম্বন্ধে আওয়ালী লীগ সংখ্যাতত্ত্ব দিয়ে কতগুলি প্রচারপত্র ছাপিয়ে বিলি করেছে সমস্ত দেশে। সমস্ত পূর্ব বাংলায় গানের মারফতে গ্রাম্য লোক কবিরা প্রচারে নেমেছেন।’ [পৃষ্ঠা ২৫৮]

বঙ্গবন্ধুর আশঙ্কা যথার্থ প্রমাণিত হয়েছিল- যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা গঠনের মাস দুয়েকের মধ্যেই তা ভেঙে দিয়ে গভর্নরের শাসন জারি করা হয়। রাজনৈতিক তৎপরতা নিষিদ্ধ হয়। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক জনগণকে প্রতিবাদের ডাক দেননি। শত শত নেতা-কর্মী গ্রেপ্তার হন। মন্ত্রীদের মধ্যে গ্রেপ্তার কেবল কনিষ্ঠতম সদস্য শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি অসমাপ্ত আত্মজীবনী গ্রন্থে দুঃখ করে লিখেছেন-

‘অযোগ্য নেতৃত্ব, নীতিহীন নেতা ও কাপুরুষ রাজনীতিবিদদের সাথে কোনো দিন একসাথে দেশের কোনো কাজে নামতে নেই। তাতে দেশসেবার চেয়ে দেশের ও জনগণের সর্বনাশই বেশি হয়।’ [পৃষ্ঠা ২৭৩]

পরের বছরগুলোতে তিনি স্বায়ত্তশাসনের দাবি নিয়ে আরও সোচ্চার হন। ১৯৫৬ সালের সেপ্টেম্বরে পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ নেতা আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে মন্ত্রিসভা গঠিত হলে নতুন করে স্বায়ত্তশাসনের ইস্যু সামনে আসে।

১৯৫৭ সালের এপ্রিল মাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মহিউদ্দিন আহমদ ও অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের উদ্যোগে পূর্ব পাকিস্তান আইনসভায় স্বায়ত্তশাসনের প্রস্তাব পাস হয়। এ আলোচনায় অংশ নিয়ে বঙ্গবন্ধু ‘পাকিস্তানে দুই অর্থনীতি’ বা টু ইকোনমি রয়েছে বলে মন্তব্য করেন। এ সময় তিনি দলীয় সংগঠনের কাজে বেশি করে সময় দেয়ার জন্য আতাউর রহমানের মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন। দলের স্বার্থে মন্ত্রিত্ব ত্যাগ- এমন নজির পাকিস্তানে নেই, বিশ্বেও বিরল।

১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি হয়। পরের বছর সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা। সর্বমহলে ধারণা ছিল নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হবে এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী হবেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। এটা ঠেকাতেই সামরিক শাসন জারি করা হয়।

এ ঘটনায় বঙ্গবন্ধু শিক্ষা নেন। তিনি ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে পাকিস্তানের ক্ষমতার দুর্গ শহর হিসেবে পরিচিত লাহোরে বসে স্বায়ত্তশাসনের ছয় দফা কর্মসূচি উত্থাপন করেন। সাবেক মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খানকে এ কর্মসূচি উত্থাপনের জন্য বঙ্গবন্ধু অনুরোধ করলে তিনি বলেছিলেন, ‘মজিবর মিয়া, এ কর্মসূচি দিলে আমিও ফাঁসিতে ঝুলব, তোমাকেও লটকাবে।’

কিন্তু বঙ্গবন্ধু ছিলেন অদম্য। তার সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠছিল স্বাধীন বাংলাদেশ। তিনি ২১ দফার ১৯ দফায় স্বায়ত্তশাসনের সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব থেকে মৌলিকভাবে সরে আসেন।

২১ দফায় ছিল- ঐতিহাসিক লাহোর সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে প্রতিরক্ষা, বৈদেশিক সম্পর্ক এবং মুদ্রাব্যবস্থা ছাড়া অন্য সব বিষয়ে পূর্ব বাংলার স্বাধিকার প্রতিষ্ঠা। প্রতিরক্ষা বিষয়েও কেন্দ্রে যেমন থাকবে ‘নেভি হেডকোয়ার্টার্স’ এবং পূর্ববঙ্গকে অস্ত্রের ব্যাপারে স্বনির্ভর করার জন্য তেমনি পূর্ববঙ্গে হবে ‘অস্ত্র কারখানা’ প্রতিষ্ঠা। আনসারদের পুরোপুরি সৈনিকরূপে স্বীকৃতি।

ছয় দফায় বঙ্গবন্ধু অর্থ কেন্দ্রের হাত থেকে প্রদেশ বা রাজ্যের হাতে নিয়ে আসার কথা বলেন। তিনি বলেন, দুটি প্রদেশে পৃথক মুদ্রা থাকবে। অথবা এক মুদ্রা হবে, কিন্তু দুই প্রদেশে থাকবে দুটি রিজার্ভ ব্যাংক। এক প্রদেশ থেকে অন্য প্রদেশে মুদ্রা পাচার বন্ধ করা হবে। রাজস্ব ধার্য ও আদায়র ক্ষমতা থাকবে প্রদেশের হাতে। প্রতিটি প্রদেশ যে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করবে তার নিয়ন্ত্রণ রাখার ব্যবস্থা তাদের হাতেই থাকবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার বলেছেন, ছয় দফা বলবৎ হলে পাকিস্তানে এমনকি শিথিল ফেডারেশনও অসম্ভব ছিল।

বঙ্গবন্ধু ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বরের নির্বাচনকে ছয় দফার প্রশ্নে গণভোট ঘোষণা করেন এবং জনগণ তাকে ম্যান্ডেট প্রদান করে। পাকিস্তানিরা এ ম্যান্ডেট মানতে অস্বীকার করে এবং গণহত্যা চাপিয়ে দেয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং জনগণ তার কথামতো ‘যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করে’ স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করে।

লেখক: মুক্তিযোদ্ধা, একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক।

এ বিভাগের আরো খবর