বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

এমপি, ইউএনও ও আমলাতন্ত্র

  •    
  • ১৫ জুন, ২০২১ ১৬:৩৩

২০১২ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন চলাকালে শিকাগোর নির্বাচন কমিশনারের কার্যালয়ে গিয়েছিলাম একটি কাজে। তখন ওই অফিসের দ্বিতীয় প্রধান ব্যক্তিকে দেখেছি একজন বয়স্ক নাগরিককে লিফট পর্যন্ত এগিয়ে দিচ্ছেন। এটুকু কাজ করতে ওই অফিসারের সময় লেগেছে বড়জোর দুই মিনিট। কিন্তু তার এই দুই মিনিটের আচরণ দেখে এতটাই মুগ্ধ হয়েছি যে, ৯ বছর আগের সেই দৃশ্যটি এখনও চোখে ভাসছে।

প্রবীণ সাংবাদিক আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী একটি জাতীয় দৈনিকে (দৈনিক ইত্তেফাক, ৬ জুন ২০২১) এ সময়ে আমলাদের ক্ষমতা ও প্রভাব নিয়ে লিখতে গিয়ে এক জায়গায় উল্লেখ করেছেন, এখনকার মন্ত্রী, উপমন্ত্রীদের অধিকাংশই কোনো দিন মন্ত্রী হওয়ার আশা স্বপ্নেও দেখেননি। সে যোগ্যতা ও সাহসও তাদের নেই। তবু তারা মন্ত্রী হয়েছেন। আমলাদের কোনো নির্দেশ দেয়ার সাহস তাদের নেই, যোগ্যতাও তাদের নেই। তাদের অনেকেই কোনো কাজের জন্য অনুরোধ জানালে বলেন, দেখি প্রধানমন্ত্রী কী বলেন। অর্থাৎ সব ক্ষমতা এবং সব দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রীর।

তাহলে তারা আছেন কেন—এর দুই দিন বাদেই আমলাতন্ত্র নিয়ে রসিকতার ছলে একটি নির্মম মন্তব্য করেছেন মন্ত্রিসভার জেন্টেলম্যান তথা সজ্জন ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। তিনি বলেছেন, ‘আমলাতন্ত্র সব সময়ই থাকবে। ফেরাউনও অত্যন্ত শক্তিশালী শাসক ছিলেন। তিনিও আমলাতন্ত্রের বাইরে যেতে পারেননি। আমলাতন্ত্রের বিকল্প বের করতে পারেননি। সোভিয়েতরা চেষ্টা করে বের করতে পারেননি। চীনারাও বের করতে পারেননি। এমনকি খলিফারাও বের করতে পারেননি।’

আমলাতন্ত্র নিয়ে পরিকল্পনামন্ত্রীর এই মন্তব্যের পাঁচ দিনের মাথায় একজন মাঠপর্যায়ের আমলার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে অভিযোগ দিয়েছেন সিলেট-২ (বিশ্বনাথ-ওসমানীনগর) আসনের সংসদ সদস্য মোকাব্বির খান। কোনো একজন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) বিরুদ্ধে দুদকে একজন আইনপ্রণেতার এ রকম অভিযোগের ঘটনা বিরল। শুধু তা-ই নয়, অভিযোগ জানানোর পরে সাংবাদিকদের কাছে এমপি মোকাব্বির খান যে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন, সেটি আরও ভয়াবহ।

তিনি বলেছেন, ‘দেশ কীভাবে চলছে এইটা অনুমান করেন। আমি একজন সংসদ সদস্য হয়েও ইউএনওর বিরুদ্ধে বিভাগীয় কমিশনারের কাছে জানিয়েছি। প্রধানমন্ত্রীর কাছে দিয়েছি। উনিও বলেছেন, বিষয়টি খতিয়ে দেখবেন। কিন্তু এখনও আমার সব জায়গায় চেষ্টা চালিয়ে যেতে হচ্ছে এবং শেষ পর্যন্ত হয়তো আমাকে রিট করতে হবে।’

এই আইনপ্রণেতা আরও বলেন, ‘দেশে অসৎ আমলা, অসৎ ব্যবসায়ী এবং অসৎ কিছুসংখ্যক রাজনীতিবিদ এদের সমন্বয়ে যে সিন্ডিকেট হয়েছে। এইটা অত্যন্ত শক্তিশালী। এদের কাছে প্রধানমন্ত্রী জিম্মি, মন্ত্রিপরিষদ জিম্মি, সংসদ জিম্মি, এমপিরাও জিম্মি এবং সর্বোপরি জনগণ জিম্মি।’

গণমাধ্যমের খবর বলছে, এমপি মোকাব্বিরের নির্বাচনি এলাকায় একটি টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের জন্য জায়গা অধিগ্রহণ ইস্যুতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নির্দেশ মানছেন না। এ বিষয়ে সংসদ সদস্যের অভিযোগ, ইউএনও সরকারি নীতিমালা সুস্পষ্টভাবে লঙ্ঘন করে যাচ্ছেন। তিনি দুর্নীতিবাজদের মদদ দিচ্ছেন।

এ ঘটনার সত্যতা কতটুকু তা সঠিক তদন্ত হলেই জানা যাবে। তবে একজন আইনপ্রণেতাকে যদি ইউএনওর মতো মাঠ প্রশাসনের কোনো সরকারি কর্মচারীর বিরুদ্ধে নানা জায়গায়, এমনকি খোদ প্রধানমন্ত্রীর কাছেও অভিযোগ জানাতে হয়, তাহলে এটি বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, দেশে আমলাতন্ত্র কী ভয়াবহ শক্তিশালী হয়ে উঠেছে।

দেশের আমলাতন্ত্র কতটা শক্তিশালী হয়েছে, এর প্রমাণ নানা ঘটনায় পাওয়া যায়। এর পেছনে সুস্পষ্টভাবে বেশ কিছু কারণও রয়েছে। যার একটি বড় কারণ আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী উল্লেখ করেছেন। এর বাইরে আরও অনেক কারণ রয়েছে। যার সবগুলো হয়তো এখানে উল্লেখ করা সম্ভব নয়।

সম্প্রতি আমলাদের মধ্যে, বিশেষ করে মাঠ প্রশাসনের কর্মচারীদের মধ্যে ‘স্যার’ ও ‘ভাই’ সম্বোধন ইস্যুতে এমন সব ঘটনা ঘটছে, যা শুধু অনাকাঙ্ক্ষিতই নয়, বরং এই ঘটনাগুলো আমাদের যে মূল প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে তা হলো, সংবিধানের ভাষায় যে জনগণ হচ্ছে প্রজাতন্ত্রের মালিক এবং যাদের করের পয়সায় সরকারি কর্মচারীদের বেতন হয়, সেই জনগণই কেন তাদের সেবক সরকারি কর্মচারীদের ‘স্যার’ সম্বোধন করবে?

বরং হওয়ার কথা তো উল্টো। রাষ্ট্রের কোনো নাগরিক সরকারি অফিসে কোনো সেবার জন্য গেলে সংশ্লিষ্ট অফিসারেরই উচিত তাকে স্যার বলে সম্বোধন করা এবং তিনি তার জন্য কী করতে পারেন—বিনয়ের সঙ্গে সেটি জানতে চাওয়া। এই চাওয়াটা খুব অমূলক বা অযৌক্তিক নয়।

অথচ বাস্তবতা এখন এমন দাঁড়িয়েছে যে, সরকারি অফিসে কোনো কাজের জন্য যাওয়া মানে তাকে নিঃসন্দেহে কোনো না কোনো হয়রানির মধ্যে পড়তে হবে। হয় ঘুষ দিতে হবে, নয়তো যে কাজ এক দিনে হওয়ার কথা, সেই কাজের জন্য দিনের পর দিন ঘুরতে হবে। সরকারি কর্মচারীদের গাফিলতি, অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতার কারণে সাধারণ মানুষের জীবন থেকে প্রতিদিন যে কত মূল্যবান সময় নষ্ট হচ্ছে, এর হিসাব কে রাখে?

অথচ সভ্য রাষ্ট্রে কোনো সিনিয়র সিটিজেন সরকারি অফিসে সেবা নিতে গেলে যথেষ্ট বড় পদের কর্মকর্তাও উঠে দাঁড়িয়ে তাকে সম্মান জানান এবং চেয়ার এগিয়ে দেন। ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন দেশে এই প্র্যাকটিস দেখেছি এবং মেলানোর চেষ্টা করেছি, আমাদের দেশের সরকারি কর্মচারীরা নাগরিকদের সঙ্গে কী আচরণ করেন!

স্মরণ করতে পারি, ২০১২ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন চলাকালে শিকাগোর নির্বাচন কমিশনারের কার্যালয়ে গিয়েছিলাম একটি কাজে।

তখন ওই অফিসের দ্বিতীয় প্রধান ব্যক্তিকে দেখেছি একজন বয়স্ক নাগরিককে লিফট পর্যন্ত এগিয়ে দিচ্ছেন। এটুকু কাজ করতে ওই অফিসারের সময় লেগেছে বড়জোর দুই মিনিট। কিন্তু তার এই দুই মিনিটের আচরণ দেখে এতটাই মুগ্ধ হয়েছি যে, ৯ বছর আগের সেই দৃশ্যটি এখনও চোখে ভাসছে।

আমাদের সরকারি কর্মচারীদের কাছ থেকে আমরা কি এই আচরণ প্রত্যাশা করতে পারি? কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে বিসিএস ক্যাডার হওয়ার পরে তাদের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ বা শরীরী ভাষা বদলে যায়।

তাদের কাছে যখন তাদের বাবা-মায়ের বয়সী কোনো নাগরিকও সেবা নিতে যান, উঠে দাঁড়ানো তো দূরে থাক, তাদের সঙ্গে চাকর-বাকরের মতো আচরণ করেন। অথচ জনগণের প্রতি তাদের আচরণ কেমন হতে হবে, সেই নির্দেশনা স্বাধীনতার পরেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু সুস্পষ্টভাবে দিয়েছিলেন। কিন্তু তাদের অধিকাংশই সেই নির্দেশনা মানেননি বা এখনও মানেন না।

অবশ্য গণহারে সব সরকারি কর্মচারী নিশ্চয়ই খারাপ নন। প্রশ্ন হলো, সেই ভালো-মন্দের অনুপাতটা কত? নিশ্চয়ই অনেক ভালো আমলা আছেন। সে রকমই একজন ভালো আমলা সম্প্রতি আমলাতন্ত্রের দুটি বৈশিষ্ট্যের কথা লিখেছেন-

১. আমলারা নিজেদের স্বার্থে মিথ্যা বলতে কখনও পিছপা হন না। ২. একজন আমলা কোনো ভুল পদক্ষেপ নিয়ে ফেললে তারা সেটা স্বীকার করবেন না; বরং পদক্ষেপটি যে সঠিক ছিল, এটা প্রমাণের জন্য পুরো আমলাতন্ত্র একযোগে ঝাঁপিয়ে পড়বে।

অনেক সময় সরকারের আচরণেও মনে হয়, তারা বুঝি গণকর্মচারীদের কাছে জিম্মি। বিশেষ করে প্রতিবছর যখন ডিসি সম্মেলন হয়, তখন সেখানে ডিসিরা যেসব দাবিদাওয়া তোলেন (এমনকি তারা বিচারিক ক্ষমতাও চান) তাতে মনে হয়, রাজনীতিবিদরা নন, বরং দেশটা আমলারাই চালান।

বাস্তবতা হয়তো সে রকমই। কিন্তু এখানে পলিটিক্যাল লিডারশিপের দায়িত্ব অনেক। তাদের শরীরী ভাষা আর আচার-আচরণে যদি প্রশাসনের লোকেরা ভয় না পায়, যদি কর্মচারীরা মনে করে যে সরকার তাদের ক্ষমতায় ভর করে টিকে আছে, তাহলে প্রশাসনের শৃঙ্খলা বজায় রাখা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। কিন্তু কেন শরীরী ভাষা সে রকম হয় না—এর ব্যাখ্যা প্রবীণ সাংবাদিক আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী দিয়েছেন।

ফলে আমরা যখন আমলাতন্ত্রের মানবিকীকরণ বা সরকারি কর্মচারীদের কাছ থেকে মার্জিত আচরণের কথা লিখি, তখন এ প্রশ্নটিও সামনে চলে আসে যে, কেন তারা নিজেদের জনগণের সেবক না ভেবে প্রভু ভাবছে? কেন তারা প্রত্যাশা করে যে, সবাই তাদের ‘স্যার’ বলবে? কেন তারা জনগণের করের পয়সায় বেতন নিয়ে সেই জনগণকেই সেবা দেয়ার বিনিময়ে তাদের কাছ থেকে ঘুষ নিতে লজ্জাবোধ করে না?

কেন তারা মনে করে বা কেন তাদের মনে এই বিশ্বাস গেঁথে গেল যে, তারা দিনের পর দিন দুর্নীতি ও অনিয়ম করে গেলেও সেটার কোনো বিচার হবে না?

সুতরাং পুরো প্রশাসনযন্ত্র যেভাবে শক্তিশালী হয়েছে, তাতে সিলেটের এমপি মোকাব্বির খান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মতো একজন মাঠ প্রশাসনের কর্মচারীর বিরুদ্ধে দুদকসহ বিভিন্ন জায়গায় যে ঘোরাঘুরি করছেন, আখেরে হয়তো কিছুই হবে না। বড়জোর তাকে অন্য কোনো উপজেলার ইউএনও হিসেবে বদলি করে দেয়া হবে। আর এমপি সাহেবও হয়তো ভাববেন, তিনি খুব জিতে গেছেন।

লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।

এ বিভাগের আরো খবর