জনপ্রিয় চিত্রনায়িকা পরীমনির অভিযোগ নিয়ে এখন তোলপাড় সারা দেশে। তার অভিযোগ সুনির্দিষ্ট। উত্তরা ক্লাবের সাবেক প্রেসিডেন্ট নাসির ইউ মাহমুদ ১০ জুন মধ্যরাতে আশুলিয়ার ঢাকা বোট ক্লাবে পরীমনিকে জোর করে মদ খাওয়াতে চেয়েছেন, খেতে না চাওয়ায় তাকে মারধর করেছেন, গালাগাল করেছেন, মুখের ভেতর জোর করে মদ ঢেলে দিয়েছেন।
এ ঘটনায় বিচার না পেয়ে চার দিন পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিঠি লেখা এবং সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার ২০ ঘণ্টার মধ্যেই গ্রেপ্তার করা হয়েছে নাসির ইউ মাহমুদসহ ৫ জনকে। ধর্ষণ এবং হত্যাচেষ্টা মামলার বিচার কেন প্রধানমন্ত্রীর কাছে চাইতে হবে জানি না।
ঘটনার দিন যদি বনানী থানা পুলিশ উদ্যোগী হতো, পরীমনির অভিযোগ আমলে নিত, ঘটনাস্থলে যেত, অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করত; তাহলে বোঝা যেত দেশে আইনের শাসন আছে, আইন তার নিজস্ব গতিতে চলছে। কিছু হলেই কেন প্রধানমন্ত্রীর কাছেই প্রতিকার চাইতে হবে? ভাইরাল না হলে বিচার হবে না, এটাই যদি প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়, তাহলে কেউ আর পুলিশের কাছে যাবে না, ফেসবুকে বিচার চাইবে। ফেসবুকে জনমত গড়ে উঠুক। কিন্তু ফেসবুক যেন বিচারের মানদণ্ড না হয়।
অবশ্য এই লেখা সেই ফেসবুক নিয়েই। গোটা পৃথিবীর মতো বাংলাদেশেও আজ ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আক্রান্ত। রাজনীতি যখন রাজপথ থেকে নির্বাসিত, তখন ফেসবুকই আজ হয়ে উঠেছে প্রতিবাদ, জনমত গড়ে তোলার প্রধান মাধ্যম। কিন্তু এই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমই আমাদের আরও বেশি অসামাজিক করে তুলেছে।
অ্যাকচুয়াল জীবনে যে চক্ষুলজ্জা, ভার্চুয়াল পৃথিবী তা কেড়ে নিয়েছে। বাস্তবে আমরা যে কথা বলতে পারি না বা মনে থাকলেও মুখে আসে না, ফেসবুকে অবলীলায় তা লিখে দিই। পরীমনি আক্রান্ত হওয়ার পর থানায় গিয়েছিলেন, হাসপাতালে গিয়েছিলেন, শিল্পী সমিতিতে গিয়েছিলেন, গিয়েছিলেন পরিচালক সমিতিতেও। কোথাও বিচার পাননি।
শেষ পর্যন্ত ফেসবুকের দ্বারস্থ হয়েছেন। বিচার চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর কাছে। মুহূর্তেই তার সেই স্ট্যাটাস ভাইরাল হয়ে যায়। সাংবাদিকরা ছুটে যান পরীমনির বাসায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গড়ে ওঠে প্রবল জনমত। দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার সব শ্রেণি-পেশার মানুষ। এই জনমতের প্রবল চাপেই প্রকাশ্যে অভিযোগের ২০ ঘণ্টার মধ্যেই গ্রেপ্তার করা হয়েছে মূল অভিযুক্ত নাসির ইউ মাহমুদসহ ৫ জনকে।
তাৎক্ষণিকভাবে জনমত গড়ে তোলার প্রবল শক্তি যেমন ফেসবুকের আছে। আবার ফেসবুকের অনেক অন্ধকার দিকও আছে। ফেসবুক, টুইটার, হোয়াটসঅ্যাপ, ইনস্টাগ্রাম, টিকটক, লাইকি- একেকটা অ্যাপস যেন একেকটা ফাঁদ।
ইন্টারনেটের বিশাল জগতে কত হাতছানি। রাতারাতি তারকা বনে যাওয়ার টোপ যেমন আছে, তেমনি আছে জীবন ধ্বংস করে দেয়ার ফাঁদও। বিশেষ করে নারীদের জন্য ভার্চুয়াল জগৎ মানেই যেন আতঙ্ক। ভিডিও ছড়িয়ে দেয়ার হুমকি দিয়ে কত নারীর সর্বনাশ করা হয়, তার কোনো ইয়ত্তা নেই।
পরীমনি রোববার সন্ধ্যায় যে স্ট্যাটাসটি দিয়েছিলেন, ২৪ ঘণ্টা পর তাতে ২ লাখ ৮৫ হাজার রিয়্যাক্ট, ১ লাখ ১০ হাজার মন্তব্য। রিয়্যাক্টের বেশির ভাগই অট্টহাসির। পরীমনির স্ট্যাটাসের ১ লাখ ১০ হাজার মন্তব্য ছাড়াও তার বিভিন্ন লাইভ, ফেসবুকে অন্য অনেকের স্ট্যাটাসের নিচে এ বিষয়ে আরও কয়েক লাখ মানুষের মন্তব্য আছে। সব মন্তব্য ফলো করা কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। তবে সত্যি কথা বলতে গেলে, মন্তব্যের কিছু অংশ দেখে আমার মনে হয়েছে আমরা আসলে আদিম যুগে বাস করছি।
নিজেদের সভ্য দাবি করার যোগ্যতা আমাদের নেই। মানুষের মনে এত বিকৃতি, এত অশ্লীলতা থাকতে পারে, এটা কল্পনা করাও অসম্ভব। মনে না হয় থাকল, কিন্তু সেই বিকৃতি, সেই অশ্লীলতা এভাবে প্রকাশ্যে সামাজিক যোগাযোগে উগড়ে দেয়া কীভাবে সম্ভব; আমার চিন্তায় আসে না!
বিকৃত মানসিকতার এই মানুষগুলোর মধ্যে কিছু ফেক আইডি যেমন আছে, তেমনি আছে বিপুলসংখ্যক চেনা মানুষও। আমি খালি ভাবি, এই মানুষগুলো যে এভাবে নিজেদের ভেতরের নোংরামি সমাজে ছড়িয়ে দিচ্ছে; তাদের কি বাবা-মা নেই, ভাই-বোন নেই, স্বামী/স্ত্রী-সন্তান নেই, বন্ধুবান্ধব নেই? আগে যেটা বলেছি, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আমাদের চোখের লজ্জার পর্দাটা সরিয়ে দিয়েছে।
পরীমনির অভিযোগ অনুযায়ী নাসির ইউ মাহমুদ তাকে ধর্ষণের চেষ্টা করেছে। কিন্তু ফেসবুকে নাসিরের অপরাধের চেয়ে পরীমনি কেন অত রাতে সেখানে গেল সেটা নিয়ে অনেকের কৌতূহল। ঢাকা বোট ক্লাব কোনো নিষিদ্ধ স্থান নয় যে, সেখানে যাওয়া যাবে না।
আচ্ছা ধরে নিলাম, পরীমনি অত রাতে সেখানে গিয়ে খুবই খারাপ কাজ করেছেন। কিন্তু একজন নারীকে মধ্যরাতে কোথাও পেলেই আপনি তাকে ধর্ষণ করতে যাবেন।
অনেকের মন্তব্য দেখে মনে হয়েছে, নাসিরের জায়গায় তিনিও থাকলে একই কাজ করতেন। অনেকে এমনও বলছেন, পরীমনিকে ধর্ষণ করতে হবে কেন? ভাবখানা এসন সিনেমার নায়িকাদের যেন কোনো মানসম্মান নেই, চাইলেই যে কেউ যখন-তখন নায়িকাদের কাছে পেতে পারেন। অনেকে বলছেন, ধর্ষণ-টর্ষণ কিছু না, টাকাপয়সার বনিবনা হয়নি। এগুলো কিন্তু উদ্ধৃত করার যোগ্য মন্তব্য। হাজার হাজার মন্তব্য আছে, যেগুলো এখানে লেখা তো দূরের কথা পড়তেও বিবমিষা জাগে।
আমরা সভ্যতার কথা বলি, ভদ্রতার কথা বলি। গত দুদিন ফেসবুক দেখে মনে হচ্ছে, এসবই আসলে ভদ্রতার মুখোশ। আমরা আসলে এখনও সভ্য হতে পারিনি।
পরীমনি কোথায় কার সঙ্গে বেড়াতে গেছেন, কেমন পোশাক পরে সিনেমায় অভিনয় করেছেন; এসব টেনে এনে তার সঙ্গে হওয়া অন্যায়কে জায়েজ করার চেষ্টা করছেন কেউ কেউ। এমনকি পরীমনি যখন সংবাদ সম্মেলনে কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন, তখনও অনেকে হাসছিলেন আর বলছিলেন, এটাও অভিনয়। পরীমনি বারবার বলছিলেন, আপনার সঙ্গে না হলে আপনি বুঝবেন না। আসলেই আমরা অনেকেই বুঝিনি, বুঝতে চাইওনি। সিনেমার নায়িকা মানেই যেন বাজারের পণ্য। আরে ভাই বাজারের পণ্যও তো আপনি অনুমতি ছাড়া ছুঁতে পারবেন না!
মানলাম, আপনাদের অভিযোগই ঠিক, পরীমনির চরিত্র ‘খারাপ’। তার অনেক পুরুষ বন্ধু। কিন্তু অনেক পুরুষ বন্ধু মানেই এই নয় যে, আপনিও তার বন্ধু। সিনেমার নায়িকা মানেই ভোগ্যপণ্য, এই ধারণাটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলুন, মানুষকে মর্যাদা দিতে শিখুন।
শুধু পরীমনির জন্য নয়, সব মানুষের জন্য একটা নিরাপদ দেশ গড়ার আমাদের সবার চেষ্টা, আকাঙ্ক্ষা। কিন্তু চারপাশে যখন এমন অসংখ্য বিকৃত মানুষ কিলবিল করছে, তখন সেই নিরাপদ সমাজটা গড়ে তোলা কঠিন। গত কদিনে ফেসবুকে অনেক মানুষ দেখেছি, যারা সেই নাসিরের মতোই।
নাসিরের সামর্থ্য আছে বলে সে পরীমনির ওপর চড়াও হয়। সুযোগ ও সামর্থ্য থাকলে আরও অনেক মানুষ নারীর ওপর চড়াও হতো। নিজেকে সভ্য দাবি করতে হলে আগে মানুষকে মর্যাদা দিতে শিখুন, মানুষের ব্যক্তি জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতাকে সম্মান করুন। নিজের ভেতরের অশ্লীলতাকে, নোংরা অস্তিত্বকে প্রকাশ করে সমাজকে আরও নোংরা করবেন না।
লেখক: সাংবাদিক, কলাম লেখক