খবরটি দেখে তথমত খেয়ে গেলাম। নারী নেতৃত্বাধীন একটি স্বাধীন দেশে এ রকম একটি প্রস্তাব নিয়ে সংসদীয় কমিটিতে আলোচনা হয় কীভাবে? খবর হচ্ছে: কোনো বীর মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যুর পর তাকে রাষ্ট্রীয় সম্মানের অংশ হিসেবে ‘গার্ড অব অনার’ দেয়ার সময় সরকারের নারী কর্মকর্তাদের উপস্থিতি নিয়ে আপত্তি তুলেছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। এ ব্যাপারে বিকল্প খুঁজতেও বলা হয়েছে ওই সুপারিশে।
কেন এ রকম একটি নিয়ম চালুর কথা উঠেছে, এ প্রশ্নের উত্তরে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি শাজাহান খান বলেছেন, ‘এই প্রশ্ন আসছে ধর্মীয় অনুভূতি থেকে। কোনো কোনো জায়গা থেকে বলা হয়েছে, জানাজায় নারীরা অংশ নিতে পারেন না।’
এ ক্ষেত্রে প্রথমেই যে প্রশ্নটা আসছে, সেটা হলো ‘গার্ড অব অনার’ কি জানাজা? একদম তা নয়। সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী, কোনো বীর মুক্তিযোদ্ধা মারা যাওয়ার পর তাকে রাষ্ট্রীয় সম্মান জানায় প্রশাসন। গার্ড অব অনার দিতে সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থিত থাকেন জেলা প্রশাসক বা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। রাষ্ট্রীয় সম্মানের অংশ হিসেবে সরকারের প্রতিনিধি হয়ে মরদেহে ফুলের শ্রদ্ধাও জানান সংশ্লিষ্ট ওই সরকারি কর্মকর্তা। এখানে জানাজার প্রশ্নটা এলো কোথা থেকে?
কেন এ রকম একটি বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে? কেন সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে নারীর উপস্থিতি ও পদমর্যাদা নিয়ে এই আপত্তি তোলা হচ্ছে? এর উত্তরে শাজাহান খান সাহেব গণমাধ্যমকে বলেছেন, “কোনো কোনো জায়গা থেকে বলা হয়েছে, জানাজায় নারীরা অংশ নিতে পারেন না। ‘গার্ড অফ অনার’ সাধারণত জানাজার সময় দেয়া হয় বলে এই সুপারিশ আসছে। যদি গার্ড অব অনার জানাজার আগে দেয় বা পরে দেয়, তখন জানাজা থাকে না। সেইটা একটা জিনিস। আমরা দেখেছি, সব জায়গায় জানাজার সময় গার্ড অব অনার দেয়। ওই জায়গায় ধর্মীয় অনুভূতির বিষয়টি বিবেচনা করে এটা সুপারিশ করা হয়েছে।”
জানাজার সাথে ‘গার্ড অফ অনার’-এর সময়েরও কোনো সম্পর্ক নেই। একজন মানুষ মারা যাওয়ার পরে অনেকবার জানাজা পড়ানো হয়ে থাকে দিনের বিভিন্ন সময়ে। আর ‘গার্ড অফ অনার’ একবারই দেয়া হয়, বীরকে রাষ্ট্রীয় সম্মান জানানোর জন্য। এ ক্ষেত্রে আগে বা পরে জানাজার প্রশ্নটি আসেই না। কেন তারা এ রকম এটি সুপারিশ পেশ করেছেন, সেটা তাদের বক্তব্যের মধ্যে স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠেনি।
এ প্রসঙ্গে সাংবাদিক আঙ্গুর নাহার মন্টি তার প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করতে গিয়ে বলেছেন, তার বাবা একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। উনি মারা যাওয়ার পর গার্ড অফ অনার দিয়েছিলেন একজন নারী ইউএনও। এতে ঐ শোকের সময়েও ওর অন্যরকমের একটা শান্তি লেগেছিল।
সম্মানিত সভাপতি সাহেবের কাছে আমরা জানতে চাই যে, কারা বা কোন কোন জায়গা থেকে এই আপত্তি তোলা হয়েছে? যারা আপত্তি তুলেছেন, তারা কি জানেন না যে জানাজা ও গার্ড অফ অনার এক জিনিস না? নাকি জেনেশুনেই নারীকে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়ার বাহানা বের করছেন? মহিলার বিকল্প একজন পুরুষকে দিয়ে গার্ড অফ অনার দেয়ার বিষয়টি এনে তারা কি রাষ্ট্রীয় ডেকোরামের প্রতি প্রশ্ন তুলছেন না?
শুধু কি নারী ইউএনও? বাংলাদেশে অনেক নারী জেলা প্রশাসকও তো আছেন। জেলা প্রশাসক বা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা একটি সরকারি পদ। এখানে নারী কিংবা পুরুষের কোনো প্রশ্ন আসে না। তবে কি সংসদীয় কমিটি এবার নারী ডিসি, এসপি, ইউএনও করার পথও রুদ্ধ করতে চাইবে? নারী যদি আর দশটা রাষ্ট্রীয় কাজ করতে পারেন, তাহলে এটা করতে বাধা কোথায়?
হঠাৎ একটি নিয়ম উত্থাপন করলেই চলে না। সংসদীয় কমিটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের অনেক কিছুই এসব কমিটিতে আলোচিত হয়। কাজেই এখানে যা কিছু আলোচিত হবে, নিঃসন্দেহে তা চিন্তাভাবনা করেই আলোচনা করা দরকার।
বাংলাদেশের নির্বাহী প্রধান হিসেবে নারী ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ১৯৯১ সাল থেকে, অর্থাৎ ৩০ বছর। বাংলাদেশের সংসদে স্পিকারও একজন নারী। যে দেশ নারীর নেতৃত্বাধীনে ৩০ বছর ধরে পরিচালিত হচ্ছে, সে দেশে এত বছর পরে এ রকম একটি অদ্ভূত প্রশ্ন ওঠে কীভাবে? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেদিন দেশের কতগুলো মডেল মসজিদ উদ্বোধন করেছেন। উনি সরকারপ্রধান হিসেবেই এটা করেছেন, কোনো নারী হিসেবে নয়। অন্য কোনো নারীকে এই কাজ করতে দেয়া হতো কি না, তা নিয়ে আমাদের সন্দেহ আছে। কাজেই নারী বলে নয়, নারী যে পদে অধিষ্ঠিত আছেন, সেটা ভেবেই কথা বলতে হবে।
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন ও পাকিস্তানি শোষণের বিরুদ্ধে এ দেশের নারী সমাজ সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছে। গান্ধীজির অসহযোগ, লবণ আইন, সত্যাগ্রহ, এ ছাড়া তেভাগা, নাচোল, টংক প্রথাবিরোধী আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ এবং সর্বশেষ এরশাদবিরোধী আন্দোলনে নারীর অংশগ্রহণ ছিল খুবই জোরালো। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের সংবিধান এবং এ দেশের আইন জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীর সমান অধিকার নিশ্চিত করেছে। দেশে সকল প্রশাসনিক পদ নারীর জন্য উন্মুক্ত।
এ অবস্থায় এ ধরনের চরম জেন্ডার অসংবেদনশীল ও অমূলক প্রস্তাব কীভাবে সংসদীয় কমিটিতে ওঠে ও আলোচিত হয়, তা সত্যিই বিস্ময়কর। সরকার যেখানে সব ধরনের কাজে নিয়োজিত নারীর প্রয়োজনের দিকটাকে মূল্য দেয়, সরকার যেখানে কর্মক্ষেত্রে জেন্ডারবান্ধব পরিবেশ প্রণয়ন করতে চায়, সেখানে নারীর পদমর্যাদার অধিকার শুধু নারী বলে, দুর্বল অজুহাতে কেড়ে নিতে দেয়া হবে না। আশা করি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিষয়টির প্রতি সহৃদয় দৃষ্টি দেবেন।
লেখক: সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন