বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

সরকারের প্রতিজ্ঞার বিপরীতে সংসদীয় কমিটির প্রস্তাব

  • লীনা পারভীন   
  • ১৫ জুন, ২০২১ ১৪:৩০

বর্তমান সরকারের অন্যতম একটি ম্যান্ডেট হচ্ছে নারীর ক্ষমতায়ন। এরই অংশ হিসেবে প্রশাসনের বিভিন্ন জায়গায় নারীদের পদায়ন করা হয়েছে। নারীর ক্ষমতায়নকে আশ্রয় করে বাংলাদেশ মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল অর্জন করেছে। বর্তমানে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। ২০৪১ সালে উন্নত দেশের স্বপ্নও দেখছি যেখানে নারীর ক্ষমতায়ন একটি অন্যতম শর্ত।

বীর মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যুর পর গার্ড অব অনার দেয়ার ক্ষেত্রে নারী ইউএনও চায় না মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি। এমন একটি সংবাদ দেখার পর ভাবছি তারা আর কোথায় কোথায় নারীদের দেখতে চায় না? কমিটির এক সভায় নারীর বিকল্প নির্ধারণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে। এর কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, নারীরা সাধারণত জানাজায় অংশ নেন না এবং এ নিয়ে নানা রকম কথাবার্তা হয় তাই যেখানে যেখানে নারী ইউএনও আছেন সেখানে পুরুষ প্রতিনিধি খুঁজতে বলা হয়েছে। অবাক হলাম এমন একটি প্রস্তাব সরকারের ভিতর থেকে আসতে পারে ভেবে!

বর্তমান সরকারের অন্যতম একটি ম্যান্ডেট হচ্ছে নারীর ক্ষমতায়ন। এরই অংশ হিসেবে প্রশাসনের বিভিন্ন জায়গায় নারীদের পদায়ন করা হয়েছে। নারীর ক্ষমতায়নকে আশ্রয় করে বাংলাদেশ মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল অর্জন করেছে।

বর্তমানে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। ২০৪১ সালে উন্নত দেশের স্বপ্নও দেখছি, যেখানে নারীর ক্ষমতায়ন একটি অন্যতম শর্ত। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একক প্রতিশ্রুতিতে এগিয়ে যাচ্ছেন এই বাংলার নারীরা। সংসদের স্পিকার নারী, বিচারপতির আসনে নারী আছেন। আধুনিক যুগে প্লেন চালাচ্ছেন নারী, জাতিসংঘের শান্তি রক্ষা মিশনে আছেন নারী। বিশ্ব যখন আজকে হাঁটছে নারী-পুরুষ বৈষম্যহীন একটি বিশ্বের দিকে, তখন আমাদের বাংলাদেশকে পিছিয়ে নিতে চাইছে কারা?

কদিন আগেই বিয়ের রেজিস্টার হিসেবে নারীরা থাকতে পারবেন না বলে একটি সুপারিশ করেছিল আইন মন্ত্রণালয়, যেটি হাইকোর্টের এক রুলের মাধ্যমে বাতিল করা হয়েছে। আমাদের নারীরা কোথায় নেই? খেলার মাঠ থেকে আকাশজয়, সবকিছুই হচ্ছে নারীর হাত ধরে।

যে দেশটি আজকে এগিয়ে যাচ্ছে রকেটের গতিতে, সেই দেশটির চালকের আসনে আছেন একজন নারী, যিনি বিশ্বের সফল নেতৃত্বের কাতারে নাম লিখিয়েছেন অনেক আগেই। পিছিয়ে পড়া মানুষ তো নারী নেতৃত্ব নিয়েও আপত্তি জানাচ্ছেন। তাহলে কি এই কমিটি দেশটির নেতারও পরিবর্তন চায়? মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় কমিটির কাজ কী? তাদের কাজ কি দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে এমন নীতি তৈরি করা, নাকি পিছিয়ে পড়ার জন্য রাস্তা বানানো?

বর্তমানে বাংলাদেশ একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। একদিকে অর্থনৈতিক উন্নয়ন, অপরদিকে মৌলবাদ, জঙ্গিবাদের উত্থান। ধর্মকে আশ্রয় করা মৌলবাদী গোষ্ঠী এমনিতেই নারী শিক্ষা, নারীদের বাইরে কাজ করা নিয়ে আপত্তি জানিয়ে আসছে। ৯০ ভাগ মুসলমানের দোহাই দিয়ে তারা দেশটাকে কী বানাতে চায় স্পষ্ট নয়। বাস্তবতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশ হাঁটছে অত্যন্ত সাহসিকতায়। মৌলবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অন্যতম একটি হাতিয়ার হচ্ছে নারীদের এগিয়ে যাওয়াকে উৎসাহিত করা।

সরকার নারী উদ্যোক্তা তৈরিতে কাজ করে যাচ্ছে নীতিগতভাবেই। অর্থাৎ, যেসব নারী কোনো না কোনো কারণে বাইরে কাজ করতে আসতে পারছেন না, তারা যেন ঘরে বসেই অর্থনৈতিক উন্নয়নে অংশীদার হতে পারেন সে জন্য নেয়া হচ্ছে নানা উদ্যোগ।

সরকারের কর্মকৌশল বলছে এক কথা আর এর অংশীদাররা চলছে উল্টোদিকে। সমাজে নানা অছিলায় চলছে নারীকে হেয় করার কাজ। নারী নির্যাতন, ধর্ষণের ঘটনা এখন নৈমিত্তিক। মাঠপর্যায় থেকে নারী নির্যাতনের ঘটনা সামনে আসে খুব কম। বিশেষ করে করোনাকালে যে পরিমাণ নারী নির্যাতন বেড়েছে, সেগুলোর দিকে নজর দেয়া কি কমিটিগুলোর কাজ নয়? বাল্যবিবাহের হার বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে। নারী শিক্ষার হারের কথা নাইবা বললাম।

প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডে আরও কীভাবে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ানো যায়, কীভাবে নারী প্রতিনিধিদের কার্যক্রমকে সম্প্রসারিত ও ক্ষমতায়ন করা যায় এ নিয়ে নীতিমালা সুপারিশ বা যাচাই কি সংসদীয় কমিটির কাজ নয়?

মূলত, সরকারের কাজগুলোর একটি চেক অ্যান্ড ব্যালেন্সের ভূমিকায় থাকার কথা কমিটিগুলোর। অথচ আমরা দেখলাম তারা সরকারি নীতির সঙ্গে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক একটি সুপারিশ করে বসল। এখন প্রশ্ন আসে, তার মানে কি শর্ষের মধ্যেই ভূত?

সরকারের ভিতরে বসে থাকা নীতিনির্ধারকদের মগজে তাহলে কী চলছে? তারাও কি চান নারী কেবল ঘরকন্যার কাজে ব্যস্ত থাকবেন? মৌলবাদের ধারক-বাহকের ভূমিকায় যদি আমাদের নীতিনির্ধারকরা আবির্ভূত হন, তাহলে আমাদের আশা-ভরসার জায়গাগুলো কেবল সংকীর্ণই হয় না, ধাক্কাও খায়। কেন বারবার হাইকোর্টকে সব বিষয়ে মতামত দিতে হবে?

নারী উন্নয়ন নীতি তো একটি মীমাংসিত বিষয়। এখানে কেন আবার নতুন করে হামলা আসছে? সংসদের নারী প্রতিনিধির কোটা বাড়ানো হয়েছে। সরাসরি নির্বাচনেও এখন নারীরা অংশ নিচ্ছেন। স্থানীয় প্রতিনিধি হিসেবে নারীর অবস্থান কোথায় কীভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে সেই বিষয়টিকে নিয়ে সংশ্লিষ্ট কমিটিগুলোর কোথাও কোনো আলোচনা দেখি না।

নারীবান্ধব কর্মপরিবেশ গড়ে তোলা নারী সমাজের একটি পুরোনো দাবি। আমাদের নারীরা ক্রমেই বাড়ির বাইরে বেরিয়ে আসছেন, নানা কাজে অংশ নিচ্ছেন।

অথচ, এর পরিপূরক একটি কর্মপরিবেশ গড়ে তোলা নিয়ে কাজটি হচ্ছে না। অথচ উল্টো নারীর অংশগ্রহণ কমিয়ে দেয়ার সুপারিশ করছেন নীতিনির্ধারকরা। এ ধরনের মানসিকতা কেবল নারীবিদ্বেষী মানসিকতারই প্রমাণ দেয়। নারীকে সমাজে অনেক ধরনের নির্যাতন বা বৈষম্যের শিকার হতে হয়। এর মধ্যে আছে- ১. যৌন হয়রানি ২. শারীরিক নির্যাতন ৩. মানসিক নির্যাতন এবং ৪. পদের বৈষম্য।

পরিসংখ্যান বলে নারীরা শ্রমের বিনিময়ে পুরুষের সমান মজুরি পান না। যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও নারীদের কেবল নারী বলেই নেয়া হয় না অনেক পদে। ধরেই নেয়া হয় নারীরা শারীরিক পরিশ্রম করতে হয় এমন পদের জন্য সঠিক নির্বাচন হয় না।

এতসব বৈষম্য বজায় রেখে কোনোভাবেই নারীর ক্ষমতায়নকে ত্বরান্বিত করা সম্ভব নয়। আমাদের বাজেট নারীবান্ধব নয়। নারী উন্নয়নের কথা বলি, অথচ নারীর জন্য একটি সহায়ক পরিবেশ নির্মাণে আমরা উদাসীন। সমাজ থেকে এসব বৈষম্য দূর করতে হলে দরকার নীতিমালা ও এর সঠিক বাস্তবায়ন। আর এ কাজটি করবেন আমাদের জনপ্রতিনিধিরা, যারা জনগণের রায় নিয়ে সংসদে বসে আইন বানান। অথচ এই কাজটি যারা করবেন তারাই ইদানীং দেখা যাচ্ছে নারী প্রগতির প্রতিদ্বন্দ্বীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছেন।

আমাদেরকে আরও জেন্ডার সেনসেটিভিটি নিয়ে কাজ করতে হবে। সরকারের মধ্যে বসে থাকা মানুষগুলোর জেন্ডার নীতিমালার যথেষ্ট অভাব আছে। লিঙ্গ বৈষম্য একটি বিশ্বাস ও চর্চার বিষয়। সন্দেহ জাগে, আমাদের সংসদীয় কমিটির যারা এই সুপারিশটি করার মতো চিন্তা করতে পেরেছেন তাদের মগজেও নারী একটি ‘অবজেক্ট’ মাত্র। নারীকে তারা সহযাত্রী হিসেবে ভাবতে পারছেন না।

আশা করছি, এই সুপারিশটি কোনোভাবেই গৃহীত হবে না। প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করছি, তিনি যেন কমিটিগুলোতে যারা কাজ করবেন তাদের জন্য একটি জেন্ডার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রাখেন। অন্যথায়, সরকারের সকল সাফল্য প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যাবে কেবল একটি সুপারিশেই।

লেখক: কলাম লেখক।

এ বিভাগের আরো খবর